skip to Main Content

ফিচার I মেইড উইদ ফেইক লাভ

হাতে বানানো নয়, তবু হ্যান্ডমেইডের তকমা। রাসায়নিকের যাচ্ছেতাই ব্যবহার অথচ ন্যাচারাল ডাইয়ের ট্যাগ। মানহীন পণ্য বিক্রি করে ক্র্যাফটওয়াশিংয়ের বাজার রমরমা। হরহামেশা ঠকাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতারণার চূড়ান্তই বটে

বড় তাড়াহুড়ো সবার। ধৈর্য নেই। কিন্তু লাভ চাই শতভাগ। ফলাফল—অসততা। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বস্ত্রশিল্পও ব্যতিক্রম নয়। এখানেও অসৎ দানবের হানা। তথ্য লুকিয়ে অথবা বিকৃত করে পণ্য বিক্রির চেষ্টা। পুস্তকীয় নাম যার ক্র্যাফটওয়াশিং। খটমট শব্দটির এ-ই সহজ ব্যাখ্যা? সৃজনশীলতার প্রতি মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে চলে এই ব্যবসা। সাধারণকে অসাধারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিক্রি হয় চড়া মূল্যে।
২০২১ সালে ক্র্যাফটওয়াশিং শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয় বিশ্ব। ক্র্যাফট প্র্যাকটিশনার মিতা মাস্তানির মাধ্যমে। সেই সময়ের বহুল সমালোচিত সাঙ্গানেরি প্রিন্ট পুনরুৎপাদন বিতর্কের সময়ে এই শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন তিনি।
বাজারের কলেবর
বিপুল জনসংখ্যা, মানুষের জীবনযাপনে নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ, ক্রয়ক্ষমতার উন্নতিসহ নানা কারণে এর চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সামাল দিতে গিয়ে নিত্যনতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ক্র্যাফটওয়াশিংকে কৌশল বলা যাছে না। বলতে হচ্ছে অপকৌশল। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় যা কিছু তৈরি করা হচ্ছে, কোনোটারই নিজস্বতা নেই; বরং অনুকরণের চূড়ান্ত।
সৃষ্টিসুখের উল্লাস
হাতে তৈরি যেকোনো কিছুকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর কারণ, সেখানে সৃষ্টিশীলতাই মূলমন্ত্র। হাতের সাহায্যে বয়ন সম্পন্ন করে যখন একটি শাড়ি তৈরি করা হয়, তখন নিদেনপক্ষে তিন দিন একাগ্রচিত্তে কাজ করতে হয় একজন তাঁতিকে। নকশাভেদে ৬ মাসও প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু এই বারো হাত লম্বা শাড়ি যখন কারখানায় তৈরি হয়, তখন এই একই টাইমফ্রেমে উৎপাদন বাড়ে কয়েক গুণ। শঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, প্রযুক্তির প্রজ্ঞা এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে হস্ততাঁতের মতো বুনন তৈরিতে সক্ষম মেশিন মিলছে বাজারে। সাধারণ ক্রেতার পক্ষে খালি চোখে এই পার্থক্য ধরতে পারা বেশ কষ্টসাধ্য। লাভের পাল্লা ভারী করতে গিয়ে একদল ব্যবসায়ী ভুলে যাচ্ছেন, উদ্ভাবনশীলতা একটি সম্পদ। আধুনিকতার প্রভাব খাটিয়ে এই সম্পদের অনিষ্ট করা একধরনের অপরাধ। কারণ, একজন তাঁতশিল্পীর নান্দনিকতা রপ্ত করতে প্রয়োজন হয়েছে অধ্যবসায়ের। চেষ্টা, বুদ্ধি, ধৈর্য, সময় আর শৈল্পিক ভাবনা—সব মিলিয়ে ছন্দে ছন্দে বুননকৌশল শিখেছেন তিনি; যা তার বংশপরম্পরার ঐতিহ্য। যার মূল্য হাতের আঙুল গুনে হিসাব করলেই দায় শেষ হয় না। সেখানে মেধার মূল্য প্রাপ্য।
প্রকারান্তরে প্রতারণা
প্রাকৃতিকের অন্তরালে রাসায়নিক
প্রাকৃতিক রং ব্যবহারে রাঙানো পোশাক ক্রেতা সমাদর পাওয়ার পেছনে সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি প্রবর্তনাও একটি বিশেষ কারণ। আমাদের দেশে ন্যাচারাল ডাই উপজীব্য করে গড়ে ওঠা ফ্যাশন লেবেলের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও বুঝদার ক্রেতারা গুটি কয়েক ব্র্যান্ডকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন। এর পেছনের গূঢ় রহস্য খুঁজতে গিয়ে নতুন এক দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যেতেই পারে। রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সেখানে। প্রাকৃতিক রঙের ছিটেফোঁটাও নেই। অথচ দেদার রাঙানো হচ্ছে ফ্যাব্রিক। একের পর এক ব্র্যান্ড দাবি তুলছে, তারা কাজ করছে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে। টেকসই তত্ত্বের চরম অবমাননা ঘটছে। সেই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার খর্ব হচ্ছে। ভুল তথ্যে চলছে প্রতারণা।
