skip to Main Content

টেকসহি I কন্যার জন্য

১১ অক্টোবর। আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। প্রত্যেক নারীর জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে

মুজুন আলমেলেহান। সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া মেয়েটির বেড়ে ওঠা দারা শহরে। মা-বাবা-ভাই-বোন নিয়ে সেখানে ভালোভাবেই কাটিয়েছে জীবনের প্রথম ১২ বছর। হঠাৎ নেমে আসে দুর্যোগ। কৈশোরে পা দেওয়ার আগমুহূর্তে মেয়েটি হারাতে বসে আনন্দময় শৈশব। যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে গোটা সিরিয়ায়। প্রাণ বাঁচাতে পরিবার নিয়ে মুজুন পাড়ি দেয় জর্ডানের জাতারি শরণার্থীশিবিরে। নতুন জীবনে শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। এরপর আর কি! কঠিন লড়াইয়ে হার না মেনে শিবিরে থাকা স্কুলে নতুন করে পড়াশোনা শুরু মুজুনের। নিজের পাশাপাশি শরণার্থীশিবিরের অন্য শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে থাকে শিক্ষার আলো। বাধা এসেছে বহুবার, কিন্তু মাথা নোয়ায়নি সে। লড়াইয়ে হার না মানা মুজুন একসময় পায় কাজের সম্মান। ২০১৭ সালে শিশুদের প্রকল্প ইউনিসেফের কনিষ্ঠতম শুভেচ্ছাদূত হিসেবে তাকে বেছে নেয় জাতিসংঘ। বিশ্বজুড়ে উচ্চারিত হতে থাকে মুজুনের নতুন পরিচয়।
মুজুনের মতো এমন আরও অনেক কন্যাশিশু রয়েছে, যারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। কেউ কেউ হয়তো বৈষম্যকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যাওয়ার পণ নিয়েছে; তবে সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা। বেশির ভাগ কন্যাশিশুই জীবনজুড়ে সম্মুখীন হয় নানাবিধ চ্যালেঞ্জের। কন্যাশিশুদের যে প্রতিনিয়ত নানা বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, তা তুলে ধরতে জাতিসংঘ প্রতিবছরের ১১ অক্টোবর পালন করে ‘বিশ্ব কন্যাশিশু দিবস’। মূল উদ্দেশ্য বিশ্বে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা। পাশাপাশি শৈশবে কন্যাশিশুর শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা, ন্যায়বিচার যেন যথাযথভাবে নিশ্চিত হয়, তা-ও এই দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ‘কারণ আমি একজন মেয়ে’ (বিকজ আই অ্যাম আ গার্ল) নামক আন্দোলনের ফলে এর সূচনা। দিবসটি প্রথম পালন করার উদ্যোগ নেয় কানাডা। সে দেশই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালনের প্রথম প্রস্তাব তোলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস।
মেয়েদের কণ্ঠস্বরকে জোরালো এবং লিঙ্গবৈষম্য-সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে আলোকপাত করতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দিনটি। যেখানে মেয়েদের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা এবং সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর বিশেষ জোরারোপ করা হয়। এই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, বৃহত্তর আর্থসামাজিক উন্নয়নে অপরিহার্য হাতিয়ারও।
চলতি বছর ‘গার্লস ভিশন ফর দ্য ফিউচার’কে প্রতিপাদ্য করে আন্তর্জাতিক কন্যাসন্তান দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কন্যাশিশুরা যেন নিজেদের কণ্ঠ, কর্মকাণ্ড ও নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালীভাবে ভবিষ্যতের জন্য প্রতীয়মান করতে পারে, সে জন্যই। বর্তমান প্রজন্মের মেয়েরা বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট, সংঘাত, দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার ও লৈঙ্গিক সমতা নিয়ে নানা বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে। বেশির ভাগ মেয়েই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, যা তাদের ভবিষ্যৎকেও সীমাবদ্ধ করে রাখে। এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও এবারের দিবসের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—এই প্রবাদ ছোটবেলা থেকেই কম-বেশি সবাই জেনেছি। জাতির মেরুদণ্ড গঠনে ছেলে-মেয়ে সবার শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যায় এখানে। দারিদ্র্যের চক্র ভাঙতে যেখানে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, সেখানে ইউনেসকোর তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ১৩০ মিলিয়ন মেয়ে বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশের মেয়েরাই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয় সবচেয়ে বেশি। দারিদ্র্যের পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, সাংস্কৃতিক রীতির মতো বিষয়গুলো সেখানে অনুঘটক হিসেবে কলকাঠি নাড়ে। অপরিণত বয়সে বিয়ে শিক্ষার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে হওয়া মেয়েদের বিদ্যালয়ের গণ্ডি সম্পন্ন করার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। ফলে বেঁচে থাকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র এবং বাধাপ্রাপ্ত হয় অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা।
বহু সংগ্রাম শেষে শিক্ষার সুযোগ পেলেও রেহাই মেলে না; মুখোমুখি হয় অর্থনৈতিক বৈষম্যের। বিশ্বজুড়ে লিঙ্গবৈষম্যজনিত মজুরি ব্যবধান এখনো একটি বড় সমস্যা, যেখানে পুরুষদের তুলনায় নারীরা একই কাজের জন্য কম মজুরি পান। উপরন্তু, নারীরা প্রায়শই কম বেতনের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন এবং নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণে আরও বেশি বাধার মুখে পড়েন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বে গড়ে নারী-পুরুষের আয়বৈষম্য ২২ শতাংশের মতো।
