skip to Main Content

কভারস্টোরি I ডিজিটাল প্রলয়ে ফ্যাশন ম্যাগাজিন

ডিজিটাল যুগের বাড়বাড়ন্তে পত্রিকার ছাপা সংস্করণের অবস্থা বেগতিক। ম্যাগাজিনের অবস্থা আরও করুণ। তথৈবচ অবস্থা বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন সাময়িকীগুলোরও। কেবল প্রযুক্তির উৎকর্ষ নয়, পাঠকের প্রজন্মান্তরে বদলে যাওয়া রুচি, প্রকৃতি আর পছন্দ-অপছন্দের তরিকাও বর্তমান পরিস্থিতির অনুঘটক। লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান

১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘গোস্টবাস্টার’। ছবিটি দেখেছেন নিশ্চয়? না দেখলে একবার দেখে নিতে পারেন। সেখানে নতুন নিয়োগ পাওয়া জেনিস অলসভাবে একটি ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে পড়ার অভ্যাসবিষয়ক প্রসঙ্গের অবতারণা করলে খানিক রূঢ় ভঙ্গিতে বিজ্ঞানী ইগন স্পেঙ্গলার বলে ওঠেন, ‘প্রিন্ট ইজ ডেড’। ৪০ বছর আগে ইগনের দেওয়া পূর্বাভাসই আজকের নির্জলা সত্যি। নতুন শতকের প্রথম দশক থেকেই পরিস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। ইন্টারেনেটের নানামাত্রিক উদ্বর্তনই মূলত অশনি হয়েছে। কেবল সংবাদপত্র নয়, সাময়িকপত্রও এখন খাঁড়ার নিচে। শেষোক্তের সমস্যাটি দ্রুত প্রকট হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাময়িকপত্র বললে ফ্যাশন ম্যাগাজিন তো আর বাদ থাকে না!
নতুন শতকের তৃতীয় দশকে আমরা আছি। এই সময়ে অর্থাৎ এই ২৪ বছরে পৃথিবীর আলো দেখা প্রজন্ম, তা সে জেন জি হোক কিংবা জেন আলফা—প্রযুক্তির সঙ্গেই এদের বসবাস। প্রযুক্তিকে নিয়েই এদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এদের রুচি, আচার-আচরণ, মনোভাব, পছন্দ-অপছন্দ, আবেগ—সবই আলাদা। আমাদের মতো ওল্ড স্কুল জেনারেশনের সঙ্গে এদের ব্যবধান দুস্তর। এই টেকস্যাভি প্রজন্ম স্ক্রিনেই খুঁজে নেয় জীবনের যাবতীয় রসদ। তাদের হাতে থাকে কেবল ডিভাইস; অন্য কিছু নয়। ফলে ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়ায় তাদের যতেক অনাগ্রহ। নতুন বই বা ম্যাগাজিনের সৌরভ ছিল আমাদের আসক্তি। সেটা ওদের নেই। এ ক্ষেত্রে এরা একেবারেই নির্মোহ।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন একে আরও ঘোলাটে করে দিয়ে গেল করোনা। প্রিন্ট পত্রিকার সঙ্গে সাময়িকপত্রের দফারফা হলো। সেই সময়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বেশ জোরেশোরেই প্রচার চালানো হলো ‘প্রিন্ট ইজ প্রুফ’ বলে। আমরা যদিও এই সত্য জানি। প্রিন্ট ইজ প্রুফ—এই সত্যকে উপেক্ষা না করেও বললে অত্যুক্তি হবে না যে, প্রিন্ট ইজ অলমোস্ট ডেড। মুমূর্ষু। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকা ও সাময়িকপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান অনলাইন সংস্করণে নির্ভর করেছে। করছেও। ফ্যাশন ম্যাগাজিনেরও অভিন্ন অবস্থা।
