skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I নক্ষত্রের অপরূপ কন্যা

শেনান্দোয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় দীর্ঘ পাহাড় ঘিরে আদিগন্ত অরণ্যভূমি। নয়নাভিরাম। বৈচিত্র্যময়। ঘুরে এসে লিখেছেন ফারুক আহমেদ

ভার্জিনিয়ায় যে কটা জায়গা ঘুরে দেখার জন্য মনে মনে ঠিক করেছিলাম, প্রথম নামটি শেনান্দোয়া। বন্ধু বাবুকে আমেরিকায় যাওয়ার আগেই এ বাসনা জানালে সে বলেছিল, ‘আমার এখানে আসা অতিথিমাত্র শেনান্দোয়া দর্শন অবধারিত। তুই শুধু ভার্জিনিয়ায় পৌঁছা, শেনান্দোয়া না দেখিয়ে তোকে ছাড়ব না।’
বাবু বাসস্টেশনে আমাকে নিতে এলে নিউইয়র্ক থেকে ভার্জিনিয়া আসার পথটুকু যে মুগ্ধ করেছে, তা-ই বলতে লাগলাম। আমেরিকার হাইওয়ে, নদী, জঙ্গল—সব যেন ক্যামেরায় তুলে রাখার মতো। বাবু আমার কথা শুনে হাসল। আমরা ওর বাসার দিকে রওনা হলে এখানকার পথও মুগ্ধ করল। এ মুগ্ধতা বরং আগের চেয়ে খানিকটা বেশিই। এখানকার পথ যেন সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো কালো রঙের নদী। ধুলোহীন, গাছপালা ঘেরা পথের পাশেই দেখা যাচ্ছিল ছোট ছোট কমিউনিটি। দশ, পনেরো, বিশ বা তারও বেশি বাড়ি নিয়ে একেকটি কমিউনিটি। এসব বাড়ির ধরন আবার একই রকম। দুই বা তিনতলা। কোনোটা সিঙ্গেল, কোনোটা ডাবল। এ ক্ষেত্রে আকৃতিতে ছিমছাম, শান্ত এসব কমিউনিটির পাশ ঘেঁষে রাস্তা চলে গেছে। সেসব রাস্তা ধরে এগোলে হয়তো এ রকম আরও কমিউনিটি পাওয়া যাবে।
আরেকটু এগোনোর পর পাহাড়ের রেখা আমাদের দৃষ্টিসীমায় ঢুকে পড়ল। তার মানে, আমেরিকায় প্রথম পাহাড় দেখার ব্যাপারটি ঘটল ভার্জিনিয়ায় এসে। নিউইয়র্ক থেকে বেরিয়ে এখানে এসে সবুজের সমারোহে একটা শান্তিময় ঘোরগ্রস্ততা ঘিরে ফেলে আমাকে।
ভার্জিনিয়ায় পৌঁছানোর পরের দিনটি ছিল শেনান্দোয়া যাত্রার জন্য নির্ধারিত। প্রথম দিন এসেই ওয়াশিংটন ডিসি দেখার ধকল শরীরে লেগে ছিল। ফলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো এদিন। গোসল, নাশতা—এসব মিলিয়ে আমাদের রওনা হতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। যাহোক, বাবু ড্রাইভিং সিটে; পাশে আমি। পেছনের সিটে নূপুর এবং ওদের একমাত্র ছেলে নুসাইব। এই আমাদের চারজনের বাহিনী। ওরা জানাল, শেনান্দোয়ায় এর আগে অনেকবার গেছে এবং প্রতিবারই মুগ্ধ হয়েছে। আমি ওদের কথা শুনে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করলাম।
জিপিএস ম্যাপে ওদের বাসা থেকে দেখাচ্ছে এক ঘণ্টার পথ। দূরত্ব মোটামুটি ৫১ মাইল। আমেরিকার হাইওয়েতে জিপিএস ম্যাপ ছাড়া গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। এত এত রাস্তার সংযোগ, কোন পথ কোন দিকে গেছে, তা ধারণা করার সাধ্য নেই। ভার্জিনিয়ার এই হাইওয়ে ধরে হয়তো পুরো যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে বেড়ানো যাবে—এমনই রাস্তার সংযোগ। একটি হাইওয়ে অন্যগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। ফলে নতুন কিংবা কম চেনা গন্তব্য হলে জিপিএস ম্যাপকে সার্বক্ষণিক গাইডের দায়িত্ব দিতে হয়। অন্যথায় আপনাকে কানাওয়ালা ধরতে পারে, মানে ধরবেই! আপনি ঘুরতে থাকবেন, কিন্তু ঠিক পথটি খুঁজে পাবেন না।
