যাপনচিত্র I ‘খুব চেনা চেনা’
নাহার। সংগীতজীবনে পুনম নামেই বেশি পরিচিত। ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের কম্পোজিশনে তার গাওয়া ‘ব্যস্ত শহরে’, ‘এই’, ‘নবীনা’, ‘খুব চেনা চেনা’ এফএম রেডিওর জোয়ারে ভেসেছিল ভীষণ! গেয়েছেন সিনেমা আর সিরিজেও। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। সম্প্রতি দেশে ফিরে কাজ গুছিয়ে গেছেন রাইফ আল হাসান রাফা ও আবু জাফর ইশরাক দ্বীপের সঙ্গে। সেগুলো প্রকাশের অপেক্ষায়
পারিবারিক সূত্রে ছোটবেলায় ছিলেন কাতারের দোহায়। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। বহুদিন সেখানেই আবাস। তার জীবনযাপনের বড় অংশ ধ্রুপদি চলচ্চিত্র ও সংগীত ঘিরে। কৈশোরে পছন্দের মুভির তালিকায় ছিল সাউন্ড অব মিউজিক, ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি প্রভৃতি। মা ছিলেন সংগীতশিল্পী। বাসায় তানপুরা, হারমোনিয়ামের চর্চা দেখে সংগীতের প্রতি কৌতূহল। মাইকেল জ্যাকসনের গানে মেতে থাকতেন দিনরাত। তখন থেকে বুঝতে শুরু করেন সুরের ভিন্নতা ও মাধুর্যের গভীরতা। অনুপ্রেরণার কাতারে ধীরে ধীরে যোগ হতে থাকে লতা মঙ্গেশকর, ইটা জেমস, নিনা সিমোনের মতো শিল্পীদের গান। কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের কারণে মেহেদি হাসান, গোলাম আলী ও জগজিৎ সিংয়ের লাইভ পারফরম্যান্স উপভোগ করেছেন অল্প বয়সেই। ট্রেন্ডি মিউজিশিয়ানদের মধ্যে পছন্দের তালিকায় আরিয়ানা গ্রান্ডে ও ডুয়া লিপা বেশি প্রিয়। তাদের স্টাইল, ভয়েস রেঞ্জ পছন্দের মূল কারণ।
সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যেই বিছানা ছাড়েন নাহার ওরফে পুনম। তারপর আড়াই ঘণ্টা ব্যায়াম করেন। যার মধ্যে ১৫-৩০ মিনিট কার্ডিও, ওয়েট লিফটিং, ক্ষেত্রভেদে আর্মস, এবস, লেগস ও ব্যাক। এ ধরনের ওয়ার্কআউট থেকে সপ্তাহে এক দিন বিশ্রাম নেন; অবশ্য সেদিনও হাঁটাহাঁটি করে শারীরিক কমনীয়তা ধরে রাখেন। সকালের দেহচর্চা শেষে প্রোটিন শেক গ্রহণ করেন। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েন রান্নায়। ছোটবেলা থেকে মাকে দেখে রান্নার প্রতি দারুণ ঝোঁক তার। অবশ্য আদুরে এই কন্যাকে তখন রান্নাঘরে ঢুকতে দিতেন না মা। বিদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন রান্নার নিরীক্ষা করে নিজের খাবার নিজেই তৈরি করেন। চিকেন ব্রেস্ট গ্রিল অথবা বেকড কিংবা এয়ার ফ্রায়ারে কিছু একটা তৈরি করে ফেলেন নিমেষে! তা দিয়েই বেলা ১টা থেকে ২টার মধ্যে সেরে নেন মধ্যাহ্নভোজ। রাতে সাধারণত কিছুই খান না। তবে খুব খিদে পেয়ে গেলে একটি আপেল কিংবা পিনাট বাটার খেয়ে নেন। কেক থেকে শুরু করে চমচম, কালোজাম, রসমালাই তৈরিতে খুব দক্ষ নাহার। মাছ, বিশেষত স্যামন ফিশ ও সবজি খেতে ভালোবাসেন। তবে কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলেন। এ ছাড়া সময় পেলে ছবি এঁকে ঝালিয়ে নেন নিজের সুপ্ত প্রতিভা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার রাজধানী আটলান্টায় বসবাস নাহারের। অন্তর্মুখী স্বভাবের এই গায়িকা নিজেকে সময় দিতেই বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য সপ্তাহে দু-এক দিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও দেন। ‘আই অ্যাম সোশ্যাল ইন সার্টেইন ক্রাউড’—নিজের সম্পর্কে ভাষ্য তার। একধরনের ‘অ্যান্টি-সোশ্যাল’ মনোভাব থাকলেও বড় ধরনের জনসমারোহ তার ভালোই লাগে। বললেন, ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট ইন গেটিং এভরিবডি টুগেদার।’
