skip to Main Content

ফিচার I বিবাহে বিনোদন

বাঙালি বিয়েতে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে থাকে নানা আয়োজন। তাতে কাল পরিক্রমায় বেশ পরিবর্তন এলেও কিছু ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি এখনো বর্তমান। বিয়ে ঘিরে বিনোদনব্যবস্থার সেকাল ও একালের তুলনামূলক চিত্রের হাজিরা ঘটালেন সুবর্ণা মেহ্জাবীন

সেকালে
পালাগানের আসর
আগেকার বিয়েতে, বিশেষত গ্রামীণ সমাজে পালাগান হওয়ার মূল কারণ ছিল বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক একত্রকরণ। তখনকার সময়ে গ্রামীণ এলাকায় বিনোদনের সুযোগ ছিল সীমিত। বিয়ের অনুষ্ঠান শুধু পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না; বরং পুরো গ্রাম সামাজিক উৎসবে রূপ নিত। বিয়েতে আসা অতিথি ও গ্রামের মানুষদের বিনোদন দিত পালাগান, যা সংস্কৃতির রীতি ও ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটাত। অনেক পালাগানে ধর্মীয়, নৈতিক বা সামাজিক বিষয়বস্তু তুলে ধরা হতো। এতে কাব্যিক ও ছন্দময় কথোপকথনের মাধ্যমে মানুষ আনন্দের পাশাপাশি নানা শিক্ষণীয় বিষয়ও পেত। আগেকার বিয়েতে অনুষ্ঠান চলত রাতভর এবং পালাগান ছিল সেই রাত্রি জাগরণের অন্যতম প্রধান বিনোদনমূলক খোরাক। অতিথিরা রাতে না ঘুমিয়ে তা উপভোগ করতেন। পালাগানে সাধারণত দুই দল থাকত, যারা পালাক্রমে কাহিনি গাইত ও প্রতিযোগিতা করত। এই প্রতিযোগিতামূলক গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে রসবোধ ও কৌতুকপূর্ণ মন্তব্যের বিনিময় ঘটত, যা দর্শকদের আনন্দ দিত।
গায়েহলুদে লোকগীতি
‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ/ বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা, নরম নরম বউ রে…’ আগেকার গায়েহলুদে এমন লোকগীতি ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। এসব গানে গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি ও বাঙালি ঐতিহ্যের কথা ফুটে উঠত। গানের কথা ছিল সহজ, কাব্যিক এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া। বিয়ের আনন্দ, বর-কনের সুন্দর জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের ভবিষ্যতের মঙ্গল কামনা ছিল বিষয়বস্তু। তখন তো আর একালের মতো মিউজিক সিস্টেম ছিল না; তাই মেহেদি বা হলুদ দেওয়ার সময় আত্মীয়স্বজন মিলে গান গাইত, যা অনুষ্ঠানকে আরও আনন্দমুখর করে তুলত। নারীরাই ছিলেন মূল শিল্পী। তারা দলবদ্ধভাবে গান গাইতেন এবং লোকগীতির সুরে নাচতেন। এসব গানের মধ্যে রসিকতা, কৌতুক এবং কখনো কখনো কষ্টও প্রকাশ পেত।
যাত্রাপালা
আগে গ্রামীণ সমাজে আধুনিক বিনোদন তথা রেডিও, টেলিভিশন বা সিনেমা সহজলভ্য ছিল না। তাই যাত্রাপালা ছিল সাধারণ মানুষের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বিয়ের অনুষ্ঠানে এর আয়োজন করা হলে তা গ্রামের মানুষের জন্য আনন্দের বিশেষ উপলক্ষ হয়ে উঠত। লোকজন যাত্রাপালা দেখে রাত পার করত; যা শুধু অতিথিদের জন্যই নয়, আশপাশের মানুষদের জন্যও ছিল বড় আকর্ষণ। অনেক সময় যাত্রাপালা প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হতো। একাধিক যাত্রাদল এসে পারফরম্যান্স দেখাত।