দৈনিক পত্রিকাই বলি কিংবা সাময়িকপত্র—উভয়ই টিকে থাকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর—পাঠকপ্রিয়তা ও বিজ্ঞাপন। উভয়ই সম্পর্কযুক্ত। পাঠকপ্রিয়তার সমান্তরালে আসে বিজ্ঞাপন। যত পাঠক, তত তার রমরমা। কারণ, সেটিই হয়ে যায় বিজ্ঞাপনদাতাদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার মানদণ্ড।
পাঠকের মনোভাব বদল বিজ্ঞাপনদাতাদের মনোভাব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। পাঠক ফিজিক্যাল থেকে ভার্চুয়াল জগতে শিফট হয়ে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারাও ফিজিক্যাল থেকে মুখ ফিরিয়ে ভার্চুয়াল অভিমুখী হয়েছে। এতে করে ছাপা পত্রিকার রাজস্ব কমেছে ব্যাপক। অন্যদিকে, অনলাইনে বিজ্ঞাপন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। উপরন্তু এখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া সুবিধা। তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। পক্ষান্তরে কার্যকরও। কারণ, অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছায়। এর কোনো সীমা নেই। অসীম। থেকে যায় অনন্তকাল। এসবই আবার প্রিন্ট পত্রিকার ক্ষেত্রে হয় না। নানা অন্তরায় আর সীমাবদ্ধতা সেখানে আছে।
অন্যদিকে মানুষ এখন কেবল পড়তে চায় না; দেখতে চায়, শুনতেও চায়। অনলাইন এখন বস্তুত সবকিছুরই সমষ্টি। আমি তো বলি এটি টিভি, রেডিও আর ছাপা পত্রিকার সমন্বিত এক রূপ। উপরন্তু অনেক বেশি ইন্টার‌্যাকটিভও। পাঠকের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ সংযোগ করা যায়। তাদের মনোভাব বোঝা যায়। তাদের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট তৈরি করা যায়। দিন ও রাতের কোন সময়ে তারা কোন মুডে থাকেন, সেটার ধারণা নিয়ে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট প্রকাশ করা যায়। পাঠক মুখিয়ে থাকেন নতুন কনটেন্টের জন্য। সেই চাহিদা মেটাচ্ছে অনলাইন। এখানে আবার সোনায় সোহাগা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যেটি অনলাইন পত্রিকার কনটেন্ট ছড়াতে যেমন সহায়ক হচ্ছে, তেমনি দখল করছে বিজ্ঞাপনের বাজারও। তাতে করে বিজ্ঞাপন আরও কমে আসছে ম্যাগাজিনগুলোয়।
এখানে একটি তথ্য দিলে মন্দ হয় না। ২০১৬ সালে ভারতের সব ধরনের ম্যাগাজিনের রাজস্ব আয় ছিল ১ হাজার ৪০০ কোটি রুপি। তা কমে হাজার কোটিতে নেমেছে ২০২০ সালে। বর্তমান পরিস্থিতি আরও সঙিন। এক আমেরিকাতেই ২০২৩ সাল থেকে প্রতিবছর ম্যাগাজিনের রাজস্ব কমছে ৫.৭১% হারে। এখন রাজস্ব আয় বাড়াতে সারা বিশ্বে পত্রিকার প্রকাশকেরা বিভিন্ন চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
