skip to Main Content

রম্যরস I দূরদর্শী -সুমন্ত আসলাম

হাঁটার গতিটা একটু কমিয়ে দিলেন মোরশেদ সাহেব। এগিয়ে গেলেন আরও কয়েক পা। গতিটা বাড়াতে নিয়েই ঝট করে ফিরে তাকালেন, পেছনে। যথারীতি ছেলেটা আসছে—মাথা নিচু তার, হাঁটার ভঙ্গিটাও বেশ মন্থর, অনেকটা উদাসীন।
কাউন্টার থেকে একটা টিকিট কাটল ছেলেটা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠল। বাস আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল স্ট্যান্ডের মাঝ বরাবর।
মোরশেদ সাহেব খেয়াল করলেন, ছেলেটা প্রতিদিন এই জায়গাতেই দাঁড়ায়, যেমনটা তিনি দাঁড়ান। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে না সে। কখনো কেউ সঙ্গেও থাকে না তার। চুপচাপ।
আড়চোখে ছেলেটার দিকে তাকালেন তিনি, যথারীতি নিচু করে আছে মাথা। বাস এলে মাথা নিচু করেই উঠে পড়বে সে তাতে—ধীর স্থির, যেন তাড়া নেই তার কোনো কিছুতে।
বাস আসতে দেরি হচ্ছে আজ। বেশ অস্থির অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। একটু এগিয়ে এলো সে মোরশেদ সাহেবের দিকে। কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, ‘আঙ্কেল, কয়টা বাজে এখন?’
‘জানি না। কারণ, আমার কাছে ঘড়ি নেই।’
‘মোবাইল তো আছে।’
‘তা আছে।’
 ‘মোবাইলে ঘড়ি থাকে।’
‘জানি। কিন্তু ওটা পকেটে আছে আমার।’
‘বের করুন, প্লিজ।’
‘কেন!’
‘এখন কয়টা বাজে, খুব জানা দরকার আমার।’
‘না, আমি মোবাইল বের করব না।’
‘কেন?’
‘এখন সময় কত, তা আমি তোমাকে বলতে চাচ্ছি না।’
‘জানতে পারি—কেন বলতে চাচ্ছেন না?’
‘তাতে আমার ক্ষতি হবে।’
‘ক্ষতি হবে!’
‘অবশ্যই ক্ষতি হবে এবং অনেক বড় ক্ষতি হবে।’
‘অবাক হচ্ছি আমি।’
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
‘কীভাবে ক্ষতি হবে—তা যদি আমাকে একটু বলতেন।’
‘দেখো ইয়ং ম্যান, আমি যদি এখন তোমাকে সময়টা বলি, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে একটা থ্যাংক ইউ দেবে।’
‘তা তো দেবই। এটাই তো ভদ্রতা।’
‘তার বদলে আমাকে বলতে হবে—ওয়েলকাম।’
‘সমস্যা নেই, সেটা আপনি না-ও বলতে পারেন।’
‘কেন বলব না, ওয়েলকাম বলাটাও একধরনের ভদ্রতা।’
‘জি, ভদ্রতা।’
‘আগামীকালও তোমার সাথে সম্ভবত এই বাসস্ট্যান্ডে দেখা হতে পারে আমার, এই সময়েই।’
‘তা পারে।’
‘তুমি আবারও আমার কাছে সময় জানতে চাইতে পারো।’
‘আমি যেহেতু এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি, সেহেতু দেখা হতেই পারে। এবং প্রয়োজন হলে সময় জানতে চাইতেই পারি।’
‘আমিও নিয়মিত এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি, সুতরাং তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যেতে পারে আবার। সময়ও জানতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক না।’
‘জি, অস্বাভাবিক না।’
‘তারপর কোনো একদিন তুমি আমার নাম জানতে চাইবে।’
‘এটা নিশ্চয় অভদ্রতা নয়।’
‘তারপর কোথায় থাকি, সেটাও জানতে চাইতে পারো একদিন।’
‘কথা প্রসঙ্গে সবাই এটা করে।’
‘একদিন হয়তো তুমি আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলে। আমাকে দেখেই বললে, আঙ্কেল, এই দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, আপনার কথা মনে হলো, তাই চলে এলাম।’
‘এমন তো হতেই পারে।’
‘আমি যেহেতু একজন ভদ্রলোক, সৌজন্যবশত এক কাপ চা খাওয়ার অফার তোমাকে করতেই পারি।’
‘তাই তো করা উচিত। ভদ্রলোকেরা এমনই করে।’
‘চা খেতে খেতে আরও কিছুক্ষণ আমার বাসায় থাকবে তুমি।’
‘চা খেতে তো একটু সময় লাগেই। তা ছাড়া কারও বাসায় গেলে কেউ তো শুধু চা দেয় না, আরও কিছু দেয়।’
