skip to Main Content

টেকসহি I অঙ্গদানের অঙ্গীকার

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরের ১৩ আগস্ট পালিত হয় ওয়ার্ল্ড অর্গান ডোনেশন ডে তথা বিশ্ব অঙ্গদান দিবস। অঙ্গদানের গুরুত্ব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে এবং অঙ্গদানে সচেতনতা বাড়াতে। প্রচলিত নানা ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণের উদ্দেশ্যেও

ডিসেম্বর ১৯৫৪। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ব্রিংহ্যাম অ্যান্ড উইমেন্স হাসপাতালে জোরকদমে চলছে অপারেশনের প্রস্তুতি। যেমন তেমন অপারেশন নয়। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপারেশন, তা-ও আবার একজন জীবিত ব্যক্তির শরীর থেকে। ছুরি-কাঁচি নিয়ে প্রস্তুত শল্যবিদ জেমস ই মুর। মনে শঙ্কা। কেননা, এর আগে যারা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই মেলেনি। তাই এবার অনেকটা সাহস নিয়েই অপারেশনের উদ্যোগ নেন ডা. মুর। কিডনি প্রতিস্থাপনের অপারেশন এটি। রোনাল্ড লি হেরিক নামক এক ব্যক্তি তার যমজ ভাই রিচার্ড হেরিকের জন্য দান করতে এসেছেন কিডনি। অপারেশন সাকসেসফুল। তাতে গোটা পৃথিবীর সামনে খুলে গেল চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন দরজা। আশার আলো দেখতে পেলেন অসংখ্য রোগী। রিচার্ড তার ভাইয়ের কিডনি নিয়ে বেঁচে ছিলেন ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। জীবিত ব্যক্তির পাশাপাশি মস্তিষ্কে মৃত (ব্রেন ডেথ) রোগীর কিডনি নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপনের প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৬৩ সালের ৩ জুন। চিকিৎসাবিদ্যায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো যুগান্তকারী অবদান রাখার জন্য ১৯৯০ সালে নোবেল পুরস্কার পান ডা. জোসেফ ই মুর।
অঙ্গ দান সাধারণত দুই ধরনের—মরণোত্তর ও ক্যাডাভেরিক। মরণোত্তর বলতে যেকোনো স্থানে মারা যাওয়ার পর অঙ্গদান। অন্যদিকে যাদের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায় এবং বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না, চিকিৎসাশাস্ত্রে তাদের ক্যাডাভেরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অঙ্গদান করতে প্রথমে খেয়াল রাখা চাই বয়স। জীবিত অবস্থায় অঙ্গদানকারীর বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। এইচআইভি, ক্যানসার, হেপাটাইটিসসহ একাধিক জটিল রোগে আক্রান্তরা ছাড়া প্রায় সবাই অঙ্গদানের অঙ্গীকার করতে পারবেন। চাইলে পুরো মানবদেহই দান করা যায়। মানবদেহের সবচেয়ে বেশি প্রতিস্থাপিত অঙ্গ কিডনি। তালিকার পরবর্তী অঙ্গগুলো হলো যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও অগ্ন্যাশয়। এর বাইরে চোখ বা কর্নিয়া, হাড়, ত্বক, হার্ট ভাল্‌ভ, ব্লাড ভেসেল, নার্ভ ও টেন্ডনও দান করা সম্ভব।
বাংলাদেশে দান করা সবচেয়ে বেশি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোখ। জীবিত অবস্থায় শুধু নিকটাত্মীয়কেই কিডনি, লিভারের মতো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করা যাবে। তবে চোখ, চর্ম, টিস্যু ইত্যাদি যে কাউকে দান করা যায়; নিকটাত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা সেখানে বাধ্যতামূলক নয়। ১৫ থেকে ৫০ বছরের ব্যক্তিরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গ্রহীতা হিসেবে অগ্রাধিকার পান। অবশ্য চোখের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো বিধিনিষেধ থাকে না।
দান করা অঙ্গ রোগীর শরীরে স্থাপন করারও কিছু নির্ধারিত সময় আছে। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর হৃৎপিণ্ড ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে হয়। ফুসফুস প্রতিস্থাপন করতে হয় ৪ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে; লিভার ১২-১৫ ঘণ্টা, প্যানক্রিয়াস ১২-১৪ ঘণ্টা এবং কিডনি ২৪-৪৬ ঘণ্টার মধ্যে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করতে চাইলে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় নেওয়া অনুচিত।
মরণোত্তর দেহদান বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে চাইলে বাংলাদেশের যেকোনো মেডিকেল কলেজ অথবা হাসপাতালের অধ্যক্ষ বা পরিচালক বরাবর আবেদন করতে হয়। সেখানে স্ট্যাম্প কাগজে হলফনামা, দুই কপি সত্যায়িত পাসপোর্ট ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি দিয়ে আবেদন করা যায়। পাশাপাশি পরিবারের দুজন সদস্যের সাক্ষী হিসেবে সম্মতি থাকতে হয়।
বাংলাদেশে মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৯৯ সালে। আইনটির সংশোধনী আনা হয় ২০১৮ সালে। এই আইন অনুযায়ী জীবিত নিকটাত্মীয়ের বাইরে কেবল ব্রেন ডেথ রোগীদের অঙ্গই নেওয়া হয়। কিডনির ক্ষেত্রে জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের এই অঙ্গ নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও আপন চাচা-ফুফু, মামা-খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি এবং আপন চাচাতো-ফুফাতো, মামাতো-খালাতো ভাই বা বোন। এই তালিকাভুক্ত ২২ জনের বাইরে অন্য কারও শরীর থেকে কিডনি নিয়ে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করার আইনি সুযোগ নেই।