প্রিন্ট পত্রিকার চাহিদা কমে যাওয়ার আরও কারণ আছে। করোনাকালে নানা ধরনের আপস করতে হয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে। ফলে ম্যাগাজিন পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে অন্তরায়। ছাপার খরচ বেশি বলে সংখ্যা কমানো হয়েছে। জনবল কমাতেও বাধ্য হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে নিউজস্ট্যান্ড উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর, ভারী ম্যাগাজিন বহন করার হ্যাপাও সামলাতে চায় না এই প্রজন্ম। যেহেতু আছে নাগালেই এমন ডিভাইস, সেটি যেন এক প্যান্ডোরার বাক্স। আরও একটি বড় কারণ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন প্রিন্ট ম্যাগাজিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার, সেটি হলো ফাস্ট ফ্যাশনের রমরমা। পাঠকেরাই পরোক্ষে ভোক্তা। তারা এখন অনলাইনে কিনতে চান সবকিছু। কেনেনও। ফলে অনলাইনে জেনে নেন ট্রেন্ড। ম্যাগাজিনের তাই প্রয়োজন পড়ে না।
এসবই অসম্ভব ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে। কারণ, সেটি বের হয়, সপ্তাহে, ১৫ দিনে বা মাসে। বিশেষত বিখ্যাত সব ম্যাগাজিনই মাসিক। এখন এ অনেকটা সময়। পাঠকের অত ধৈর্য নেই। তাদের ঘোড়ায় সব সময়ই জিন দেওয়া থাকে। তারা চান চটজলদি। একেবারেই হাতে গরম। কেবল হাতে গরম হলেই চলবে না; মুখরোচকও হওয়া চাই। ৬ সেকেন্ডের মধ্যে পাঠককে টানতে না পারলে তিনি চলে যাবেন অন্যত্র। এটিই ভার্চুয়াল জগতের ভেলকিবাজি।
এর সঙ্গে আবার জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়ন, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ইত্যাদি নিয়ে নানা কথা উঠছে। এ জন্য বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে পেপারশূন্য প্রক্রিয়ার চল। পরিবেশবান্ধব আর টেকসই পৃথিবীর জন্য কাগজের মৌলিক উপাদান ভালো নয়। প্রিন্ট পত্রিকার জন্য এটিও একটি নেতিবাচক দিক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা আর মূল্যস্ফীতি। ফলে নিত্যদিনের চাহিদা মেটাতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ আর ম্যাগাজিন কেনার বিলাসিতা দেখাতে পারছেন না। বিকল্পকেই গ্রহণ করছেন সাদরে।
আবার ফ্যাশনের কথাই বলি। এটিও তো যাপনের একটি আকর্ষক আর অনিন্দ্য ধারা। সেখানে পরিবর্তনই শেষ কথা। তাই তো বদলে যায় সবকিছু। নকশা বদলায়, চল বদলায়, জেল্লাও বদলায়। এই যে নিয়ত বদলে যাওয়া, তারও তো উপস্থাপন প্রয়োজন। সেটাই-বা হবে কীভাবে, যদি দীর্ঘ ব্যবধানে হয় প্রকাশ মাধ্যমের। তাই তো মুশকিল আসান হয়েছে ডিজিটাল সংস্করণে। সেখানে সবই হাজির। এমনকি চকচকে কভারও। তবে হ্যাঁ, পার্থক্য একটি থাকে; তা হলো, ডিজিটাল মাধ্যমে কেবল দৃষ্টিসুখের আশ মিটবে। কিন্তু ছুঁয়ে দেখার মজা মিলবে না। তাতে কি! এসব নিয়ে হালের পাঠকেরা ডোন্ট মাইন্ড। তাদের এসবে কিছুই যায় আসে না। কারণ, স্মৃতি তাদের কাছে অনাহূত!