‘চা শেষ করে তুমি আমার ঘরে থাকা বইগুলোর দিকে এগিয়ে যাবে। কাচের আলমারিতে থাকা বইগুলো দেখতে থাকবে।’
‘বই হচ্ছে একটি বাড়ির সবচেয়ে বড় অলংকার, যেটার প্রতি অধিকাংশ মানুষেরই আকর্ষণ খুব বেশি।’
‘আলমারি খুলে আনমনে কতগুলো বই ছুঁয়ে দেখবে তুমি।’
‘বই শুধু পড়ার না, ছুঁয়ে দেখারও জিনিস।’
‘তুমি একটা বইও খুলে ফেলতে পারো হঠাৎ, এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করলে আনমনে।’
‘ওই যে বললাম—বই তো মূলত পড়ারই জিনিস।’
‘বই পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে যেতে পারো তুমি, এবং হাতে রাখা বইটা মেলে ধরেই সোফায় বসে পড়লে আবার।’
‘বইয়ের মুগ্ধতায় মানুষ সাধারণত তাই করে।’
‘এবং তারপর স্বভাবতই তোমাকে আরেক কাপ চা অফার করতে হবে আমাকে।’
‘আপনি একজন ভদ্রলোক মানুষ, ভদ্রলোকেরা অতিথিদের যথাযথ সম্মান করে, মর্যাদা দেয়।’
‘চা খেতে খেতে বইটা পড়তে থাকলে তুমি, তারপর বইটা পাশে রেখে বললে, চা তো খুব সুন্দর বানানো হয় আপনার বাসায়।’
‘কোনো কিছু সুন্দর হলে তার প্রশংসা করাও ভদ্রতা।’
‘তার কয়দিন পর তুমি আবার আমার বাসায় এলে। হাসতে হাসতে বললে, আপনার বাসার চায়ের স্বাদটা মুখে লেগে আছে আমার। আজ ছুটির দিন, তাই চলে এলাম।’
‘মানুষ তো সুখের খোঁজেই নিরন্তর ঘুরে বেড়ায়।’
‘তোমাকে আবার চা দিতে হবে আমাকে।’
‘খাঁটি ভদ্রলোকেরা এমনই করে।’
‘চা খেতে খেতে তুমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করবে, এই অমৃত চা আপনার বাসায় কে বানায়?’
‘ভালো কোনো জিনিসের প্রশংসা যেমন করতে হয়, সেটা কে বানিয়েছে, তার নামও জানতে ইচ্ছে হয়।’
‘আমি হয়তো তখন কিছুটা গদগদ হয়ে কিংবা তোমার প্রশংসার ফাঁদে পড়ে বলে ফেলব, আমার মেয়ে বানায়। তুমি তখন অবাক হওয়ার ভান করে বলবে, আপনার মেয়ে বানায়! এমন চমৎকার যে চা বানায়, তার সাথে তো পরিচয় হওয়া দরকার।’
‘প্রশংসা করার নিয়ম হচ্ছে—সরাসরি করা, যিনি প্রাপ্য তার সামনে অকপটে করা।’
‘অগত্যা আমার সুশ্রী, ভদ্র, শিক্ষিত মেয়েটাকে তোমার সামনে আনতে হবে।’
‘এটা একধরনের কার্টেসি।’
‘তারপর ঘন ঘন তুমি আমার বাসায় আসতে থাকবে। কোনো কোনো দিন আমার অনুপস্থিতিতেও আসবে, গল্পগুজব করবে। আমার মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক হবে তোমার।’
‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়াটা নিশ্চয় অপরাধ কিছু না।’
‘এভাবে একদিন আমার মেয়েকে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দেবে তুমি, কোনো দ্বিধা না করেই।’
‘সাধারণত একজন যুবক তাই করে। আপনারা যখন যুবক ছিলেন, তখনো তাই করা হতো।’
‘বেড়াতে বেড়াতে কোথাও বসে চা খাবে, ফুচকা-চটপটি খাবে, মাঝে মাঝে সিনেমাও দেখবে।’
‘এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, আঙ্কেল।’
‘একটা সময় আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে ফেলতে পারে।’
‘আমি কি অপছন্দের কেউ, আঙ্কেল?’
‘সুযোগ বুঝে তুমি একদিন আমার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসতে পারো।’
‘মানুষ তো এমনই, বন্ধন চায়।’
‘তারপর দুজন মিলে একদিন আমার সামনে আসবে।’
‘কোনো শুভ কাজের জন্য বড়দের দোয়া ও অনুমতি লাগে।’
‘কিন্তু আমি তো দোয়া করবই না, অনুমতিও দেব না তোমাদের।’
‘কেন এমনটি করবেন—তা কি জানতে পারি, আঙ্কেল?’
‘কারণ, বাবা হয়ে আমি চাই না—আমার মেয়ে এমন একজনকে বিয়ে করুক, যার একটা মোবাইল কেনার সামর্থ্য নেই!’
[ফেসবুকে পাওয়া একটা লেখা অবলম্বনে]

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top