বাদ্যযন্ত্র
শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের তাৎপর্য এবং অনুষ্ঠানের জাঁকজমক আরও বাড়াতে সানাই, ঢোল এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আগে ছিল খুব চেনা ঘটনা। বিশেষত সানাই; কেননা এ বাদ্যযন্ত্র মূলত সুখ ও সমৃদ্ধি এবং নতুন জীবন সূচনার প্রতীক; যা অনুষ্ঠানে আধ্যাত্মিক ও শাস্ত্রীয় সুরের পরিবেশ তৈরি করে। বিয়ের সময় বর-কনের জীবনের নতুন যাত্রাকে সম্মান জানাতে এবং একটি শুভ সূচনা উদ্‌যাপন করতে বাজানো হতো এটি।
কাওয়ালি
এটি মূলত সুফি ঘরানার সংগীত, যা আধ্যাত্মিক প্রেম এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করে। মুসলিম সমাজে বিয়েতে কাওয়ালি গাওয়ার ঐতিহ্য বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। বিনোদনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল এই গান। কাওয়ালির সুর ও তালের মধ্যে একধরনের নাচের আমন্ত্রণ থাকে, যা বিয়ের পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। সেই তালে অতিথিরা মেতে উঠতেন।
একালে
সাউন্ড সিস্টেম ও ডিজে
আধুনিক জীবনে বিয়েতে সাউন্ড সিস্টেম চলছে বেশ আগে থেকেই। বিয়ের আয়োজন হলেই শুরুতে যা আনা হতো, তা হলো বড় সাউন্ড বক্স। সেটিও পরিবর্তিত হয়েছে কালের স্রোতে। এখন ডিজে সিস্টেমের ব্যবহার আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের বিনোদনের ধরন পরিবর্তনের একটি ফল। বিয়েতে এই সিস্টেমের ব্যবহার শুরু মূলত গেল শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। চলতি শতকের প্রথম দশকে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পরিবর্তনের সঙ্গে এই ধারার সূত্রপাত; বিশেষ করে বড় শহর এবং অভিজাত শ্রেণির মাঝে ডিজে সিস্টেম বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুনভাবে বিনোদনের খোরাক হয়ে ওঠে। বিয়ের আয়োজনে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ও চাহিদায় অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। তারা ট্র্যাডিশনাল মিউজিকের পাশাপাশি পশ্চিমা ও সমসাময়িক মিউজিক, পপ, বলিউড ও ইলেকট্রনিক মিউজিক শুনতে পছন্দ করেন। ডিজে সিস্টেমের মাধ্যমে এ ধরনের গান বাজানো সম্ভব, যা বিয়ের পরিবেশকে আরও আধুনিক ও উপভোগ্য করে তোলে। বিভিন্ন আলোকসজ্জা ও লেজার লাইটের সঙ্গে ডিজে মিউজিক বিয়ের অনুষ্ঠানকে একপ্রকার পার্টি বা ফ্যাশন শোর মতো জমকালো করে তোলে। ডিজে থাকার কারণে অতিথিরা তাদের পছন্দের গান শোনার অনুরোধ করতে পারেন।
থিম বিয়ে
এ ক্ষেত্রে বিয়ের পুরো আয়োজন একটি নির্দিষ্ট রং, বিষয় বা ধারণাকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়; যা বিয়েকে আরও স্মরণীয় ও ভিন্নধর্মী করে তোলে। ইনস্টাগ্রাম, পিন্টারেস্টের মতো প্ল্যাটফর্মে থিম বিয়ের ছবি ও ভিডিও দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হন।
 এখন রয়্যাল থিম দেখা যায় বেশির ভাগ বিয়েতে। বড় হোটেলে বিয়ের ভেন্যু নির্বাচন করা হয়। বর-কনে রাজকীয় পোশাক পরেন; সাজসজ্জায় সোনালি, লাল কিংবা মেরুন রং ব্যবহার করা হয়। সবকিছুই প্রাচীনকালের রাজকীয় বিয়ের মতো করে সাজানো হয়।