তবে এখানে একটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করতেই হয়। ম্যাগাজিন যত মানুষ একসময় কিনেছেন, তার চেয়ে বেশিজন এখন ভার্চুয়ালি দেখছেন। একটা সময় যাদের পক্ষে ম্যাগাজিন কেনা সম্ভব ছিল না, তাদের কাছে সেটাই আজ দেখা অসম্ভব নয়। কোনো বাধা নেই। মুছে গেছে শ্রেণিব্যবধান।
ভার্চুয়াল জগৎটা অবারিত। বন্ধনহীন। এখানে কেবল ছবি নয়; মানসম্মত ভিডিও, অ্যানিমেটেড ফিচার, গ্রাফিকসসহ নানা কিছুই প্রকাশ করা যায়। এই মহাসমুদ্র মন্থনও অনাবিল আনন্দের। হালের পাঠক সেই আনন্দে অবগাহন করেন যখনই মন চায়। তাদের মস্তিষ্ক মজে থাকে। নিজেই কেবল মজাটা উপভোগ করেন না; অন্যের সঙ্গে ভাগ করেও নিতে পারেন। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই; বরং পুরো পৃথিবীটাই তাদের। তারা ভুবনগ্রামের বাসিন্দা। ফলে বন্ধুত্ব হয়ে যায় যেকোনো দেশের যে কারও সঙ্গে। গড়ে ওঠে এক নতুন গাঁটছড়া।
ফলে অন্যান্য ম্যাগাজিনের মতো ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোও নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলেছে এই জগতের সঙ্গে। পরিচিত হয়েছে তাদের নতুন পাঠকদের সঙ্গে। একাত্ম হয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। রূপান্তরকে তারা নিয়েছে ইতিবাচকভাবে। ফ্যাশনের নিয়ত বদলের ধারাকে এগিয়ে নিতে এই রূপান্তর হয়তো তাদের প্রয়োজন ছিল। কিংবা বলা যেতে পারে, এটি সময়ের দাবি। সেই দাবিকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। এ ক্ষেত্রে তারা সফল।
কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের মতো ওল্ড স্কুলারদের মন খারাপ হয়েছে। তারা নস্টালজিক হয়েছেন। তথাপি তারাও রূপান্তরের কেতন ওড়ানো নতুনদের সদর্প উপস্থিতিকে স্বাগত জানিয়েছেন বৈকি! মুগ্ধ হয়েছেন তাদের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর ওয়ে অব লাইফে। কারণ, সময়ই পটবদলের মূল নিয়ামক। তাই তো সময়কে অস্বীকারের জো নেই। বরং নতুন কী নিয়ে হাজির হয়, তা দেখার জন্যই সবার থাকে অধীর আগ্রহ। প্রজন্ম বদল হবে, সময়ই বদল করে দেবে। নতুনেরা তাদের মতো করেই ভাববেন। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উৎকর্ষ হতেই থাকবে। উন্মুক্ত হবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে এগিয়ে যাবে মানুষ। ম্যাগাজিনের এই রূপবদলও সেই পরিবর্তনেরই দৃষ্টান্ত।
স্ক্রিনে আমরা যা দেখি, সেটি এন্ড প্রোডাক্ট। কিন্তু নেপথ্যেও নানা ঘটনা ঘটে চলে। ঠিক যেমন ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে হয়েছে। আমরা ম্যাগাজিনটি হাতে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। নেপথ্যের ঘটনাপ্রবাহ থেকে গেছে অগোচরে। প্রসঙ্গ তা নয়, আবার সেটিও! একটা সময় পর্যন্ত নিউজরুম ছিল কেবল ছাপা পত্রিকার জন্য। সেখানে যোগ হলো ডিজিটাল সংস্করণের জন্য আলাদা বিভাগ। তখন তারা ছিল সংখ্যালঘু। পরিস্থিতি বদলে গেল। এখন ডিজিটালই মুখ্য ভূমিকায়। এখন তো আবার যাকে বলে ইন্টিগ্রেটেড নিউজরুম। মানে কোনো ভাগ নেই। সবকিছু একত্রিত, সমন্বিত। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ডিজিটালদের হাতেই। এটিই পৃথিবীর নিয়ম।