গাড়ি ভেতরের পথ ঘুরে মহাসড়কে উঠে গেলে প্রথম দিনের পাহাড় দৃষ্টিসীমায় ফিরে এলো। বড়র কাছে যাওয়ার প্রবণতা ছোটদের চিরকালের। ভার্জিনিয়ায় গিয়ে শেনান্দোয়া যাব, দ্য গ্রেট ফলসে যাব, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ফসলের খেত দেখব—এসব ভেবে এসেছি। এখন পাহাড় দেখে এর কাছেও যেতে ইচ্ছা করছে।
কিছুদূর যাওয়ার পর, পাহাড় ডান দিক থেকে ঘুরে সামনে চলে এলো। আরও কিছু পর দেখা গেল, পাহাড়ের খুব কাছে পৌঁছে গেছি। সাধারণভাবে এক শ কিলোমিটার বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি গতিতে চলা গাড়িতে রাস্তার পাশের সুনির্দিষ্ট দৃশ্য দেখা সহজ নয়। এর মধ্যে একঝলক দেখা গেল আঙুরবাগান। এসব বাগানে একটি দিন ও একটি রাত যদি থাকা যেত, বেশ হতো। পৃথিবীর আঙুরখেতগুলো কীভাবে মানুষকে মাতাল করে, তা বোঝার সামান্য চেষ্টাটাও করা যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে সময়টুকু নেই। তা ছাড়া এসব পাগলামি বা আঁতলামি করার চিন্তাটাও আর স্ফীত করা গেল না। দুপাশের নানা মুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে সহসাই পাহাড়ের ভেতর ঢুকে পড়লাম। পথ এবার দুপাশের অনুচ্চ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদের শেনান্দোয়ার দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
আমেরিকার পথ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাস্তায় কত রকমের গাড়ি যে চলছে, তার বিবরণ দিতে গেলে অনেক পৃষ্ঠা হয়ে যাবে! টেসলার লেটেস্ট, অদ্ভুতুড়ে গাড়িটাও পথে দেখা গেল, যেন সায়েন্স ফিকশন ছবির কোনো গাড়ি, চার কোনা, ছয় কোনা—এমন। এ ছাড়া পথে পথে বিরাট আকারের অসংখ্য লরি। বিস্ময়কর রকমের বড়। মনে হলো কোনো কারণে ইঞ্জিন থেকে ছুটে গেলে পাশে চলা গাড়ি পিষে, একদম বিলীন হয়ে যাবে। আরেকটা লরি, যার ইঞ্জিন ছাড়া পুরোটাই খোলা। ওটার সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত নানা রকম সেডান, এসইউভি গাড়ি, ঘাড়ের ওপর চড়ে বসেছে যেন! এতগুলো গাড়ি বহন করে নিয়ে যাওয়া লরির গতি কিন্তু একটুও কম নয়। এমনকি বড় লরিগুলোও বিপুল গতি নিয়ে ছুটে চলেছে। অন্যদের মতো এদের গতিও শত কিলো; এরাই আসলে আমেরিকার হাইওয়ের রাজা, আমাদের যেমন ট্রাক।
অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা শেনান্দোয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এর মধ্যে রেললাইন দেখতে পেলাম। পাহাড় ঘেঁষে রেলপথ। একটি রেলগাড়ি পার হতেও দেখা গেল। আমেরিকার এসব টুকরো টুকরো দৃশ্য সে দেশ নিয়ে জমানো স্মৃতির মূল্যবান অংশ বলে মনে হলো। যাহোক, এরপর একটা মোড় পেরোতে গিয়ে পেলাম ছড়ানো-ছিটানো কিছু দোকান। বার্গার কিং, কেএফসি, ডানকিন (ডোনাট, কফি, বার্গার ইত্যাদির জন্য খুবই জনপ্রিয়) এ রকম দোকান। কয়েকটা জায়গায় রাস্তা অনেক নিচে নেমে গিয়ে আবার ওপরে উঠেছে। রাস্তার এই উত্থান-পতনে অবশ্য গাড়ির গতি খুব একটা কমানোর প্রয়োজন পড়ে না। ফলে এমন দৃশ্যে বেশ আনন্দ অনুভব হয়। বড় রাস্তা থেকে অন্য অনেক ছোট রাস্তা চলে গেছে, সেসব দেখে মনে হলো ওদিকেই যাই! অপূর্ব সব রাস্তা; অনুভব হলো, সেসব রাস্তা ধরে এগোলে সৌন্দর্যের অন্য এক বাঁক পাওয়া যাবে, যা ভাবনার অতীত। কিন্তু সময়, বা ততটুকু পাগলামো মানুষের সাধারণত থাকে না।