ছাপে ছলনা
ছাপচিত্র একটি ঐতিহ্যবাহী অলংকরণ কৌশল। মনের মাধুরী মিশিয়ে শিল্পী পোশাক চিত্রণ করেন এই উপায়ে। তাই এই প্রক্রিয়ায় সৃজনশীলতার প্রকাশে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন পড়ে। উৎপাদন তাই ধীরে সম্পন্ন হয়। স্ক্রিনপ্রিন্ট আধুনিক মেশিন নির্ভরশীল প্রক্রিয়া। যার অলংকরণের সঙ্গে ব্লকপ্রিন্টের বেশ মিল আছে। অনেক সময় বেশি পণ্য কম সময়ে তৈরির আগ্রহে ব্লকপ্রিন্টের স্থানে স্ক্রিনপ্রিন্টকে প্রতিস্থাপিত হতে দেখা যায়। ক্রেতা অলংকরণের ব্যাকরণে সব সময় পারদর্শী হবেন এমন কোনো কথা নেই। যাচাই-বাছাইয়ের প্রশ্নও এখানে নেই। কারণ, লাভের পাল্লা ভারী করতে গিয়ে এ ধরনের পদস্খলন অপরাধ।
হাতের জায়গায় যন্ত্র
হস্ততাঁত সম্পূর্ণভাবে তাঁতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। দুহাতের সাহায্যে তাঁত ব্যবহার করে টানাপোড়েনের কাব্যে তৈরি করা হয় কাপড়। হ্যান্ড ক্রাফটেড ফ্যাব্রিক হিসেবে যার সমাদর আরাম ও নিপুণতার জন্য। পাওয়ারলুমের আবিষ্কার যুগান্তকারী বলেই বিবেচিত। অথচ পাওয়ারলুম ব্যবহার করে বোনা শাড়িও বিক্রি করা হচ্ছে হ্যান্ডলুম শাড়ির ট্যাগে। তথ্য লুকানোর মাধ্যমে হস্ততাঁত অধ্যায়ের সমাপ্তি কোনোভাবেই সৎ কর্ম নয়। এখানে ক্রেতা যেমন ঠকছেন, তেমনি পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছেন হস্ততাঁতশিল্পীরা।
রাজশাহী র সিল্ক নাকি মসলিন
২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মসলিনের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে মসলিন পুনরুদ্ধার প্রকল্প চালু করে। যেখানে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে মসলিন শাড়ি তৈরি করেছে বিশেষজ্ঞ দল। একেকটি শাড়ি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে তিন লাখ ষাট হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়নি এই শাড়ি। অথচ দেশীয় নামিদামি ক্লদিং ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্যের বিজ্ঞাপনে মসলিন পণ্য বিক্রির তথ্য দিয়ে চলেছেন; যা ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণার বড় উদাহরণ।
জিআই অনুবৃত্তি
বাংলাদেশ অধ্যায়
সৃজনশীল কাজ একসময় জন্মস্থানের নামে পরিচিত হতো। বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা যায়। ঢাকার আশপাশের অঞ্চলে মসলিন আর জামদানি, টাঙ্গাইল তাঁত খোদ টাঙ্গাইলে, রাজশাহী সিল্ক রাজশাহীতে। এলাকাভিত্তিক একটি অলিখিত গ্রন্থস্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্য ভয়েজ অব ফ্যাশনের দেওয়া তথ্যমতে পঞ্চাশ বছর ধরে এই বিষয়ে পরিবর্তন দেখা গেছে। অঞ্চলভিত্তিক কাজের নিজস্বতাবোধ হারাচ্ছে। অঞ্চলভেদে আনকোরা বয়ন তার অনন্যতা হারাচ্ছে, যা নির্ভেজাল স্বত্বকে ধ্বংস করছে। এই অপশক্তি আমাদের দেশের জামদানিকেও ছুঁয়ে গেছে।
জিআই, অর্থাৎ জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন ক্র্যাফটওয়াশিংয়ের মতো অপরাধ নির্মূলে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক নিজস্বতার প্রামাণিক প্রয়োজনে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন জিআই ট্যাগ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ৪৯৪টি পণ্যের জিআই ট্যাগ অর্জন করেছে। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে উপেক্ষা করার উদাহরণ পাওয়া যায় জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়িসহ আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মেধাস্বত্ব নিয়ে করতে হচ্ছে লড়াই! ক্র্যাফটওয়াশিংয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ এখানেই। একটি সৃষ্টির মূল প্রক্রিয়া, সংস্কৃতি আর তাৎপর্যকে অবমাননা অপরাধ নয় কি?