এখানেই শেষ নয়, বদলে গেছে লেখার ধরন। প্রিন্ট আর ডিজিটাল সংস্করণ এক নয়। পাঠকও নয়। ফলে একই লেখা উভয় মাধ্যমে চালানো যাবে না। তাই তো প্রিন্টের জন্য যে লেখা হবে, অনলাইনের জন্য সেটি হবে না। বরং এই লেখা হতে হবে আরও প্রাঞ্জল। আরও রোচক। কুড়মুড়ে আর মুচমুচে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেটি দেওয়া হবে, তার বৈশিষ্ট্যও আলাদা। এভাবেই প্রতিনিয়ত চলছে কনটেন্ট নিয়ে নিরীক্ষা। আগে যেমন নিউজ ছিল, ছিল ফিচার বা রিপোর্ট; এখন হরেদরে সবই কনটেন্ট। কত ধরনের কনটেন্টই যে দেওয়া যায়, তার ইয়ত্তা নেই। অনেক সময় অনেক কিছু চটুল মনে হলেও কিছু করার নেই। পাবলিক ডিমান্ড। মানে ওই—পাঠকের চাহিদা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর কনটেন্টের কথা যখন উঠল আবার, তখন একটু বলে রাখা ভালো, এখানে অনেক ধরনের কনটেন্ট দেওয়ার সুযোগ আছে। সরাসরি বা লাইভ অনুষ্ঠান যেমন করা যায়; তেমনি রিলস, শর্টস ইত্যাদি নানা কিছু দেওয়ার আছে সুযোগ। অন্যদিকে প্রিন্টে এসব কিছুই সম্ভব নয়। প্রিন্টকে আকর্ষক করতে কিউআর কোড চালু হয়েছে। সেখানেও কিন্তু ভিডিওটি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকেই। আবার প্রিন্টের মতো করেই অনেক পাঠক দেখতে চান। সে জন্য আছে ই-পেপার। সেটিও আসলে ডিজিটাল সংস্করণই।
সাধারণভাবে বলা হয়, একটি প্রিন্ট পত্রিকা গড়ে চারজন পড়েন। এবার কোনো পত্রিকা যত বিক্রি হচ্ছে, সেটির চার গুণ হবে পাঠক। এই সংখ্যা আমরা বড়জোর হাজার ছাড়িয়ে লাখে হিসাব করতে পারি। অন্যদিকে ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠকসংখ্যা বেশুমার। সেখানে হিসাব হয় নিযুতে, কোটিতে। এই পরিবর্তনই আসলে বদলে দিয়েছে সাংবাদিকতার ধারণাও। এখানে উল্লেখ করলে মন্দ হয় না, একসময় ফ্যাশন সাংবাদিকতা ছিল কেবলই মেয়েদের জন্য। তা-ও ম্যাস নয়, ক্লাসের জন্য। ধীরে ধীরে সেই প্রাচীর টুটল বটে, তবু থেকে গেল অভিজাতদের আঙিনায়; যেখানে অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফরসা রমণীরা কত রকম আমোদে হাসেন। নানা উৎসবে নানা সাজে সদর্পে হাঁটেন। কারণ, ফ্যাশন তো সাধারণ্যের নয়। বৃত্ত মধ্য বা নিম্ন এখানে ব্রাত্য। অর্থনীতি টিকল ডাউন তত্ত্বের মতো উচ্চ কোটির ক্লিশে হয়ে যাওয়া চল গড়িয়ে গিয়ে নামে নিচের দিকে। এই লক্ষ্মণরেখা চিরকালের জন্য মুছে দিয়েছে ডিজিটাল সংস্করণ। ফ্যাশন এখন সবার। এমনি স্ট্রিট স্টাইল এখন জাতে উঠেছে। প্রেরণা হচ্ছে হাই ফ্যাশনের।
প্রিন্ট ছাপিয়ে অনলাইনের সর্বগ্রাসী যে রূপ আমরা দেখছি, সেটি আমাদের চোখের সামনে ঘটে গেল। বস্তুত উভয় মাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘ সম্পৃক্ততার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সবকিছু যেন ঘটে গেল ভোজবাজির মতো।
এটিই কি শেষ কথা? প্রিন্ট ব্যাকসিটে বটে; কিন্তু এটি কি একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে? ফেরার লক্ষণ কি নেই? এমন অজস্র প্রশ্ন ভিড় করে আসে। বিশেষজ্ঞেরা নানা সমীকরণ বাতলান। মুদ্রার অন্য পিঠ তাই দেখার ইচ্ছা হয় বৈকি।
মুদ্রার অন্য পিঠ
ক্লান্তি শব্দটি সব ভাষার অভিধানেই আছে। ক্লান্তি ইতিবাচক শব্দ নয়। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতির কারণে নেতিবাচক শব্দই আমাদের কাছে ইতিবাচক হয়ে ওঠে। এই যেমন ক্লান্তি। কারণ, দুটো শব্দ এখন বেশ আলোচনায় আছে। ডিজিটাল ফ্যাটিগ। সে আবার কী? কিংবা এই ডিজিটাল ক্লান্তিই-বা কী?