তার সঙ্গে আলাপে আরও জানা গেল, বাসার আসবাবের মধ্যে কিছুটা ক্ল্যাসিক ভিনটেজ ফার্নিচার পছন্দ করেন। তবে বাবা-মায়ের বাসায় কাঠের কাজ করা ফার্নিচারও তার বেশ পছন্দ। আধুনিক আসবাবে রঙের ক্ষেত্রে সাদা পছন্দের শীর্ষে। এ ছাড়া নীল, হলুদ, বেগুনি রঙের মিনিমালিস্টিক ফার্নিচারের পাশাপাশি দেয়ালে বড় পেইন্টিং তাকে মুগ্ধ করে। পোশাকের ক্ষেত্রেও সাধারণত সাদা রং পছন্দ করলেও ডিজাইনকে প্রাধান্য দেন। ওয়েস্টার্ন পরতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করলেও শাড়ি তার ভীষণ পছন্দের। অবশ্য নিজে শাড়ি পরতে পারেন না বলে ঈদ বা বৈশাখে সচরাচর ইন্দো-ওয়েস্টার্ন পোশাক পরে থাকেন। এ ছাড়া সালোয়ার-কামিজের ক্ষেত্রেও পছন্দের কমতি নেই। গত বছর রাজশাহী ঘুরতে গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত সপুরা সিল্কের প্রেমে পড়ে যান। পরে সেখান থেকে সালোয়ার-কামিজও কিনে আনেন তিনি।
অ্যাকসেসরিজের ক্ষেত্রে তেমন ব্র্যান্ড ফোকাসড না করা নাহার পছন্দসই যেকোনো কিছুতেই আস্থা রাখেন। ঘড়ি ও ইয়ার রিং সব সময় পরেন। পারফিউমের ক্ষেত্রে পাকো রাবানের লেডি মিলিয়ন, টরি বার্চ, মানি কোড ছাড়াও প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য অন্যান্য সাধারণ সুগন্ধিও বেছে নেন।
ভায়োলা ডেভিস, স্টেনলি টুচির অভিনয় থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না নাহার। পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান, মার্টিন স্করসেজি, ফ্রান্সিস পাপিলনের সিনেমা তার বেশি প্রিয়। একমাত্র সেলিব্রিটি ক্রাশ ব্রিটিশ অভিনেতা হেনরি কেভিল। হলিউড সিনেমায় ভবিষ্যতে অভিনয় করতে পারেন বলে জানালেন।
ভালো না লাগলে খুব একটা ট্রেন্ড ফলো করেন না নাহার। ইউনিক স্টাইল বলতে চুল লম্বা রাখেন সব সময়। তার কাছে স্টাইল মানে স্বস্তি ও আত্মবিশ্বাস জোগানোর পাথেয়। একজন আর্টিস্ট হিসেবে মেকআপ তার কাছে আর্টের মতো। অভিনয় করতে গিয়ে অনেক মেকআপ আর্টিস্টের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় এ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন এবং বিভিন্ন ফটোশুটে নিজের মেকআপ নিজে সারতে পছন্দ করেন।
কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ছাড়া দেশের বাইরে তেমন কোথাও ঘুরতে না গেলেও ইউরোপ ভ্রমণের ইচ্ছা প্রবল। গ্রিস, তুরস্কের ইস্তাম্বুল, ফ্রান্সের প্যারিস ছাড়াও যেতে চান ইতালিতে, সেখানকার রান্না ও খাবারের সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখার জন্য। প্রিয় লোকেশন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা, যেখানে মধ্যরাতে গাড়ির লাইট ছাড়া কোনো আলো নেই; ভোরের আলোয় বিশাল পাহাড়ের মাঝে নিজেকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হয় নাহারের। তা ছাড়া ওয়াশিংটন ডিসির মিউজিয়াম, ক্যালিফোর্নিয়া পার্কের বড় বড় গাছ এবং খরুচে অথচ আনন্দমুখর লাস ভেগাসের কথা আসে বারবার।
মা-বাবার ইচ্ছা ছিল, নাহার ডাক্তার হবেন। অবশ্য সে পথে হাঁটেননি তিনি। নিজের প্রতিভা আবিষ্কার করে, ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। তার মতে, প্রত্যেকেরই নিজ নিজ প্রতিভা খুঁজে বের করে, সেটি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করা শ্রেয়।
১৩-১৪ বছর বয়সে ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের সঙ্গে প্রথম মিউজিক নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে অভিনয়েও ব্যস্ত সময় কাটছে নাহারের। বাংলা সলো, ইংরেজি অ্যালবাম ও মিক্সিং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করছেন। শিগগির তার মিউজিক ভিডিও রিলিজ পেতে যাচ্ছে। পপ রক নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন নাহার। তা ছাড়া বড় মিউজিক রেকর্ড লেবেলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিউজিক রিলিজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: নাহারের সৌজন্যে