ত্বকতত্ত্ব I কাঁসাকথন
প্রায় পাঁচ হাজার বছর পুরোনো আয়ুর্বেদিক সাধনী। নানামুখী ত্বকসমস্যা নিরাময়কল্পে। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ভিড়ে আবার শিকড়ে ফিরে দেখা
ভারতবর্ষে কাঁসা প্রথম পরিচিতি পায় ব্রোঞ্জ যুগে। ইতিহাস বলে, সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরাই ব্যবহার শুরু করেন এটি। তখন এই ধাতুতে তৈরি পাতে খাবার খাওয়ার চল শুরু হয়। কারণ, খাবারের অ্যাসিড কনটেন্ট কমিয়ে আনতে কার্যকর ছিল কাঁসা। সঙ্গে হজমেও সহায়ক ভূমিকা রাখত এই ধাতু। পানি পানেও অনেকের পছন্দের ছিল এতে তৈরি গ্লাস অথবা কাপ। কারণ, ওই একই। পানির অতিমাত্রার অ্যাসিড কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ। অনেকটা ফিল্টারেশন সিস্টেমের কাজ করত কাঁসায় তৈরি এসব পানির পাত্র। পরে ত্বকের যত্নেও এর উপকারিতা প্রমাণ হতে খুব বেশি সময়ক্ষেপণ হয়নি।
কাঁসার জাদুকরি ক্ষমতার পেছনের রহস্যটা আসলে কী? কেন ‘হিলিং মেটাল’ বা নিরাময়ক ধাতু হিসেবে এর জনপ্রিয়তা যুগ পুরোনো? উত্তরটা একদম সহজ। প্রাকৃতিকভাবে দেহের পিএইচ ভারসাম্য রক্ষার শক্তিশালী ক্ষমতাসম্পন্ন এই ধাতু। ত্বকের ক্ষেত্রে একইভাবে উপকারী কাঁসা। এতে উপস্থিত অ্যালকাইন প্রোপার্টি ত্বকের পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখতে দারুণ কার্যকর। তারই ফলাফল—কাঁসা ওয়ান্ডের আবির্ভাব।
কাঁসা ওয়ান্ড কী
প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত এ ধরনের ফেস মাসাজ টুল। যার বয়স এখনকার আধুনিক গুয়া শা এবং ফেস রোলার থেকে নিদেনপক্ষে পাঁচ হাজার বছর বেশি। চোখ কপালে ওঠার মতো তথ্য, কিন্তু আয়ুর্বেদ অনুমিত। তামার পরিমাণই এতে বেশি; সঙ্গে সামান্য দস্তা, টিন আরও অন্যান্য ধাতুর সংমিশ্রণ। একদম প্রথম দিককার আয়ুর্বেদীয় নিবেদন এই কাঁসা ওয়ান্ড; যা বহাল তবিয়তে টিকে আছে আজও।
আধুনিক গুয়া শা আর ফেস রোলারের সঙ্গে এর একদম সাধারণ কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটা উৎপত্তিগত। কাঁসা ওয়ান্ড এসেছে আয়ুর্বেদিক থেকে। ব্রোঞ্জ যুগে। কিন্তু গুয়া শা আর ফেস রোলারের উৎস ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিন। দ্বিতীয়ত, কাঁসা ওয়ান্ড দশা ও চক্রের ভিত্তিতে ত্বকের প্রেশার পয়েন্টগুলোর ওপর ফোকাস করে। গুয়া শা আর ফেস রোলারের মূল ফোকাস থাকে ত্বকের আকুপাংচার পয়েন্টগুলোতে। ব্যবহারগত পার্থক্যও রয়েছে এ টুলগুলোর মধ্যে। প্রক্রিয়ায় রয়েছে ভিন্নতা। কাঁসা ওয়ান্ড ব্যবহারের সময় সার্কুলার, জিগজ্যাগ আর আপওয়ার্ড মোশনে স্ট্রোকগুলো দেওয়া হয়। কিন্তু গুয়া শা আর ফেস রোলার ব্যবহার করা হয় শুধু আপওয়ার্ড মোশনে।
কার্যকারিতার কারণ
কাঁসায় থাকে অ্যালকালাইন প্রোপার্টি; যা ত্বকের পিএইচ ভারসাম্য রক্ষা করে। অ্যাসিড কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে রাখে। এগুলোর হেরফেরে ত্বকে স্পর্শকাতরতা, অকালবার্ধক্য, বলিরেখা, প্রদাহ আর ব্রণের মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়। কাঁসা ওয়ান্ড ব্যবহারে এগুলো রুখে দেওয়া যায় কার্যকরভাবে। এটি ব্যবহারে ফেশিয়াল মাসাজে ত্বকের লিস্ফেটিক গ্রন্থিতে জমে থাকা টক্সিন বেরিয়ে যায়। সতেজ অক্সিজেন প্রবাহের সুযোগ মেলে। ত্বক স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেখায়। অক্সিজেনসমেত রক্তপ্রবাহের কারণে ত্বকের টেক্সচার উন্নত হয়; দূর হয় ফোলা ভাব।
উপকারিতা