বস্তুত সারাক্ষণ স্ক্রিনে চোখ রেখে মানুষ হাঁপিয়ে উঠছেন। ক্লান্তি বোধ করছেন। একঘেয়েমি পেয়ে বসছে। ইঁদুর দৌড়ে তাল মেলাতে পারছেন না। এটিই ডিজিটাল ফ্যাটিগ। যেটি কিনা কিছুটা হলেও মানুষকে অনলাইনের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলছে। পাঠকদের এই অংশই ফিরতে চাইছে অ্যানালগ দুনিয়ায়। মানে ছাপা পত্রিকার দিকে। অর্থাৎ তারা আবার আগ্রহী হচ্ছে ম্যাগাজিনের প্রতি। ঠিক যেমন বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বাটন ফোনের চাহিদা।
অনলাইনের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ম্যাগাজিন প্রকাশ করে চলেছে। সমান্তরালে অনলাইন সংস্করণ থাকলেও প্রিন্টকে উপেক্ষা করেনি। আবার প্রিন্টের পাঠকদের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন ম্যাগাজিন বাজারেও আসছে। কোনটা কত দিন টিকে থাকছে বা থাকতে পারছে, তা অন্য প্রসঙ্গ। এখানে একটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। ২০২১ সালে আমেরিকায় ১২২টি নতুন পত্রিকা আলোর মুখ দেখে। আমাদের দেশেও কিছু নতুন ম্যাগাজিন গেল কয়েক বছরে প্রকাশিত হয়েছে। এদের সাফল্য হয়তোবা উল্লেখযোগ্য নয়; তবু প্রয়াসকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।
অনলাইনের এই শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় প্রিন্ট পত্রিকার বিক্রি গেল বছরে বেড়েছে ৪.১%। বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক পত্রিকা নতুন করে প্রকাশনা শুরু করেছে। এসব অবশ্যই আশার কথা। কারণ, যত ভাবা হয়েছিল, তত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে না প্রিন্ট ম্যাগাজিন; বরং থাকছে অন্যমাত্রায়, অন্য আঙ্গিকে।
কেন বাড়ছে প্রিন্টের কদর? কেবল একঘেয়েমি বা ক্লান্তি নয়, বরং প্রোডাকশনের পার্থক্য। অনলাইনে থাকে হুড়োহুড়ি। প্রিন্টে থাকে ধীরেসুস্থে যত্ন নিয়ে কিছু করার তাগিদ। এটিই পার্থক্য গড়ে দেয়। এর ছবি, উপস্থাপনা, সজ্জায় মেলে নান্দনিকতা; যা কোনোভাবেই স্ক্রিনে দেখানো বা রেপলিকেট করা সম্ভব নয়।
প্রিন্ট ম্যাগাজিনকে টিকিয়ে রাখতে প্রকাশকেরা আবার কৌশলীও হচ্ছেন। নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে না করে, লম্বা বিরতি দিয়ে প্রকাশ করছেন। তা হতে পারে বছরে দুটি বা তিনটি সংখ্যা। এ ক্ষেত্রে মানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে; সংখ্যাকে নয়। প্রযুক্তির উন্নতি এখানে কাজে লাগিয়ে মুদ্রণকে ব্যয়সাশ্রয়ী করা হচ্ছে।
জনপ্রিয় ফ্যাশন ম্যাগাজিন এল-এর অস্ট্রেলীয় সংস্করণ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়েছিল। সেখানে হার্ড কপি ম্যাগাজিনের নতুন করে সৃষ্টি হওয়া চাহিদার কারণে আবারও মুদ্রণে ফিরেছে। এ বছরের মার্চে বেরিয়েছে একটি সংখ্যা। সেপ্টেম্বরে বের হবে আরও একটি। আগামী বছর থেকে চারটি সংখ্যা বের হবে প্রতি তিন মাস পর; যাকে বলে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’!