শেনান্দোয়া লেখা মাইলফলকটি পার হয়ে মূল গেটের দিকে এগোতে চোখে পড়ল, সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাবু জানাল, অনেকে গাড়ি রেখে হেঁটে ঢুকছে জঙ্গলে। কেউ কেউ ট্র্যাক করবে, কেউ আবার খরচ বাঁচাতে এমনটা করছে। আমরা প্রবেশের মূল গেটে পৌঁছালে ফি দেওয়ার জন্য গাড়ি থামাতে হলো। ওখানকার যেকোনো পার্কে (মানে রিজার্ভ ফরেস্টে) ঢুকতে হলে ফি দিতে হয়। বাবু ৮০ ডলার দিয়ে এক বছরের জন্য কার্ড করে নিল। এ কার্ডে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ন্যাশনাল পার্কে ঢুকতে আর কোনো ফি দিতে হবে না। তবে শুধু শেনান্দোয়ায় একবার ফি দিয়ে গাড়িসহ ঢুকতে চাইলে গুনতে হবে ৩০ ডলার। বার্ষিক কার্ড না থাকলে যেকোনো ন্যাশনাল পার্কে ঢুকতে গেলে ফির পরিমাণ ৩০ ডলার বা তার কাছাকাছি।
মূল ফটক পেরিয়ে পার্কে ঢোকামাত্র গহিন অরণ্যের আভাস পেলাম। এর মধ্যে কেউ কেউ ট্র্যাক করছে; কেউবা দল বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে—এমন অনেককে পাওয়া গেল। পাওয়া গেল যুগল বা দল বেঁধে চলা সাইকেল আরোহীর দলকেও। অনেকে গাড়িতে করে বাইসাইকেল নিয়ে আসে। তারপর কোথাও গাড়ি রেখে সাইকেলেই ঘুরে দেখে উপত্যকাটি। বাবু গাড়ির গ্লাস খুলে দিলে নূপুর সতর্ক করল, গাছ থেকে সাপ পড়তে পারে! বাবু এই সতর্কতাকে উড়িয়ে দিলেও ব্যাপারটা চিন্তার বলেই মনে হলো। ভার্জিনিয়াজুড়ে সাপের বিচরণ প্রচুর বলে শুনেছি। কিন্তু প্রকৃতি সহসা তার রং দিয়ে, ঘ্রাণ দিয়ে, অপরূপ হয়ে আমাদের এমনভাবে ঘিরে ফেলল, সাপের কথা মাথা থেকে উবে গেল পুরোদস্তুর।
শেনান্দোয়া মূলত একটি উপত্যকা। পুরো পার্ক মানে অরণ্যটি ছড়ানো একটি লম্বা পাহাড় ঘিরে। এই লম্বা উপত্যকার মধ্যে গড়ে উঠেছে বৃক্ষ-আবাস, অরণ্যভূমি। এর সর্বোচ্চ চূড়ার নাম হক্সবিল পর্বত; উচ্চতা ১ হাজার ২৩৪ মিটার বা ৪ হাজার ৫০ ফুট। এই উপত্যকার স্কাই ড্রাইভের গড় উচ্চতা ৫০০ থেকে ১৫০০ ফুটের মধ্যে। তবে এর বিভিন্ন চূড়ার উচ্চতা এই গড় উচ্চতার চেয়ে অনেক বেশি। দর্শনার্থীদের এসব চূড়ায় ওঠার ব্যাপারটা এই পার্ক ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। তা ছাড়া ৮০৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়ানো এই পার্কে ৮৫০ প্রজাতির বেশি ফুল রয়েছে। এসব বুনোফুলের প্রায় সবই ঘ্রাণহীন; তবে রূপে অনন্য। এর মধ্যে সামান্য হাইকিংয়ে দুটি ফুলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, একটির নাম মাউন্ট লরেল। ধবধবে সাদা, ছোট একাধিক পাপড়ির সন্নিবেশে অপরূপ এক ফুল। অন্যটির নাম জানা সম্ভব হয়নি।
এই পার্কের রূপ একেক সময় একেক রকম। শীতে পত্রহীন নগ্ন হয়ে পড়া গাছ আর বরফে ঢাকা শ্বেতশুভ্র এক পৃথিবী। গ্রীষ্মের শুরুতে নানা ফুলের সমাহারে ভরে যায় বৃক্ষরাজি। তা ছাড়া সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আসন্ন শীতের আগে গাছের পাতা বর্ণিল হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, পুরো বনটি রঙের অথবা হতে পারে প্রেমের আগুনে পুড়ছে! আমি যখন এসেছি, তখন গ্রীষ্মের মধ্যভাগ; মনোহর অনেক বুনোফুলের দেখা ঠিক ঠিক পাওয়া গেল। সেসব গাড়ির চলার সময়। ফলে কাছে থেকে দেখে ওদের নাম বা বংশপরিচয়—কিছু জানা সম্ভব হলো না। আসলে ঋতুভেদে এখানে নানান ফুল ফুটে থাকে। শীত ছাড়া অন্য তিন ঋতুতেই ফুলের সমাহার দেখা যায়। বসন্ত ও গ্রীষ্ম—এই দুই ঋতুতে ফোটে বেশি।
শেনান্দোয়ার স্কাই ড্রাইভ ভ্রামণিকদের কাছে খুব প্রিয়। সেই স্কাই ড্রাইভে বাঁক ঘুরলেই দেখা মেলে আমেরিকার আদিগন্ত। কিছুটা পরপর একেকটা বাঁক। নতুন বাঁকে নতুন নতুন দৃশ্য। এ রকম অসংখ্য বাঁক এবং মুগ্ধতাজাগানিয়া বিভিন্ন দৃশ্য শেনান্দোয়াজুড়ে। এসব বাঁক থেকে নিচে সাজানো গাছের সারি, পথের রেখা, বাড়িঘর ক্ষুদ্রতর হয়ে ধরা দেয় চোখে। সেখানকার আদিগন্তজুড়ে যে দৃশ্য, তাতে গাছপালাকেও মনে হয় নিয়ম মেনে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ফাঁকে সবুজ ঘাসের বিরাট বিরাট মাঠও যেন তেমনি গোছানো, সুন্দর। সঙ্গে বাড়িঘর—তা-ও নজরে আসে।
শেনান্দোয়া নামটা যেন কেমন! কোনোমতেই মনে হয় না এটা ইংরেজি শব্দ। ঘেঁটে জানা গেল, এটি সত্যি সত্যি ইংরেজি নয়। শব্দটি আমেরিকান আদিবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং নানা সময়ে এর নানা অর্থ তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য এর মোক্ষম বা অভাবনীয় অর্থটি হলো ‘নক্ষত্রের অপরূপ কন্যা’। আরও জানা গেল, একদা শেনান্দোয়ার এই পাহাড়ি বনে একটি অপরূপ লেক ছিল। লেক যদিও এখনো আছে, তবে কল্পনার সেই লেক ছিল স্বর্গীয়। ফলে নক্ষত্রের এক অপরূপ কন্যা হিসেবে শেনান্দোয়া মানুষকে, প্রাণকে মুক্ত করে যাচ্ছে।
শেনান্দোয়া নানা কারণে আমেরিকাবাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উদ্যান। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই; তা ছাড়া এই বন ঘিরে সেখানকার স্বাধীনতাকামী আদি আমেরিকানদের আবেগ জড়িত। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত চলা আমেরিকান গৃহযুদ্ধে এই অঞ্চলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখযোগ্য বেশ কটি যুদ্ধও হয়। এসব কারণে এবং এর সৌন্দর্যের জন্য আমেরিকান সংগীত ও সাহিত্যে শেনান্দোয়ার কথা বিশেষভাবে পাওয়া যায়। এ বনভূমি নিয়ে দুটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ করার আগে একটি ব্যান্ড দলের কথা বলা প্রয়োজন। যে দলের নামই ‘শেনান্দোয়া’। এ দলের গান বিলবোর্ডের টপচার্টে একাধিকবার জায়গা করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভোকাল গ্রুপ হিসেবে ব্যান্ডটি একাডেমি অব কান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে ১৯৯১ সালে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, শেনান্দোয়া নিয়ে যে দুটি গান এই বনের সমান্তরাল হয়ে আছে, সেগুলোসহ একাধিক গান রচিত হয়েছে। তুমুল জনপ্রিয় সেই দুই গানের একটির স্রষ্টার নাম জানা নেই। কেননা এটি একটি লোকগান; লোক-মানসের ভেতর থেকে উঠে আসা এক অপরূপ সংগীত। ‘ওহ শেনান্দোয়া, আই লং টু সি ইউ,/ অ্যাওয়ে ইউ রোলিং রিভার।