টেকসহি I প্রকৃতি যখন জীবনের উৎস
২৮ জুলাই। বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। প্রকৃতির সুরক্ষায় জনসচেতনতা তৈরির উদ্যোগ। কেননা, প্রকৃতি সুরক্ষিত না থাকলে পৃথিবী তথা মানবসভ্যতা পড়ে যাবে অকল্পনীয় দুর্দশার ভেতর
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ডেথ ভ্যালির নাম নিশ্চয় শুনেছেন। সরল বাংলায় যাকে বলা যায় মৃত্যু উপত্যকা। এটি আসলে একটি বিস্তীর্ণ মরুভূমি। এখানে ফার্নেস ক্রিক নামে একটি জায়গা আছে, যেখানে স্রেফ শতাধিক লোকের বাস। ১৯১৩ সালে ডেথ ভ্যালি স্পর্শ করে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার মাইলফলক; যা ছিল ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সময়ের পরিক্রমায় এই লোকেশনই অর্জন করে বিশ্বের উষ্ণতম স্থানের খেতাব।
এবার আসি ডেথ ভ্যালি থেকে বেশ দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের গল্পে। ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল আমাদের দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়; ৪৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন ডেথ ভ্যালির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কত ছিল জানেন? ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ৩০ এপ্রিলের তাপমাত্রায় ডেথ ভ্যালিকেও ছাপিয়ে গেছে চুয়াডাঙ্গা!
এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাপমাত্রা নিয়ে এত কথাবার্তা কেন হচ্ছে? বলছি, তাপমাত্রার সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার কিন্তু দারুণ যোগ রয়েছে। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, চলতি বছরে যখন তীব্র দাবদাহে পুড়ছিল গোটা দেশ, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছিল তাপ কমাতে বৃক্ষরোপণের ঘোষণার হিড়িক। সেসব ঘোষণা বাস্তব রূপ কতটা পেয়েছে, সেদিকে না যাই! বরং দাবদাহ কমাতে গাছের ভূমিকা যে অপরিসীম, তা নিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও জনমনে সচেতনতা তৈরি হয়েছিল।
সর্বস্তরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং পরিবেশদূষণের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচিয়ে পরিবেশকে সংরক্ষণ করার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবছরের ২৮ জুলাই পালিত হয় ওয়ার্ল্ড নেচার কনজারভেশন ডে বা বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। পরিবেশের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে জনসচেতনতার মাধ্যমে প্রকৃতি সংরক্ষণের সচেতনতার জন্য পালন করা হয় দিবসটি। যার লক্ষ্য, বিশ্বের সকল মানুষকে বিশ্ব পরিবেশ ও পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো।
মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতি যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেই সত্য ছড়িয়ে দেওয়াই বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসের উদ্দেশ্য। এই দিবসের আনুষ্ঠানিকতা ১৯৯৮ সালে শুরু হলেও এর বীজ বোনা হয় ১৯০১ সালে। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন থিওডর রুজভেল্ট। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রকৃতির সুরক্ষার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। যে কারণে তাকে ‘কনজারভেশন প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করা হতো।
চারদিক সবুজে পরিপূর্ণ করার ১৯১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন নিজ দেশের সবুজ স্থান, পার্ক ও স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণের জন্য শুরু করেছিলেন এটি।
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির ওপর বাড়তে থাকে মানুষের দখলদারত্ব। ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে প্রাকৃতিক সম্পদ। সবটা মাথায় রেখে ১৯৪৮ সালের ৫ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ প্রতিষ্ঠা পায়। এটি বিশ্বের প্রথম পরিবেশগত পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সংস্থা। ষাট ও সত্তরের দশকে সংস্থাটি নজর দেওয়া শুরু করে জীবকুলের বিভিন্ন প্রজাতি এবং সেগুলোর বাসস্থানের দিকে। ১৯৬৪ সালে বিপন্ন প্রজাতির তালিকা প্রকাশ করে এটি। বিংশ শতাব্দীর শেষে পরিপূর্ণভাবে জোর দেওয়া শুরু হয় পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার নিরিখে সূচনা ঘটে বিশ্ব প্রকৃতি সুরক্ষা দিবসের।
প্রকৃতির সুরক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ অথচ অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ, পরিবেশদূষণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রভৃতি মানবসৃষ্ট কারণে প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ভূমির মাত্র প্রায় ১৬ ভাগ বনভূমি রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশে। দেখা পাওয়া যায় না সময়মতো বৃষ্টির। অসময়ে ছুটে আসে ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বনভূমির পরিমাণ কমার কারণে এমন সব দুর্যোগ ক্রমেই প্রবল আকার ধারণ করছে।
২০২২ সালে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) ‘হাওর এলাকার ভূমি ব্যবহারের কয়েক দশকের পরিবর্তন ও এবারের বন্যার ব্যাপকতা’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, গত ৩২ বছরে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলার হাওর অঞ্চলের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ কমেছে ৮০ শতাংশের বেশি। ফলে হাওর এলাকায় মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট পানি ধারণের প্রাকৃতিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমেছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, হাওর এলাকার জলাভূমি ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ কমে গেছে এবং ২০০৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আরও ৩৭ ভাগ কমে গিয়ে এখন প্রায় ২৩ ভাগ এলাকা অবশিষ্ট রয়েছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততা ও বন্যা। মাটির গভীরে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সংকট।