আইন অনুযায়ী নিকটাত্মীয়তা নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা ওই ধরনের তথ্য দিতে উৎসাহিত, প্ররোচিত বা ভীতি প্রদর্শন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ জন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। নিকটাত্মীয়-সংক্রান্ত অপরাধ ছাড়া এই আইনের অন্য কোনো বিধান লঙ্ঘন কিংবা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথাও আইনে উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। তা ছাড়া প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকল হয়ে মারা যান। দেশে এক কোটির বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত, যার অন্তত ১০ শতাংশের লিভার বিকল হয়ে যায়। কর্নিয়াজনিত সমস্যার কারণে অন্ধের সংখ্যা ৫ লাখ। প্রতিবছর আরও ৩০ হাজার মানুষ কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব বরণ করেন। বছরে দেশে মাত্র ১৫০টির মতো কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
উন্নত বিশ্বে ৬০ শতাংশ রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন এবং এর ৯০ শতাংশ কিডনি মৃতদেহ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কারণ, উন্নত বিশ্বে কিডনি প্রদানের ক্ষেত্রে তেমন আইনানুগ জটিলতা নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত ১৮ থেকে ৭০ বছর বয়স্ক যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি তিনভাবে কিডনি দান করে থাকেন। প্রথমত, পছন্দমতো রোগীর জন্য সরাসরি দানের মাধ্যমে; দ্বিতীয়ত, হাসপাতালের প্রয়োজনমাফিক অনাত্মীয়ের বিকল কিডনিতে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এবং তৃতীয়ত, রক্তের গ্রুপ না মিললে দুজন দাতার কিডনি প্রয়োজন অনুযায়ী দুজন বিকল কিডনি রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে।
কানাডায় যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি অপরিচিত রোগীর জন্য কিডনি দান করতে পারেন। ইচ্ছা করলে একটি কিডনি, যকৃতের অংশবিশেষ এবং ফুসফুসের একটি অংশও দান করতে পারেন তিনি। জীবিত ও মৃত দাতার শরীরের অংশ দিয়ে আটজনের জীবন রক্ষা করা যায় এবং ৭৫ জন অসুস্থ রোগীর জীবনের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে হিউম্যান টিস্যু অ্যাক্ট, ২০০৪ এবং স্কটল্যান্ডে হিউম্যান টিস্যু অ্যাক্ট, ২০০৬ আইন অনুযায়ী, যেকোনো বয়সের সুস্থ নাগরিক আত্মীয় বা অনাত্মীয় রোগীকে উল্লিখিত তিন পদ্ধতিতে অঙ্গ দান করতে পারেন। আত্মীয়স্বজনের আপত্তি না থাকলে মৃত ব্যক্তির অঙ্গ ব্যবহার করা আইনসিদ্ধ।
ভারতে জীবিত আত্মীয়স্বজন সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে অঙ্গ দান করতে পারেন। অনাত্মীয় ব্যক্তি অঙ্গ দান করতে চাইলে রাজ্যের অনুমোদন কমিটিকে জানাতে হয়। কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কায় অনাত্মীয় সুস্থ ব্যক্তি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নৈতিক সততা কমিটির অনুমতিক্রমে দান করতে পারেন অঙ্গ।
আদর্শ অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন চালু আছে ইরানে। দেশটিতে ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত কেবল জীবিত আত্মীয়রা অঙ্গ দান করতে পারতেন। ১৯৮৮ সাল থেকে জীবিত অনাত্মীয়দের অঙ্গদান আইনে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০০০ সাল থেকে মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান চালু হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে সে দেশে সুস্থ জীবিত সব অঙ্গদানকারীকে বিশেষ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়। ফলে ইরানে কিডনি প্রতিস্থাপনের কোনো অপেক্ষমাণ তালিকা খুঁজে পাওয়া বিরল। দেশটিতে বিকল কিডনি রোগীদের বেশির ভাগই জীবিত ব্যক্তির কিডনি ধারণ করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন কয়েক বছর ধরে।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। দুই ও তিন নম্বরে রয়েছে স্পেন ও ফ্রান্স। তালিকার সবচেয়ে নিচের স্থানে জাপান, গ্রিস ও লাটভিয়া।
আরজ আলী মাতুব্বরের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম মরণোত্তর দেহদান শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। স্বশিক্ষিত এই দার্শনিক তার মৃতদেহ বরিশাল মেডিকেল কলেজে দান করে গিয়েছিলেন। কেননা, মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজেও মরণোত্তর দেহের প্রয়োজন পড়ে।
বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে জীবিত দাতা প্রদত্ত কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। ব্রেন ডেথ রোগীর কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার ব্যাপারে আইনি সীমাবদ্ধতা ছিল। ২০১৮ সালে আত্মীয়দের সম্মতিতে এমন রোগীর অঙ্গ সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে অঙ্গদান আইন সংশোধন করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি সারাহ ইসলামের মাধ্যমে দেশে প্রথম মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। বলা যায়, আমাদের দেশে অঙ্গদানের নতুন জোয়ার শুরু করেন এই অকালপ্রয়াত তরুণী।
অঙ্গদানের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা। তাই অঙ্গদান নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো একান্তভাবে কাম্য। অঙ্গ দান করার পর ব্যক্তি অসুস্থতা বোধ করলে কিংবা নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
ভূপেন হাজারিকা সেই কবে গেয়ে গেছেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’। একটি জীবনপ্রদীপ নিভে গেলে, সেই প্রদীপই জ্বালিয়ে তুলতে পারে আরও আটটি প্রাণ। অঙ্গদানেই আলোর পথে ফিরতে পারেন কোনো না কোনো মৃত্যুপথযাত্রী। তাই এগিয়ে আসুন আর অঙ্গীকার করুন অঙ্গদানের, নতুন জীবন দানের।

 সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top