আন্তর্জাতিক অধ্যায়
আন্তর্জাতিক বাজারের হ্যান্ডক্র্যাফটের গুরুত্ব ও চাহিদা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে। যার ভয়াবহতা শিল্পীসত্তাকে আঘাত করছে। ভারতের উত্তর-পশ্চিমের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বিশেষজ্ঞ ডিজাইনার মদন মীনা দাবি করেন, তার দেশের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ফ্যাবইন্ডিয়া ঐতিহ্যবাহী কৌশল আজরাখের কথা বলে ব্লক প্রিন্টেড পণ্য বিক্রি করছে। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে ফ্যাবইন্ডিয়ার পোস্টে এ বিষয়ে মন্তব্য করেন। আজরাখ এবং ছাপচিত্র—দুই-ই ভারতের ঐতিহ্যবাহী ক্র্যাফটিং টেকনিক। কিন্তু একটি অন্যটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ফ্যাবইন্ডিয়া মদন মীনার মন্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। পরবর্তী সময়ে ভুল স্বীকার করে একটি বিশেষ বার্তা দেয়। একই সঙ্গে ব্র্যান্ডটি সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে তাদের পণ্যের বিস্তারিত বর্ণনা থেকে ভুল তথ্য সরিয়ে পুনরায় সম্পাদনা করে। এখানেই শেষ হতে পারত সত্য-অসত্যের গল্প। কিন্তু আরেকটি নতুন কাহিনি জনসমক্ষে আসে সংক্ষিপ্ত বিরতিতে। মেটাল ক্র্যাফটিংয়ের শিল্পী অমরনাথ শেটকার সেই গল্পের রূপকার। ভারতের কর্ণাটকের জিআই প্রাপ্ত শিল্প বিদরিওয়্যার একটি বিখ্যাত ধাতুশিল্প। ১ হাজার ৪০০ বছর ধরে এই শিল্প বিকশিত হয়েছে এই অঞ্চলে। এখানকার মাটি শিল্পটির অন্যতম মূল উপকরণ। বিদারের কালো মাটিই যাকে অনন্য করেছে। সরাসরি নামও রাখা হয়েছে এলাকাটিকে গুরুত্ব দিয়ে। অমরনাথ অভিযোগ করেন, ফ্যাবইন্ডিয়া বিদরিওয়্যারের নামে ফয়েল ও প্রিন্টিংকে ব্যবহার করে অলংকৃত দেয়ালসজ্জার প্লেট বিক্রি করছে। বিদরিওয়্যারের ট্যাগে অন্য কিছু বিক্রি করা মানে তথ্য লুকানো; যা অসৎ পন্থা হিসেবে পরিগণিত হয়।
ভারতের রাজস্তানের ঐতিহ্য সাঙ্গানেরি ছাপচিত্র। ২০২১ সালে সে দেশের জনপ্রিয় ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জি এবং রিটেইল ব্র্যান্ড এইচ অ্যান্ড এম মিলে ফাস্ট ফ্যাশনের পণ্য তৈরির জন্য সাঙ্গানেরির ব্লক ফ্যাব্রিক পুনরায় তৈরি করে। ২০১০ সালে জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত এই শিল্পের পক্ষে তখন জোর দাবি তোলেন শিল্পসচেতনেরা। ক্র্যাফটওয়াশিংয়ের অভিযোগ রয়েছে নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার ঋতু কুমার, অনিতা ডোংরের বিরুদ্ধেও।
শেষ সুন্দর
ক্র্যাফটওয়াশিংয়ের বিরুদ্ধাচরণের মূল লক্ষ্য প্রযুক্তির বিপরীতে অবস্থান নয়। নকশা ও প্রক্রিয়া—উভয় ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। উৎপাদক, খুচরা বিক্রেতা, ভোক্তা—সবার জন্যই যথাযথ তথ্য জরুরি। তাতে মূল্য নির্ধারণ, শিল্প সংরক্ষণ এবং ঐতিহ্যের গর্ব—এই তিনই সরলরেখায় অবস্থানের সুযোগ পাবে। আমাদের দেশে তথ্য লুকিয়ে পণ্য বিক্রয়ের চেষ্টা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, মিথ্যা বিজ্ঞাপনে প্রতারণা, নকল পণ্য প্রস্তুতের অভিযোগে ক্রেতা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। এই আইনের ৪৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

 সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top