/ ওহ শেনান্দোয়া, আই লং টু সি ইউ,/ অ্যাওয়ে, আ’ম বাউন্ড অ্যাওয়ে,/ অ্যাক্রস দ্য ওয়াইড মিসৌরি।’ অনেকে গেয়েছেন এই আমেরিকান লোকগান। টেনিসি আরনে ফোর্ডের গাওয়াটাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। উনিশ শতকের শুরুতে কানাডিয়ান বা আমেরিকান কোনো ভ্রামণিকের হাত দিয়ে শেনান্দোয়া নিয়ে এই অবিস্মরণীয় গানের জন্ম। গানটি আমেরিকার আরেক বিখ্যাত সংগীতশিল্পী বব ডিলানও গেয়েছেন। শিল্পীভেদে সুরের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পাওয়া গেলেও এ গান হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। এর বাইরে কবি, গীতিকার, শিল্পী জন ডেনভারের লেখা ‘টেক মি হোম, কান্ট্রি রোড’ গানটি শেনান্দোয়া নদীকে নিয়ে, যা এই বন ঘিরে এক হৃদয়গ্রাহী সংগীত হিসেবে আমেরিকানদের মনে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিয়েছে।
বনের ভেতরে পার্কিংয়ের জন্য জায়গা আছে। যেখান থেকে হাইকিং করে পাহাড়ি বনের প্রান্তে যাওয়া যায়, এমন সব জায়গার পাশে পার্কিং। বনের সব প্রান্ত মানে চূড়ার পর খোলা প্রান্ত। চূড়া থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। হাইকিং করতে গেলে পথের পাশে হরিণ, সাপ বা ভালুক যেকোনো সময় মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। আমরা একটা পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে হাইকিং শুরু করলে প্রথম দেখা হয় প্রজাপতির সঙ্গে; তারপর ফুলের সঙ্গে, তারপর ক্লান্তির সঙ্গে! কিছুদূর যাওয়ার পর আমি ওদের নিরুৎসাহিত করতে থাকি আর না এগোনোর। সেটাও প্রায় ৩০ মিনিট। আমরা গহিন অরণ্যে দাঁড়িয়ে গেলে দেখতে পাই, অনেকে প্রান্ত ছুঁয়ে ফিরে আসছে। তাদের ‘আর কত দূর’ জিজ্ঞেস করলে জানায়, আরও ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা যেতে হবে। এ-ও বলে, ‘যাও, অপূর্ব সব দৃশ্য দেখতে পাবে।’ আমরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসি। এর আগের দিন ওয়াশিংটন ডিসি ঘুরে আমি এমনিতেই ক্লান্ত, আর এদিনের সন্ধ্যায় ডিসিতে আবদুন নূর ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত। ফলে আমরা হাইকিংয়ের দিকে আর এগোতে চাইনি। আমাদের জন্য যদিও অপেক্ষা করে আছে একটি অপূর্ব চূড়া।
