মনোযতন I ঋতুর সঙ্গে মনের দ্বন্দ্ব
সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার (এসএডি)। ঋতুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসা মনোব্যাধি। জানা যাক কাটানোর উপায়
প্রকৃতিতে শরৎ এসেই তাড়িয়ে দিয়েছে বর্ষা রানিকে। আকাশকে সাজিয়েছে নতুন করে। ঝকঝকে কাচের মতো স্বচ্ছ নীলাকাশ আর তার মধ্যে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘমালা ছড়িয়ে শরৎ ঢুকে পড়েছে ফেসবুক ওয়ালে। যারা প্রকৃতিবাজ, যারা প্রকৃতির ডাক শোনেন, তারা ঋতু পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে থাকেন। একটা ঋতুকে বিদায় জানানোর আগেই নতুন ঋতুকে বরণ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এমন দু-একটা পাগলা বন্ধু যদি ফেসবুকে থাকে, তাহলে পিসি কিংবা সেলফোনেই ধরা যায় ঋতুর রং! যেই রং উতলা করে তোলে আপনাকে। ঠিক জীবনানন্দ দাশের মতো। রূপসী বাংলার এই কবি শরৎকে ভাবনায় নিয়ে ঘুরেছেন দিনের পর দিন। শরতের রূপে পাগল হয়েছেন। কতটা? ঠিক যতটা পাগল হয়েছেন প্রিয়তমাকে দেখে। চোখ বন্ধ করেই প্রিয়তমার মুখের ক্যানভাসে শরৎকে খুঁজে পেতেন। দুজনের চাল-চলন, পরিবর্তন একই! তাই শরতের চরিত্রের কাছে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছেন প্রিয়তমাকে। ওদিকে কাজী নজরুল ইসলামও শরতে উতলা হয়ে হারানো প্রিয়াকে বারবার অনুভব করেছেন। লিখেছেন—‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ওই/ এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই…।’
কাশফুলের ব্যাকরণ ও এসএডি
শরৎ আকাশের মেঘও যেন কাশফুল হয়ে যায়। যাদের বেড়ে ওঠা নদীপারে, যাদের যোগাযোগ নদীর সঙ্গে, তারা ভালোই জানেন কাশফুলের ব্যাকরণ। এ যে শরতের বড় আকর্ষণ! নদীতীরে কাশফুলের রাজত্ব। বর্ষার উসকানি পাওয়া কাশফুল শরৎ এলেই ডাগর হয়ে ওঠে! মেলে ধরে রূপ-যৌবন। এই কাশফুলেরও বেশ ক্ষমতা। একেবারে জোছনা রাতের মতো। কেউ জোছনার ডাক শোনেন; কেউ সাগরের, কেউবা পাহাড়ের। নদীর বুকে বেড়ে ওঠেন যারা, তারা শরৎ এলে কাশফুলের আয় আয় ডাক শোনেন। শরতে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না ঘরে, শহরে। ছুটে যান কাশবনে। ছুটে যান নদীপাড়ে। গুগলে খুব দেখেছেন কাশফুল? এই শরতে নদীপাড়ের বন্ধুটির বুকে মনের স্টেথোস্কোপ রাখুন। কাশফুলের জন্য তার উথাল-পাতাল বুকের কল-কল ধ্বনি শুনতে পাবেন। তারপর তার হাত ধরে ছুটে গিয়ে দাওয়াইটা নিতেই পারেন নদীপাড় থেকে, কাশবন থেকে।
নির্মল আনন্দ, অনাবিল উচ্ছ্বাস, রঙের খেলায় অপূর্ব মায়াবী রঙিন ভুবন সাজায় শরৎ। এ ঋতু শুভ্রতার প্রতীক। শরতে প্রাণ সজীব হয়; হেসে ওঠে গ্রামবাংলা। আহ্লাদে মেতে ওঠে বিস্তৃত দিগন্ত। কণ্ঠে শেফালি ফুলের মালা দোলানো শরৎসন্ধ্যায় খালি পা ডুবিয়ে দিন সবুজ ঘাসে। শীতের আনাগোনা টের পাওয়া যাবে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আলপথ মাড়ালে ঘাসের ডগায় মুক্তো দানার দেখা পেয়ে যেতে পারেন। তবে এ সময়টায় মনের আলপথ কতটা মাড়াতে পারেন আপনি? শুভ্রতা ছাপিয়ে আপনার মনে কালো দাগ ফেলে দেয় না তো শরৎ! বলবেন, শরতের সঙ্গে মনের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিসে? বলি, শরীরে যেমন অসুখ হয়, তেমন ঋতু পরিবর্তনের হাত ধরে এই শরৎ দিনে অসুখ বাঁধতে পারে মনেও। ঋতুভিত্তিক এই মানসিক অসুস্থতাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার বা এসএডি। মৌসুমি এই বিষণ্নতার ব্যাধি বছরের নির্দিষ্ট ঋতুতে দেখা দেয় মনে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরৎ বা শীতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই রোগ আবার ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভালোর দিক যেতে থাকে। একে শীতকালীন বিষণ্নতা বা উইন্টার ব্লুজও বলা হয়। শীতের সময় প্রবীণ বা বৃদ্ধদের এই সমস্যা বেশি হতে পারে!
যারা থাকেন বিপৎসীমায়
ঋতুকালীন এই বিষণ্নতা ব্যাধি যে কারও মনে বাসা বাঁধতে পারে। তবে বিপৎসীমায় থাকেন তারা, যারা যৌবনে পা দিতে যাচ্ছেন। মানে যৌবনের শুরুতে এই রোগের ধাক্কা সামলাতে হবে আপনাকে। এরপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিও আপনাকে ধাওয়া করবে। তবে পুরুষেরা এ ক্ষেত্রে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকলেও নারীরা একটু বেশিই রোগটাকে জায়গা দেন মনে। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। তবে তা বিরল!
