skip to Main Content

স্বাদশেকড় I পানিপুরি পরিক্রমা

গোলগাপ্পা বা গুপচুপ নামেও পরিচিত। কড়া ভাজা রুটিযুক্ত ফাঁপা গোলাকার খোল। প্রায় ১ ইঞ্চি ব্যাস, যা আলু, পেঁয়াজ ও ছোলার সংমিশ্রণে ভরা। তেঁতুলের চাটনি, মরিচের গুঁড়া অথবা চাট মসলা যোগে খেতে দারুণ

ভারতীয় উপমহাদেশের স্ট্রিট ফুডের কথা ভাবলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা খাবারগুলোর মধ্যে পানিপুরির নাম মনে উঁকি দেয় অনেকের। জানেন কি এই সুস্বাদু খাবার কে আবিষ্কার করেছেন? কিংবা সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য মহাভারতের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে?
এক পক্ষের মতে, পানিপুরির প্রাচীনতম রূপ ফুলকি। প্রাচীন ভারতের ষোলোটি মহাজনপদের অন্যতম ছিল মগধ। সেখান থেকে এর উৎপত্তি। অনেকের আবার বিশ্বাস, ১০০-১২৫ বছর আগে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের আশপাশে উদ্ভূত হয়েছিল এই খাবার। সেই সময় এটি রাজ-কাচোরির একটি রূপ ছিল; কেউ একজন ছোট পুরি তৈরি করে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে খেয়েছিলেন। অবশ্য উৎপত্তি নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও কার হাতে এর উদ্ভাবন, ইতিহাসে তা লেখা নেই।
পৌরাণিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, এই সুস্বাদু খাবারের উৎস মহাভারত; আর মূল পরিকল্পনাকারী (মাস্টারশেফ) দ্রৌপদী। একবার কুন্তী পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তার পুত্রবধূ দ্রৌপদী নির্বাসনের সময় পাওয়া অপর্যাপ্ত উপাদান দিয়ে পাণ্ডবদের ভালোভাবে যত্ন নিতে সক্ষম হবেন কি না। বলে রাখা ভালো, কুন্তী হলেন মহাভারতে বর্ণিত প্রধান নারী চরিত্র, মথুরার যাদববংশীয় রাজা শূরসেনের কন্যা, বসুদেবের বোন, রাজা কুন্তীভোজের পালিত কন্যা এবং হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর স্ত্রী। অঙ্গরাজ কর্ণ, ইন্দ্রপ্রস্থের অধিপতি যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন তার পুত্র। কুন্তীর প্রকৃত নাম পৃথা। অন্যদিকে দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিণী। তিনি দ্রুপদের কন্যা বলে তার এমন নাম। পাঞ্চালী ও যাজ্ঞসেনী নামেও তিনি পরিচিত। মহাভারতে দ্রৌপদী অনিন্দ্যসুন্দরী এবং তার সময়ের শ্রেষ্ঠ নারী রূপে চিত্রিত হয়েছেন।
কুন্তী আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, দ্রৌপদী তার পাঁচ স্বামীর মধ্যে কাউকে বিশেষভাবে পছন্দ করেন কিংবা তিনি সকলের প্রতি ন্যায্য আচরণে সক্ষম কি না! কুন্তী এই চ্যালেঞ্জ কেন দিয়েছিলেন, তা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। কারও কারও মতে, এটি ছিল সদ্য বিবাহিতা দ্রৌপদীকে বাজিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে। আরেক পক্ষের অভিমত, রাজ-সাম্রাজ্য পতনের পরে দ্রৌপদী ও পাণ্ডবদের ১৩ বছরের দীর্ঘ নির্বাসনে চলে যাওয়ার আগে এটি একটি পরীক্ষা ছিল।