এ বন ভ্রামণিকদের কাছে খুবই প্রিয়, তা আগেই বলেছি। ২০২০ সালের জরিপে দেখা যায়, এই জাতীয় উদ্যান দেখতে এসেছিল সাড়ে ১৬ লাখ দর্শনার্থী। তার মানে, প্রতিদিন এই বনে কয়েক হাজার মানুষ প্রবেশ করে। পার্কটি বিশাল এলাকাজুড়ে হওয়ার কারণে তা টের পাওয়া যায় না। এ ছাড়া এখানে মাছ ধরার জন্য অনেকে আসে। কেউ কেউ আসে ক্যাম্পিং করতে। বনের ভেতর বেশ কটা রিসোর্টও আছে। এসব রিসোর্ট পরিচালনা করে পার্ক কর্তৃপক্ষ। যারা বনে রাতে থাকতে চায়, তাদের জন্য এসব রিসোর্টে নানা রকম প্যাকেজ চালু আছে। শুধু থাকা, থাকা ও হাইকিং; সঙ্গে কায়াকিং, ফিশিং, ক্যাম্পিং—নানা রকম প্যাকেজও দিয়ে থাকে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় আমেরিকাবাসীর পছন্দের জায়গার একটা হলো ভার্জিনিয়ার এই শেনান্দোয়া পার্ক। আমরা নিচে নেমে আসতেই মনে হলো, এই যে ভালুক পেলাম না, সাপ পেলাম না—ব্যাপারটা ভালো হলো, নাকি খারাপ! এদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় শেনান্দোয়ার স্বাদ কি পুরো পাওয়া গেল? নিচে নেমে ফিরতি পথ ধরে ঠিক করলাম, আরও দু-এক জায়গায় দাঁড়ানো যেতে পারে।
এমন অপূর্ব এক পাহাড়ি বন, স্বাভাবিকভাবেই একে ঘিরে নানা রকম সৃজনশীল কাজ হয়েছে। এর জীববৈচিত্র্য, বৃক্ষরাজি নিয়ে অসংখ্য বই আছে। আছে নানা রকম প্রকাশনা। আছে উপন্যাস। এসব বই পড়ে দূর থেকে এই বন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। হয়তো মায়াও জন্মাতে পারে। ‘শেনান্দোয়া’ শিরোনামে ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমায় এই অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের গল্প উঠে এসেছে। মূলত গৃহযুদ্ধের ইতিহাস এই সিনেমার মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারব। অনলাইনে বইয়ের খোঁজ করলে ঠিক ঠিক পেয়ে যাবেন। আরও মজার ব্যাপার, এখানে প্রতিবছর একজন শিল্পীকে ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্ট’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কোনো লেখক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী এই প্রোগামে এখানে থাকতে পারেন এবং তার পরামর্শ বা বিশেষ আইডিয়া পছন্দ হলে পার্ক কর্তৃপক্ষ তা কার্যকর করে।
আমরা ফিরতি পথে এক জায়গায় দাঁড়ালাম। এখানে অনেকে এসে দাঁড়ায়। বড় বড় পাথর আছে, সেখানে উঠে বনের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সবাই সেখানে বসে ছবি তুলছে। আমরাও উঠে পড়লাম। নূপুরকে বাবু বলল, ‘আমাদের দুই বন্ধুর ছবি তুলে দাও।’ ‘থ্রি ইডিয়ট’-এ যেমন পেছন থেকে তিন ইডিয়ট বন্ধুর ছবি, তেমনি আমরা দুই ইডিয়ট ছবি ওঠালাম; নূপুর বাদ পড়ে গেল। তারপর আরও কিছুটা সময় থেকে আবারও রওনা হলাম।
আসার সময় যে টানেল পেরিয়েছিলাম, সেটা আবারও পার হয়ে এলাম। ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে। চোখ যত টেনে ধরি, ঘুম ততটাই চোখকে টেনে ধরে। এর মধ্যে মিনিট ১৫ ঘুম হয়ে গেল। সজাগ হওয়ার পর বাবু বলল, ‘আমরা হরিণের পাল দেখলাম পথে, তুই তো ঘুমিয়ে পড়লি!’ ফলে ভালুক, সাপ, হরিণ—এই বনের তিন গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীর কোনোটির সঙ্গেই আমার দেখা হলো না। তবে যা দেখা হলো, তারও তুলনা নেই। বৃক্ষ, প্রকৃতি, আকাশ, আদিগন্তরেখা। শেনান্দোয়া যাওয়া-আসার পথটি, সে-ও দেখার মতো। বহুদিন মনে রাখার মতো এক স্মৃতি।

ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top