অন্যদিকে মানের উন্নয়ন উসকে দিচ্ছে সংগ্রাহকের আগ্রহ। এটি পড়ার পর ফেলে দেওয়ার বিষয় আর তাই থাকছে না; বরং ম্যাগাজিন পরিণত হচ্ছে কালেকটর’স আইটেমে। ম্যাগাজিন এখন আর সস্তা সামগ্রী নয়। বিলাসী পণ্য।
কেবল ম্যাগাজিন যে বন্ধ হয়েছে তা নয়, অনেক জনপ্রিয় সাইটও বন্ধ হয়েছে। এর কারণ ওই ইঁদুর দৌড়। ব্যয় সাশ্রয় করে প্রতিদিন ট্রাফিক বাড়ানো। যা সব সময় সম্ভব হয় না।
সুখের কথা, বিজ্ঞাপনদাতারা নতুন করে সদয় হয়েছে প্রিন্ট ম্যাগাজিনের প্রতি। কিছু কিছু বিজ্ঞাপন ফিরতে শুরু করেছে। কারণ, গবেষণা বলছে, প্রিন্ট ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন পাঠক খেয়াল করে দেখেন। অনলাইনে সেটি হয় না। এড়িয়ে যান। উপরন্তু অনলাইনের কনটেন্টে পাঠক ভরসা পান না, যতটা পান প্রিন্টের কনটেন্টে। এই বার্তা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে পৌঁছেছে। ফলে তাদেরও সুমতি হয়েছে। এটিই প্রমাণ করে, প্রিন্ট ইজ প্রুফ।
আগেই উল্লেখ করেছি, ম্যাগাজিন প্রকাশনাশিল্প বর্তমানে ভয়ংকর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কোনো সন্দেহ নেই ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও যাচ্ছে। ফলে নতুন পন্থা অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই। সেটিই কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান করছে। আকারে বড় এবং উচ্চ মানসম্পন্ন বিশেষায়িত সংখ্যা তারা বের করে পাঠক আকৃষ্টের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে একেবারে লাভ হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। বরং বাজার পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট বলছে, এই প্রয়াস সাফল্যকে ত্বরান্বিত করছে। ধীরে হলেও।
ডিজিটাল বিপ্লব নিঃসন্দেহে সামগ্রিকভাবে প্রকাশনাশিল্পকে প্রভাবিত করেছে। সেই প্রভাব অবশ্যই ইতিবাচক নয়; তবু প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলো তাদের জায়গা ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো কাজে লাগানোর মাধ্যমে, প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলোর কেবল টিকে থাকাই নয়, ভবিষ্যতেও আরও উন্নতির সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখেছে।
এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলোকে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া চাই। পাশাপাশি ডিজিটাল সুবিধা এবং প্রযুক্তির সব ধরনের উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে সাফল্য আসবে—ধারণা বিশেষজ্ঞদের। এই যেমন দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে, অনেক প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এমনকি হার্ড কপির পাশাপাশি হার্ড কপির ডিজিটাল সংস্করণও বিক্রি করছে। এই হাইব্রিড পদ্ধতির মাধ্যমে তারা আরও বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে এবং তাদের চাহিদা পূরণেও সক্ষম হচ্ছে। কারণ, তারা ম্যাগাজিন পড়তে চান; কিন্তু হয় তাদের হার্ড কপি কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই অথবা তা