 অনেকে আবার সমুদ্রতীরের পরিবেশে বিয়ের আয়োজন করেন। তাতে নীল ও সাদা রঙের মেলবন্ধনে অতিথিরা হালকা, আরামদায়ক পোশাক পরেন। এই ধরনের বিয়েতে প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে সাজসজ্জা ও মেনু নির্বাচন করা হয়।
 গেল শতকের পঞ্চাশ বা সত্তরের দশকের ফ্যাশন ও মিউজিককে ভিত্তি করে থিম বিয়েরও দেখা মেলে এখন। আধুনিকভাবে পুরোনো দিনের সংগীত, পোশাক ও সাজসজ্জা ব্যবহার করে সেই সময়ের আবহ তৈরি করা হয়।
 অনেক বিয়েতে আবার কালার থিমের দেখা মেলে। নির্দিষ্ট একটি রঙের সমন্বয় করে বিয়ের সাজসজ্জা ও পোশাক নির্বাচন করা হয়। যেমন গোলাপি, সাদা, বেগুনি কিংবা লাল রঙের ব্যবহার বিয়েতে নির্দিষ্ট রঙিন পরিবেশ তৈরি করে।
লাইভ পারফরম্যান্স ও কনসার্ট
বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনে বা তাদের পরিবার মিলে একটি বিশেষ নাচ বা গান পরিবেশন করে। এই পারফরম্যান্স শুধু অতিথিদের আনন্দ দেয় না, বরং বিশেষ স্মৃতির মুহূর্ত হয়ে থাকে। অনেক বিয়েতে থিম অনুযায়ী পারফরম্যান্স থাকে। যেমন যদি বিয়ে ‘বলিউড থিমে’ হয়, তাহলে বলিউড স্টাইলে নাচ বা গান পরিবেশিত হয়। বর্তমানে অনেক পরিবার বিয়ের পারফরম্যান্সকে বিশেষভাবে সাজানোর জন্য পেশাদার কোরিওগ্রাফার ও ইভেন্ট প্ল্যানার নিয়োগ করে। তারা পুরো পারফরম্যান্স সাজানোর দায়িত্ব সামলায় এবং অতিথিদের সঙ্গে মিলে পারফরম্যান্সের প্রস্তুতি নেয়। পেশাদার কোরিওগ্রাফারদের মাধ্যমে নাচ, নাটক বা অন্য পারফরম্যান্স আরও নিখুঁত ও আকর্ষণীয় হয়, যা অতিথিদের মনে বিশেষভাবে স্থান করে নেয়।
 বিয়েতে পারফরম্যান্স অতিথিদের জন্য বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত বড় বাজেটের বিয়েতে মিউজিক্যাল পারফরম্যান্স, কনসার্ট, লাইভ ব্যান্ড, ম্যাজিক শো, স্ট্যান্ডআপ কমেডি ইত্যাদি আয়োজন করা হয়, যা অনুষ্ঠানজুড়ে অতিথিদের আনন্দ দেয়।
 বলা যেতে পারে, সেকালের বিয়ের পালাগান বা কবিগানের আধুনিক সংযোজন একালের লাইভ মিউজিক পারফরম্যান্স। প্রি-রেকর্ডেড মিউজিকের তুলনায় লাইভ পারফরম্যান্স অনেক বেশি ইন্টার‌্যাকটিভ হয়। এতে অনুষ্ঠানটি আরও আনন্দময় ও জাঁকজমক হয়ে ওঠে। অতিথিরা নিজেদের পছন্দের গান শোনার অনুরোধ জানাতে পারেন। এ ছাড়া বর-কনের পরিবারের সদস্য বা বন্ধুরা যদি নিজেরাই গান গান, তাহলে সেটি আরও আবেগময় ও ব্যক্তিগত হয়, যা বিয়ের স্মৃতিকে ধরে রাখতে সহায়তা করে।
লাইভ পেইন্টিং
বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকা আর্টিস্টরা সরাসরি পেইন্টিং করেন; যেখানে বর-কনে, অতিথি এবং বিয়ের মুহূর্তগুলো ক্যানভাসে তুলে ধরা হয়। লাইভ পেইন্টিং বিয়ের বিশেষ মুহূর্তগুলোকে ক্যাপচার করার একটি ভিজ্যুয়াল ও আর্টিস্টিক পন্থা। ছবি বা ভিডিও তো থাকেই; পাশাপাশি ভিন্ন এই আয়োজন থাকায় সবার জন্য চমৎকার স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকে। অনেক বিয়েতে থিম অনুযায়ী তা করা হয়। যেমন যদি বিয়ের থিম রোমান্টিক বা ঐতিহ্যবাহী হয়, শিল্পী তার পেইন্টিংয়ে সেই আবহ তুলে ধরেন।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top