এই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন নারী ও পুরুষ সমপরিমাণ কাজ করেও সমান পরিমাণ আয় করেন না। একই পরিমাণ শ্রম বিনিয়োগ করেও পুরুষের আয় যেখানে ১০০ টাকা, সেখানে নারী তার যোগ্যতা সত্ত্বেও পান ৭৯ টাকা। বেশি দূরে নয়, বাংলাদেশের চা-বাগানে নারী চা-শ্রমিকের দিকে তাকালেই দেখা যাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র। ফাঁড়ি বাগানসহ বাংলাদেশে মোট চা-বাগানের সংখ্যা ২৪০। এগুলোর মধ্যে মূল বাগান ১৫৮টি। সারা দেশে কর্মরত চা-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। যাদের সিংহভাগই নারী। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, নারী-পুরুষের মজুরি এখন দৈনিক ১৭০ টাকা হলেও তিন ক্যাটাগরির বাগান রয়েছে। ফলে অনেক বাগানে নারী শ্রমিককে এখনো ন্যূনতম মজুরি ১২০ টাকা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া আনুষ্ঠানিক খাতে অনেক সময় নারী-পুরুষের বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা না গেলেও আয়ের বৈষম্য মেলে ওভারটাইম পেমেন্টের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৮৭ শতাংশেরই কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। যেখানে নারীর সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মেয়েদের জন্য আর্থিক স্বাধীনতার পথ বাধাসংকুল। প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে নারীরা প্রায়শই অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে বাদ পড়েন।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মেয়েদের জন্য অন্যতম বৈষম্যমূলক চ্যালেঞ্জ। গৃহস্থালি নির্যাতন থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি—মেয়েরা এমন সব সহিংসতার শিকার হয়, যা তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। বাল্যবিবাহ, নারীর যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণ, নারী পাচার, সহিংসতা এর কয়েকটি উদাহরণ। বৈশ্বিকভাবে কিশোরীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৭৫ শতাংশ। তা ছাড়া অপুষ্টির কারণে প্রতি তিনজন কিশোরীর মধ্যে একজন ভুগছে রক্তস্বল্পতায়, যা আসলেই চিন্তার বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে প্রায় ১ জন শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার। এই অভিজ্ঞতাগুলো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ফলে তারা সমাজের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করতেও মানসিক বাধার সম্মুখীন হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩১ শতাংশ নারী শারীরিক কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে জরিপ করে এ তথ্য পাওয়া যায়। সংস্থাটি জানায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামী বা সঙ্গীর হাতেই নারীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হন। প্রতি চারজনে একজন নারী ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে শিকার হন সহিংসতার।
প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি সমাজেরও অগ্রগতি হয়েছে; তবে সত্যিকারের লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের জন্য এখনো অনেক কাজ বাকি। সরকার, নাগরিক সমাজ সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কিছু নীতিমালা প্রস্তুত করতে এবং মেয়েদের অধিকার ও ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর মধ্যে মানসম্মত শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর সাংস্কৃতিক প্রথার অবসান ঘটানো জরুরি। একই সঙ্গে, মেয়েদের কণ্ঠস্বর শোনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়শই মেয়েরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে, যেগুলো তাদের জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। মেয়েদের নেতৃত্বের সুযোগ দেওয়া এবং তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা টেকসই পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথাভাঙার গল্প যেসব মেয়ে বলে, তাদের গল্প তুলে ধরাও অবশ্যকর্তব্য। এ ক্ষেত্রে উঠে আসতে পারে সৌদি নারী তালিদাহ তামের কথা, যিনি দেশটির প্রথম নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোতে অংশ নিয়েছিলেন। বলা যেতে পারে জুলিয়ানা মোরেলের কথাও। প্রথম নারী হিসেবে যিনি লাভ করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। মনে রাখা চাই বেগম রোকেয়ার কথা, যার সমগ্র জীবনের প্রয়াস ছিল অজ্ঞানতার গ্রাস থেকে নারীকে মুক্তি দেওয়া। কিংবা বলতে হবে মালালা ইউসুফজাইয়ের কথা, যিনি মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের জন্য উগ্রবাদীদের গুলির আঘাতও সহ্য করেছিলেন।
সার্কভুক্ত দেশগুলো যৌথভাবে গেল নব্বইয়ের দশককে ‘কন্যাশিশু দশক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কারণ, এই দেশগুলোতে সে সময় নারীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। জীবনযাত্রার মান ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাই ইউনিসেফ ‘মীনা’ কার্টুন প্রচারের উদ্যোগ নেয়, যা নারীশিশুর অগ্রগতিতে শতভাগ সফল।
নারী দুর্বল, নারী অবলা—এমন কথা আমাদের সমাজেও প্রচলিত। কিন্তু ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে এই টার্ম ব্যবহারের সুযোগ নেই। মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে; বাড়াতে হবে তাদের আত্মবিশ্বাস।
আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস শুধু একটি স্বীকৃতির দিন নয়; এটি প্রত্যেক মেয়ের সম্ভাবনার প্রতিফলন। কন্যাশিশুরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদী। প্রতিদিন তারা এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে, যেখানে সব কন্যাশিশু থাকবে সুরক্ষিত, হবে ক্ষমতায়িত এবং পাবে সম্মান। এই স্বপ্ন হয়তো কন্যাশিশুরা একা পূরণ করতে পারবে না। পাশে প্রয়োজন সমাজের সকলের, যারা তাদের কথা শুনবে এবং সেই অনুযায়ী নেবে পদক্ষেপ।

 সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top