চান না। তাদের জন্য এই ব্যবস্থা কার্যকর ও সময়োপযোগী হয়েছে। অধিকন্তু, প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলো পাঠকদের সঙ্গে নতুন এবং কার্যকর উপায়ে সম্পৃক্ত করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবিধা নিচ্ছে। এই দৃষ্টান্ত অন্যরাও অনুসরণ করতে পারে; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশের প্রকাশনাগুলো তো বটেই। মূলকথা হলো, পাঠককে নতুন এবং এক্সাইটিং অভিজ্ঞতা দিতে হবে। তবেই তিনি থাকবেন। না হলে চলে যাবেন।
আরও একটি বিষয়, প্রযুক্তি ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে প্রিন্ট ম্যাগাজিনগুলো ঐতিহ্যগত প্রকাশনা এবং ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবধান ঘোচাতে পারে। তাহলে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও জোরালো হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকাশকদের আরেকটু কৌশলী হতে হবে পাঠকদের বয়স বিবেচনায়। কারণ, বয়সীরা তাদের অবস্থানে থাকতে চান। তারা নতুন প্রজন্মের চাহিদা কিংবা ধারার সঙ্গে সব সময় একাত্ম বোধ না-ও করতে পারেন। ফলে তারা ছাপা পত্রিকার পক্ষে থাকবেন, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রয়াস একেবারেই অনুপস্থিত। এখানে বলতে গেলে দিশাহীনভাবে সবকিছু চলছে! তাতে করে সম্ভাবনা হচ্ছে তিরোহিত।
অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যাগাজিন মিডিয়ার মতে, এখনো টিকে থাকা পত্রিকার সংখ্যা ফেলনা নয়। সারা বিশ্বে বর্তমানে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে অন্তত ৭ হাজার পত্রিকা। এটিই প্রমাণ করে, ডিজিটাল প্রলয় সত্ত্বেও পাঠক এখনো ছাপা ম্যাগাজিন পছন্দ করেন।
এই বাস্তবতার নিরিখে অন্য বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার জো নেই। কারণ, প্রিন্টের অবস্থা যেমনই হোক, আগের অবস্থায় ফেরা হয়তো আর কোনো দিনই সম্ভব নয়। বিজ্ঞাপনের সংখ্যা হয়তো বাড়বে; কিন্তু সেটি কোনোভাবেই তুলনীয় হবে না সেই ফেলে আসা সোনালি দিনের সঙ্গে। তবে হ্যাঁ, একটি নির্দিষ্ট চাহিদা এবং পাঠক আগ্রহ অবশ্যই থাকবে। কারণ, এর ঝকঝকে ছাপা, আকর্ষণীয় ছবি, নান্দনিক সজ্জাই ম্যাগাজিনকে টিকিয়ে রাখবে। এ ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই এগিয়ে থাকবে ফ্যাশন ম্যাগাজিন। ফ্যাশন তো বটেই, যেকোনো ছাপা ম্যাগাজিনের জন্য এটিই আশার কথা। অন্যদিকে, এটিই বলতে গেলে দৈনিক পত্রিকার জন্য এক সুদূরপরাহত স্বপ্ন।
একজন ম্যাগাজিন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য দিয়েই শেষ করা যাক, ‘যে কারণে সেই ১৭২০ সালে পাঠকের কাছে ম্যাগাজিন আবেদন ছড়িয়েছিল, একই কারণে ১৯২০ বা ২০২০ সালেও ম্যাগাজিন পাঠক আদৃত হয়েছে। সেই কারণ হলো: প্রথাবিরোধিতা ও আধিপত্য, অভিনবত্ব ও ধারাবাহিকতা, বিপণনযোগ্যতা ও সৃজনশীলতা, সামাজিক সংযোগ ও স্বকীয় অনুরণনের মিশেল।’

মডেল: মৃদুলা ও ফাবলিহা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ক্যানভাস
স্টাইলিং ও ফ্যাশন ডিরেকশন: নুজহাত খান
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top