চ্যালেঞ্জ হিসেবে দ্রৌপদীকে কুন্তী কিছু অবশিষ্ট আলু সবজি (তরকারি) এবং একটি ছোট চাপাতি তৈরি করার মতো সামান্য পরিমাণ গমের আটা দিয়ে নিশ্চিত করতে বলেছিলেন, পাণ্ডবেরা যেন ক্ষুধায় না ভোগেন। সেই সব উপাদান যোগে দ্রৌপদী চতুরতার সঙ্গে এই মাস্টারপিস ফুড আইটেম, অর্থাৎ পানিপুরি তৈরি করেন। কুন্তী এর স্বাদ সম্পর্কে এবং স্বামীদের প্রতি দ্রৌপদীর নিরপেক্ষতা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। ফলে, এই খাবারকে তিনি অমরত্বের আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর থেকে খাবারটি বিভিন্ন প্রকারে, স্বাদে ও নামে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রতিটি রূপ সুস্বাদু ও জনপ্রিয়।
সমগ্র উপমহাদেশে এই খাবারের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি হয়েছে নানা নামকরণ। যদিও সুস্বাদু খাবারটির শিকড় এখনো ঐতিহাসিক নির্ভুলতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তবে নিশ্চিত ব্যাপার হলো, পানিপুরি ভারতজুড়ে বিস্তার লাভ এবং ভোক্তাদের এর প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে। সময়ের পরিক্রমায় মেনুতে এসেছে নানা নাটকীয় পরিবর্তন। এর মূল কারণ, প্রতিটি অঞ্চলে সেখানকার স্বাদের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব সংস্করণ তৈরি হয়েছে। যেমন নয়াদিল্লি, পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে গোল গাপ্পা; গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের অভ্যন্তরীণ অংশে পাকোদি; আলীগড়ে পাদাকা; ওডিশা, বিহারের কিছু অংশ, ঝাড়খন্ডের ছত্তিশগড়, হায়দরাবাদ ও তেলেঙ্গানায় গুপ-চুপ; উত্তর প্রদেশে পানি কে পাতাশে; মধ্য ভারত, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানের কিছু অংশে পাটাশি; মধ্যপ্রদেশের হোশাঙ্গাবাদে টিক্কি; উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও নেপালে ফুলকি।
পানিপুরি খাওয়া একটু ঝামেলা; কেননা, জামাকাপড়ে যত্রতত্র টক-পানির ছিটা পড়তেই পারে। চুটিয়ে প্রেম করার সময় কেউ যদি পানিপুরি ডেটে যেতে অস্বীকার করেন, তবে বাধতে পারে বিপত্তি। হয়ে যেতে পারে সেটি রেড ফ্ল্যাগ! এটা খাওয়ার সময় যদি অন্য ব্যক্তি ভ্রু কুঁচকে আপনার খাবার ভঙ্গি দেখে বিচার করেন, তখনো রেড ফ্ল্যাগ ইনকামিং ধরে নিতে হবে।
পানিপুরির ঝলক শুধু স্ট্রিট ফুড হিসেবে টিকে থাকেনি, বরং জায়গা করে নিয়েছে রুপালি পর্দায়। অসংখ্য সিনেমা ও টিভি শোতে এ খাবার আস্বাদনের দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে, যা দুজন মানুষের মধ্যকার রসায়নকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। বলিউডের ‘রব নে বানা দি জোড়ি’তে শাহরুখ খান ও আনুশকা শর্মার মধ্যে পানিপুরি খাওয়ার প্রতিযোগিতার কথা মনে আছে তো?
গুগল ডুডল একটি ইন্টার‌্যাকটিভ পানিপুরি খেলা উপস্থাপনের মাধ্যমে এ খাবারের গুণকীর্তন উদ্‌যাপন করেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০১৫ সালের ১২ জুলাই মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের একটি রেস্তোরাঁ ৫১ ধরনের পানিপুরি উপস্থাপন করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই খাবার ভীষণ জনপ্রিয়। ঢাকার টিএসসি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গুলশানের বিভিন্ন স্থানে এই স্ট্রিট ফুডের দেখা বেশি মেলে।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top