ফেশিয়াল মাসাজ তো বরাবরই ত্বকের জন্য উপকারী। সঙ্গে যদি যোগ হয় আয়ুর্বেদীয় অনুমিত কাঁসা মাসাজ ওয়ান্ড, তাহলে এই জোড়ের জাদুকরি ফল ত্বকের জন্য নিশ্চিত।
ত্বককে চটজলদি পুনরায় উজ্জ্বল করে তুলতে কাঁসা ওয়ান্ডের জুড়ি নেই। সঠিক ফেশিয়াল অয়েল দিয়ে এই টুল দিয়ে নিয়মিত মাসাজ পুরো প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে। সঙ্গে দেবে মসৃণ ত্বক রং।
কাঁসা ওয়ান্ডের এই গুণের চর্চা বিশ্বব্যাপী। চেহারাকে প্রাকৃতিকভাবে লিফটেড ইফেক্ট দিতে পারে ম্যাজিক্যাল এ মাসাজ টুল। নিয়মিত ব্যবহারের ফলাফল, ফেশিয়াল মাসলে ডিপ টোনিং। এতে করে কোলাজেন উদ্দীপ্ত হয় বলে গালের হাড় এবং চোয়াল অনেকটা পরিপুষ্ট দেখায়। চেহারা হয়ে ওঠে অল-ন্যাচারাল স্কাল্পটেড।
সঠিক উপায়ে ব্যবহার করতে পারলে কাঁসা ওয়ান্ড ত্বকের রক্তসঞ্চালনের হার বাড়ায় বহুগুণে। বাড়ায় পণ্যের পুষ্টিগুণ গ্রহণের সক্ষমতা। লিম্ফেটিক ড্রেনেজের পথকে সুগম করে। এতে করে ত্বক দেখায় ভেতর থেকে উজ্জ্বল।
কাঁসা ওয়ান্ড যে ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স করার ক্ষমতা রাখে, তা তো সবারই জানা। এতে করে ব্রণ, প্রদাহ, অকালবার্ধক্য কিংবা বলিরেখায় সহজে আক্রান্ত হয় না ত্বক।
বডি ডিটক্সিফিকেশনে দারুণ কার্যকর কাঁসা ওয়ান্ড। শরীরে জমে থাকা অবাঞ্ছিত অ্যাসিডিক কনটেন্ট দূর করে দিতে পারে নিয়মিত ব্যবহারে। ফলাফল, ভেতর থেকে পরিপূর্ণ পরিষ্কার ত্বক।
ভাটা, পিত্ত কিংবা কাফা—এই তিন এ মধ্যে একটারও ভারসাম্যহীনতায় দেহে বাহ্যিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কাঁসা ওয়ান্ড দশার অসামঞ্জস্য রোধ করে এর ফলে সৃষ্ট প্রদাহে প্রশান্তি এনে দেয়। যার সরাসরি প্রভাব পরিলক্ষিত হয় মুখত্বকে।
ফেশিয়াল টোনিংয়ের কাজ করে বলে কাঁসা ওয়ান্ড ব্যবহারে ত্বকের কোলাজেন উদ্দীপ্ত হয়। এতে ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়; দেখায় আরও পরিপুষ্ট।
প্রয়োগপ্রক্রিয়া
একদম সহজ এ প্রক্রিয়ার শুরুটা হওয়া চাই পরিপূর্ণভাবে ত্বক পরিষ্কার করার মাধ্যমে। তারপর ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে। শতভাগ ফল উপভোগের জন্য বেছে নিতে হবে পছন্দসই কোনো ফেশিয়াল অয়েল। অবশ্যই ত্বকের ধরন আর চাহিদা অনুসারে। কয়েক ফোঁটা দুই হাতের তালুর মাঝে নিয়ে ভালো করে ঘষে নিতে হবে। এতে অ্যাকটিভেটেড হবে তেল। মিলবে পরিপূর্ণ পুষ্টিগুণ। তারপর চেহারায় মেখে নিতে হবে তেল। এবার কাঁসা ওয়ান্ড ব্যবহারের পালা। শুরুটা হতে হবে কপালের মাঝ অংশ বরাবর। সার্কুলার মোশনে। তারপর চোখের চারপাশে ‘৪’ এর মতো প্যাটার্নে বুলিয়ে নিতে হবে ওয়ান্ড। ক্লকওয়াইজ এবং অ্যান্টিক্লকওয়াইজ—উভয়ভাবে; তারপর চিকবোন বা গালের হাড়ের পালা। এখানে আপওয়ার্ল্ড স্ট্রোক রক্তসঞ্চালন বাড়াতে সহায়ক। তারপর কানের নিচের অংশে বৃত্তাকারভাবে বুলিয়ে নেওয়া চাই। এরপর চিবুক থেকে চোয়ালের হাড়ের পুরোটা আপওয়ার্ড মোশনে মাসাজ করে নিতে হবে। মাসাজের সময় অনেকের ত্বক ধূসর বর্ণ ধারণ করতে পারে। এতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এটি ত্বকের অ্যাসিডিক মাত্রার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কোমল ক্লিনজার ব্যবহারে এটি সহজে দূর করে নেওয়া সম্ভব। যেকোনো ধরনের ত্বকে সহজে ব্যবহার উপযোগী এই টুল। প্রাথমিক অবস্থায় সপ্তাহে একবার ব্যবহারই যথেষ্ট। সময়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে সপ্তাহে দু-তিনবার ব্যবহার করা যাবে অনায়াসে।
বিউটি ডেস্ক
মডেল: লিন্ডা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল