সঙ্গানুষঙ্গ I স্মৃতিসূচক
কিপসেক জুয়েলারি। নস্টালজিয়ার মূর্ত উপস্থাপন। স্মৃতি আর অনুভূতির সৃজনশীল মেলবন্ধন
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দর্শকরা নিশ্চয়ই এমন দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত, যেখানে নায়ক অথবা নায়িকা তার কিশোরবেলার প্রেমকে খুঁজে পেয়েছে গলার চেইনের লকেটের মাঝে। এমন হারিয়ে ফিরে পাওয়ার গল্প বান্ধবী, ভাই-বোন এমনকি বাবা-মাকে ঘিরেও তৈরি হয়েছে। এখানে গয়না শুধু একটি অনুষঙ্গ নয়, গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। স্মৃতিময় কোনো কিছু ধরে রাখাই এর মূল উদ্দেশ্য। যার পরিকল্পনার মূলে থাকে অর্থপূর্ণ ভাবনা।
মানুষ বরাবরই স্মৃতিকাতর। তাই তো রঙিন কাগজে মুড়িয়ে রাখা সময়গুলো একে একে টাইম ট্রাভেল করে নিয়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোতে। কিপসেক জুয়েলারি সেই সোনালি অতীতের অংশ।
এগুলো কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা জানা যায় সাইকোথেরাপিস্ট এলোইজ স্ক্যানার বক্তব্যে। তিনি মনে করেন, কিপসেক জুয়েলারি মানুষের বিভিন্ন সময়কে এক সুতোয় বেঁধে রাখে। একত্র করে বিভিন্ন ক্ষণকে। অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যৎ মিলেমিশে যায়; যা একজন মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। ছোট ছোট সুখানুভূতি, প্রিয় মানুষ, প্রিয় সময়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। গল্প ঘিরে গয়না তৈরি হয়। তাই তা অমূল্য।
অলংকরণের অন্তরে
কিপসেক জুয়েলারি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর নকশা নির্ভর করে স্মৃতি সংরক্ষণ পরিকল্পনার ওপর। লকেট, ব্রেসলেট, ফিঙ্গার রিং, কানের দুল তৈরি করা যেতে পারে। তবে সাধারণ গয়নার সঙ্গে এগুলোর বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। এর গঠনগত নকশায় একটি নির্ধারিত জায়গা রেখে দেওয়া হয় সব সময়। স্মৃতিবিজড়িত কোনো ছবি কিংবা বস্তু আগলে রাখার জন্য। প্রিন্টেড ছবি, এক টুকরো কাপড়, প্রিয়জনের এক গাছি চুল, পাথরের টুকরো, নুড়ি, গাছের শুকনো পাতার মতো অনেক কিছু হতে পারে কিপসেক জুয়েলারির মূল উপজীব্য। আবার গয়নায় প্রিয়জনের নাম, তারিখ, সময় কিংবা স্বাক্ষর খোদাই করে নেওয়ার মাধ্যমেও হতে পারে জুয়েলারির নকশা। এ তো জানা কথা। কিন্তু এর বিচিত্র সাতকাহনও আছে। শেষ চিহ্ন, মাতৃদুগ্ধ, আঙুলের ছাপও সংরক্ষিত হতে দেখা যায় কিপসেক জুয়েলারিতে।
বার্থস্টোন জুয়েলারি
জহুরির কাছে নিয়মিত হাজিরা দেন এমন মানুষের জন্য বার্থস্টোন ব্যবহারে তৈরি জুয়েলারি হতে পারে জুতসই কিপসেক। জন্মমাসের সঙ্গে কোন পাথর মানানসই, তা জেনে নিয়ে বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে আংটি অথবা লকেট।
ফ্যামিলি ট্রি জুয়েলারি
পরিবারের প্রতি ভালোবাসা থেকে তৈরি। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয় একেকটি স্টোন। সামর্থ্যে থাকলে ফ্যামিলি ট্রি জুয়েলারিতে বার্থস্টোনও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্রেস্টমিল্ক জুয়েলারি
প্রত্যেক মায়ের ব্রেস্টফিডিং জার্নি ভিন্ন। জীবনের সম্পূর্ণ নতুন এই অভিজ্ঞতাকে তারা বরণ করে নেন সন্তানকে ভালোবেসে। একসময় শেষ হয় সেই যাত্রা। তবু এই অনন্য যাত্রাকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেওয়া যেতে পারে কিপসেক জুয়েলারি করে। ব্রেস্টমিল্ককে পাথরে রূপান্তর করে গয়নায় ব্যবহার করা হয়। জুয়েলারি ব্র্যান্ড প্রিজারভেশন ক্রিয়েশন, টিফানি, মার্কি বেবি নামের প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিশেষ গয়নাগুলো তৈরি করতে পারে।
মুনডাস্ট জুয়েলারি
মায়ের কাছে সন্তানের সবকিছুই অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমবার মাথা মুণ্ডনের সময়ের চুলও তেমনই। মিঠে এই স্মৃতি ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছা থেকে তৈরি করা যেতে পারে কিপসেক জুয়েলারি। এটিই মুনডাস্ট জুয়েলারি।
গ্রিফ জুয়েলারি
কাউকে হারিয়ে ফেলার পরে তার চলে যাওয়ার শূন্যতায় মানিয়ে নিতে কষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রিয়জন না থাকার শূন্যতাকে সঙ্গে ধারণ করে এমন অবস্থায় মিলতে পারে স্বস্তি। সেই ভাবনা থেকেই গ্রিফ জুয়েলারি তৈরি হয়। হেয়ার লকেট, অ্যাঞ্জেল পেনডেন্ট, ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেনডেন্ট, ক্রিমেশন, প্রিয়জনের বার্থস্টোন, হ্যান্ডরাইটেড ব্রেসলেট ব্যবহার করা হয় এ জুয়েলারি হিসেবে।
মোরস কোড জুয়েলারি
সংখ্যা অথবা অক্ষরকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করার জন্য মোরস কোড ব্যবহারের চল রয়েছে। এই কোড ব্যবহারেও হারিয়ে যাওয়া মানুষটির স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে। ব্রেসলেট অথবা নেকলেসে বিন্যাস করা যেতে পারে সংখ্যা অথবা অক্ষরের মোরস কোড।
লক অব হেয়ার জুয়েলারি
প্রিয়জনের চুল ব্যবহার করে কোনো নির্দিষ্ট অক্ষর অথবা সুন্দর কোনো নকশা ফুটিয়ে এসব জুয়েলারি তৈরি হয়। কানের দুল, লকেট কিংবা আংটিতে এ পদ্ধতিতে রেখে দেওয়া যেতে পারে প্রিয় কারও চুল।
পেট ফার জুয়েলারি
প্রিয় পোষা প্রাণীর জন্য মায়া নানাভাবে প্রকাশিত হয়। নিজের পরিবারের একজন হিসেবে বড় করে তোলেন অনেকে। অনেকের দুঃখ-সুখের সাথিও হয় এই পোষা প্রাণী। তার না থাকাও প্রচণ্ড ভোগাতে পারে। স্মৃতি হিসেবে গায়ের এক গাছি পশম কিংবা পালক হতে পারে কিপসেক জুয়েলারি তৈরির প্রিয় অনুষঙ্গ।
ডগ ট্যাগ জুয়েলারি
পোষা কুকুরের প্রতি ভালোবাসা থেকে ডগ ট্যাগ তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে অল্প কয়েকটি লাইনে লেখা থাকবে নাম, বয়সসহ টুকিটাকি তথ্য।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট জুয়েলারি
হাতের ছাপ অনন্য। আনকোরা। খুব নিজের। এই নিজস্ব চিহ্নকে গয়নার নকশায় চিত্রণ করা যেতে পারে। আংটি, লকেট—নকশা করা যেতে পারে এভাবে। আংটিবদলের সময় প্রিয়জনের হাতে পরিয়ে দেওয়া যেতে পারে আঙুলের ছাপসংবলিত একটি আংটি। একসময় আঙুলের ছাপ ছিল স্বাক্ষরের বিকল্প। এই ভাবনা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট-সংবলিত ফিঙ্গার রিং অতি গুরুত্বপূর্ণ।
হ্যান্ডরিটেন জুয়েলারি
লিখিত কোনো বাক্য ব্যবহারে তৈরি করা হয় এগুলো। সরাসরি ধাতু ব্যবহারেও বাক্যটি তৈরি করা যেতে পারে। আবার মিনিয়েচার তৈরি করে লকেটেও ব্যবহার করা যায়। গয়নার নকশায় ফুটে উঠতে পারে প্রিয় কবিতার কোনো লাইন অথবা পছন্দের কোনো উক্তির হাতে লিখিত রূপ।
কিপসেক জুয়েলারি মনে রাখার জন্য তৈরি করা হয়। আবার কেউ যখন নিজের ভাবনা থেকে তৈরি কিপসেক তুলে দেন অন্য কারও হাতে, তখনো তার পেছনে থাকে মনে রাখার আবেদন। স্বপ্ন, সুখ, পাওয়া কিংবা হারিয়ে ফেলার ক্ষণকে আঁকড়ে ধরে রাখার বাসনার তীব্রতা প্রকাশিত হয় অলংকারের ছোট্ট নকশায়। প্রিয়কে আরও প্রিয় করে রাখার আকাঙ্ক্ষায় এমন সব গয়না তাই অমূল্য।
সারাহ্ দীনা
ছবি: সংগ্রহ