এসএডির কারণ
সাধারণত সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডারের কারণ হিসেবে মনে করা হয় কম সূর্যালোক। ছোট দিন; মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। শরীরে মেলাটোনিন নামে ঘুম-সম্পর্কিত হরমোন রয়েছে। অন্ধকার হলে শরীর স্বাভাবিকভাবেই বেশি মেলাটোনিন তৈরি করে। সুতরাং যখন দিন ছোট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন আরও মেলাটোনিন তৈরি হয় এবং আমাদের বিষণ্ন করে তোলে।
প্রকারভেদ
এসএডিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—
শীতকালীন বিষণ্নতা: বিষণ্নতার লক্ষণগুলো শরতের শেষের দিক থেকে শীতের শুরুতে শুরু হয় এবং গ্রীষ্মের মাসগুলোতে সহজ হয়ে ওঠে।
গ্রীষ্মকালীন বিষণ্নতা: লক্ষণগুলো বসন্তের শেষের দিক থেকে গ্রীষ্মের শুরুতে দেখা দেয়। এটি অবশ্য কম দেখা যায়।
লক্ষণ দেখে চেনা
এসএডিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এগুলো সাধারণত নির্দিষ্ট সময় দেখা দেয় এবং আবার প্রতিবছর প্রায় একই সময়ে ফিরে আসে।
অতিরিক্ত ঘুম হওয়া এবং দিনের বেলা তন্দ্রাভাব বৃদ্ধি পাওয়া
মনোযোগ বা মনোনিবেশ করার ক্ষমতা কমে যাওয়া
যথাযথ চিন্তায় বাধাপ্রাপ্তি
ক্ষুধা বৃদ্ধি, বিশেষ করে মিষ্টি ও কার্বোহাইড্রেট খাবার গ্রহণের আকাক্সক্ষা জন্মানো
ওজন বৃদ্ধি ঘটা
সেক্স ড্রাইভ কমে যাওয়া
মাথাব্যথাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়া
পূর্বে উপভোগ করা কাজগুলোতে আগ্রহ কমে যাওয়া
সামাজিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া কিংবা তাতে অনাগ্রহ তৈরি হওয়া
যেকোনো কাজে বিরক্তি ও উদ্বেগের উদ্রেক ঘটা
অপরাধবোধ ও আশাহীনতার অনুভূতি জোরালো হওয়া
ক্লান্তি কিংবা দুর্বলতা অনুভব করা।
সহজ সমাধানে
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারলে এর থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে শীতকালীন বিষণ্নতা ও গ্রীষ্মকালীন বিষণ্নতার চিকিৎসা ভিন্ন।’
আর গবেষকেরা বলছেন, ঋতুভিত্তিক এই মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে ওষুধের পাশাপাশি থেরাপির মাধ্যমেও চিকিৎসা করা হয়। যেসব পদ্ধতিতে মিলতে পারে সমাধান—
সূর্যালোকের হাজিরা: জানালার বাইরে বা কাছাকাছি সময় কাটালে এই রোগের উপসর্গ উপশম হতে পারে।
লাইট থেরাপি: সূর্যালোক বাড়ানো সম্ভব না হলে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি বিশেষ আলোর সংস্পর্শে থাকতে পারেন। এই আলো রোগ থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে হতে পারে সহায়ক।
সাইকোথেরাপি: কগনিটিভ বেহেভিওরাল থোবা ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি জ্ঞানীয়-আচরণগত বা আন্তব্যক্তিক থেরাপির মাধ্যমে ভালো হতে পারে। অনেক সময় ওষুধও দরকার পড়ে। যদি মনে করেন আপনি বিষণ্ন হতে পারেন, তবে দ্রুত কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর দ্বারস্থ হওয়া শ্রেয়। অবশ্য নিজেও কিছু ছোট ছোট কাজ করতে পারেন—
বড় কাজগুলোকে ছোট করে ভাগ করে নিন
অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী কাজ করুন
মানুষের আশপাশে থাকার চেষ্টা চালান
বিশ্বস্ত কাউকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিন; এটি সাধারণত একা ও সঙ্গোপনে থাকার চেয়ে ভালো
এমন কিছু করুন যা আপনাকে ভালো থাকতে সাহায্য করবে; যেমন সিনেমা দেখা, বাগান করা, ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা অন্যান্য কাজে অংশ নেওয়া
অন্যের উপকার করুন; কেননা, অন্যের জন্য ভালো কিছু করলে তা আপনাকে ভালো অনুভব করতে সাহায্য করবে
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
ভাবতে থাকুন, আপনার মেজাজ ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যাবে
স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করুন
মদ ও মাদক থেকে দূরে থাকুন; কেননা, এগুলো বিষণ্নতাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে
বিষণ্নতা দূর না হওয়া পর্যন্ত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন; যেমন চাকরি পরিবর্তন, বিয়ে কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ।
শহরের কাছে শরতের আবদার
ঋতু পরিবর্তনের এই সময়কে নেতিবাচক চিন্তায় বিষিয়ে না তুলে বরং শরতের সাদা শিউলি, ঘন কাশবন, নীল আকাশে স্বচ্ছ মেঘের ভেলা আর ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর খোঁজে নেমে পড়ুন আজই। শরতের সঙ্গে মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটাতে শহরের আশপাশে কিংবা গ্রামের দিকে দিন ছুট। চলে যান মাটির কাছে, যেখান থেকে আমাদের শুরু। তাতে আপনার শরতের দিনগুলো কাশফুলের মতো শুভ্র সুন্দর হয়ে উঠবে, আশা করা যায়!
আশিক মুস্তাফা
ছবি: ইন্টারনেট