বন বিভাগের হিসাবে দেশের ১৪ শতাংশ এলাকাজুড়ে গাছপালা রয়েছে। আর ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৯ শতাংশ। তবে বিশ্বের বনজ সম্পদ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’-এর চলতি বছরের জুন মাসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ঢাকার মাত্র ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এলাকায় রয়েছে গাছপালা।
প্রকৃতি সংরক্ষণের অভাবে দুর্যোগ বাড়ছে, এ কথা তো হরহামেশাই বলা হয়। এই সমস্যা রোধে যে নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা জরুরি। দুর্যোগ যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, এগুলোকে রোধ করার হাতিয়ার হতে পারে রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহার বাড়ানো। এটি অর্থনীতির একটি বড় অংশ, যা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সাহায্য করে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব যে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে, তা রোধ করতে পুনর্ব্যবহার কিছুটা হলেও কার্যকর হতে পারে। অথচ আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় রিসাইকেলের ব্যবহার অপ্রতুল। তবে কয়েক বছরে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
পুনর্ব্যবহার কীভাবে করা যেতে পারে? প্লাস্টিকের বোতল থেকে তৈরি হতে পারে বিভিন্ন ফুলদানি ও শোপিস। পাইরোলাইসিস পদ্ধতির মাধ্যমে প্লাস্টিককে তরল জ্বালানি ও জ্বালানি গ্যাসে পরিণত করা যেতে পারে। এ ছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্যকে বেশি বেশি রিসাইকেলের আওতায় আনলে বর্জ্যরে পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনি প্লাস্টিকের উৎপাদনও কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রকৃতিকে বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের খাদ্যাভ্যাসও। প্রকৃতিকে যা ধ্বংস করে, এমন কিছু খাওয়ার পেছনে না ছুটে বরং উচিত হবে আশপাশের জমিতে যে ধরনের সবজি পাওয়া যায়, সেগুলো খাওয়া বাড়ানো। কমানো দরকার বিদ্যুৎ শক্তি। বিদ্যুৎ খরচ কম হয় এমন আলোকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি বাল্বও ব্যবহার করা যেতে পারে। তা ছাড়া বিদ্যুৎ সমস্যা রোধে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। এ হলো সূর্যালোক থেকে শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তর করার পদ্ধতি। তবে এ ক্ষেত্রে নেওয়া চাই কিছু বিশেষ ব্যবস্থা। যদি সোলার বা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে ফ্যান বা যন্ত্রাংশ চালাতে হয়, তাহলে ঘরের বাইরে সোলার প্যানেল স্থাপন করতে হবে। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে ধরে রাখা চাই। পরবর্তী সময়ে ওই বিদ্যুৎ দিয়েই যন্ত্রাংশ চালানো যেতে পারে।
বর্জ্য যত কমানো যায়, পরিবেশ তত সুরক্ষিত থাকে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু কাঁচা শাকসবজির খোসা, চা-পাতা বা ডিমের খোসাও ফেলনা নয়। এই ধরনের জিনিস মাটির নিচে রাখলে তা সারের কাজ করবে। খাদ্য ও খাদ্যজাত বর্জ্যকে মাটি ও গোবরের সঙ্গে মিশিয়ে জৈব সার ও কেঁচো সার উৎপাদন করা সম্ভব, যা রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে বছরে প্রায় ১.৬৮ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো সম্ভব। নারকেলের খোসা রিসাইকেল করে জাজিম, তোষক ও আসবাব তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। আখের খোসা রান্নার জ্বালানি অথবা কাগজ উৎপাদনে ব্যবহার সম্ভব।
এ ছাড়া আছে গৃহস্থালির শুকনো বর্জ্য। প্রতিবছর গড়ে এ ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হয় ২.০১ বিলিয়ন টন, যার ৩৩ শতাংশের কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা নেই। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ মানুষ বসবাস করে এমন উন্নত দেশগুলোতে প্রতিবছর ৩৪ শতাংশ বর্জ্য উৎপন্ন হয়; অঙ্কের হিসাবে যা ৬৮ মিলিয়ন টন। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে সলিড ওয়েস্ট বা শুকনো বর্জ্যরে পরিমাণ বছরে গড়ে ৩.৪ বিলিয়ন টনে উন্নীত হবে, যা আশঙ্কাজনক।
প্রথমেই বলেছি, চলতি বছরের দাবদাহে গাছের নাম নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ কথা সত্যি, প্রকৃতিকে ভালো রাখতে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। অথচ এই জায়গাতেই উন্নতির পরিবর্তে অবনতি দেখা যাচ্ছে বেশি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল, অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। আর মোট বৃক্ষ-আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। গাছপালার সংকটের প্রভাব যে শুধু মানুষের ওপর পড়ছে তা কিন্তু নয়; পড়ছে গোটা জীববৈচিত্র্যের ওপর। তাই প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত রাখতে এবং সব ধরনের ধংসাত্মক অবস্থা থেকে সুরক্ষা করতে প্রয়োজন বিভিন্ন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। অধিক হারে বৃক্ষরোপণ, শিল্পায়নের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযোগ্য সংরক্ষণ, পরিবেশদূষণ রোধে সচেতন হওয়া ইত্যাদি সোচ্চারমূলক কার্যক্রমই পারে প্রকৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে।
‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ বলে বাংলায় একটা কথা আছে। যদি প্রকৃতি সুস্থ থাকে, তাহলে মানবজাতিও সুস্থ থাকবে। আর প্রকৃতি সুরক্ষিত না থাকলে তার ফল ভুগতে হবে মানুষকেই। তাই বিশ্ব প্রকৃতি সুরক্ষা দিবসে প্রকৃতি ‘সুরক্ষা’র দিকে নজর দেওয়াই হোক সকলের অঙ্গীকার।
সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট