বিশেষ ফিচার I ঢাকাই বিয়ের খাবারের বিবর্তন
কাচ্চি, না সাদা পোলাও? জর্দা, না ফিরনি? বিয়ের অনুষ্ঠানের মেনু নিয়ে তর্ক চলতেই থাকে। তবে কেমন ছিল ঢাকার বিয়ের খাবার। একটু ইতিহাসের পাতা থেকে কিংবা বলা ভালো গুরুজনদের স্মৃতি হাতড়িয়ে লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
বাঙালি যতটা না বাঁচার জন্য খায়, তার চেয়ে বেশি খাওয়ার জন্য বাঁচে! তবে এই খাওয়াদাওয়ার ঝোঁক যতটা পেটের, ততটা মনের নয়। মনের হলে সেটা নিয়ে অজস্র লেখা, পুরোনো খাবারের স্মৃতিচারণা, ইতিহাস থাকার কথা। আফসোসের ব্যাপার, এর কিছুই নেই। এখন খাবারদাবার নিয়ে যা একটু লেখা হয়, সবই পশ্চিমাদের অনুকরণে; নিজেদের অতীত গর্ভ খুঁড়ে বের করার জন্য নয়। তাই যখন কথা হচ্ছিল ঢাকার বিয়ের খাবারের, তখন দেখা গেল অতীত ইতিহাস বেশ নীরব এ ব্যাপারে। কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের সাক্ষাৎকার, রন্ধনশিল্পীর সঙ্গে বৈঠক, ইতিহাসের আর স্মৃতিচারণামূলক বই ঘাঁটাঘাঁটি করে ‘কিছু একটা’ দাঁড় করানো গেল। তবে এটা এই আলাপের কেবল শুরু। এই বিয়ের খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থা, গৌণভাবে ধর্মীয় কিছু ব্যাপার আর অতি অবশ্যই মানুষের স্থানান্তরিত হওয়ার ঘটনা।
বিয়ের খাবার নিয়ে বাজেটের ব্যাপার সব সময় ছিল। দিল্লি কলেজ থেকে চলে আসা জীবনানন্দ দাশের বিয়ে হয়েছিল ঢাকায়, ব্রাহ্মমন্দিরে; ১৯৩০ সালের ৯ মে। বেকার জীবনানন্দের বিয়ের খাবার ছিল কালাচাঁদ গন্ধবণিকের দোকানের পরাণহরা, মাওয়ার চোসি আর কবির প্রিয় সেদ্ধ ডিম। অনেকে বলেন, ডিমের প্রাচুর্য দেখে লাবণ্যর ভ্রু যে কুঁচকে গিয়েছিল, সেটা পুরো দাম্পত্যজীবনে আর কখনো সোজা হয়নি!
যাহোক, ঢাকায় ক্যাটারিং ও ডেকোরেটরের সূত্রপাত ১৮৯৬ সালে। লক্ষ্মীবাজারের নবদ্বীপ বসাক লেনের পিঞ্চু মিস্ত্রীর নেতৃত্বে আবেদ অ্যান্ড কোং নামে, নবাব আহসানউল্লাহর অনুগ্রহে। এর অবস্থান ছিল ঢাকার ওয়াইজ ঘাট এলাকায়। বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী ও পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠা সজীব মোহাম্মদ জানাচ্ছেন, ‘মূলত রাজনৈতিক অনুষ্ঠানগুলোর জন্য ক্যাটারিং ও ডেকোরেটর ব্যবসার শুরু হলেও রইস আদমিদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তাদের রান্না ও খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে দেখা যেত।’ আর অভিজাতদের ছোটখাটো ঘরের দাওয়াতের রান্নার জন্য তো ঘরেই ছিলেন পারমানেন্ট বাবুর্চি—হান্ডি পাকানেওয়ালা, এমনকি বাড়ির নারীরাও কিছু মহিলা পাচক রাখতেন তাদের অধীনে ঘরোয়া রান্নার জন্য। ক্যাটারিং ব্যবসার রমরমা আমরা দেখি গোটা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান জমানাজুড়েই। কারণ, খয়তার হাজী, পিয়ারু সরদার, আরজু হারুন, বাসু বাবুরা পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এদের লোকেরা চেয়ার-টেবিল, শামিয়ানা, ডেকচি, ক্রোকারিজ সরবরাহ থেকে শুরু করে রান্না, পরিবেশন—সবই করত। কিন্তু মধ্যবিত্তরা কীভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করত? এখানেই উঠে আসে ঢাকার সম্প্রীতির এক চিত্র। এ প্রসঙ্গে সজীব মোহাম্মাদ বলছেন, ‘আগে বিয়ের মতো অনুষ্ঠানগুলো ছিল মহল্লাভিত্তিক। একটু উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ঘরে পাঁচ থেকে ছটা পিতলের ডেকচি এমনিই থাকত। পাড়া-মহল্লার বিয়েতে এগুলোই এ-বাড়ি ও-বাড়ি করত। গত শতকের চতুর্থ-পঞ্চম দশক থেকে মোটামুটিভাবে মধ্যবিত্তরাও ক্যাটারারদের কাছ থেকেই জিনিসপত্র নেওয়া শুরু করে।’
হাকিম হাবিবুর রহমান গত শতকের চল্লিশের দশকে বলেছেন, ‘এখন লোকেরা সহজ ও আরামের উদ্দেশ্যে ঠিকাদারদের হাতে দাওয়াতের সকল ব্যবস্থাপনা ন্যস্ত করে দেয়। কিন্তু কান্না সেখানে আসে, যেখানে খোদার ফজলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে, বংশীয় অভিজাত ও ধনী, চাকরবাকরের অভাব নেই, জিনিসপত্রের স্বল্পতা নেই, কিন্তু তারাও এখন মুসলমানদের সর্বজনবিদিত অলসতার কারণে ঠিকাদারদের দিয়ে খাবার তৈরি করান এবং এভাবে ঢাকার প্রাচীনতম রান্না শাস্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।’
যাহোক, ঢাকার ক্যাটারিং ও ডেকোরেটর শিল্প প্রায় ১৩০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—এটাই এই আলাপের ব্যাপার ছিল। এখন ঢোকা যাক খাবারে। মহল্লাভিত্তিক বিয়ের সময় দেখা যেত আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা পিঠা বানানোর দায়িত্ব কাঁধে নিতেন আর মিষ্টি বানানোর কারিগরদের ঘরে ডেকে আনা হতো। ঘিয়ে ভাজা মাষকলাই ডালের আমিত্তি, চন্দ্রপুলি, বাদামের হালুয়া, রাজভোগ ও অ্যাটম বোম ছিল বাংলাবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকার ময়রাদের তৈরি সেরা বিয়ের মিষ্টি।
গত শতকের দ্বিতীয় দশকের বিয়ের খাবারের একটা বিবরণ মেলে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বিবরণী থেকে। দুই কোর্সে খাবার পরিবেশন করা হতো। প্রথমে পরিবেশিত হতো ঢাকাই পরোটা ও মুসাল্লাম। তারপর মুরগির গোশতের আখনি পোলাও, তারপর সাদা পোলাও-ও আসত সঙ্গে কোরমা, রেজালা, কলিজি; তারপর মিহি চালের সাদা ভাতের সঙ্গে কালিয়া আর শেষ পাতে মিষ্টিমুখ দুধের সঙ্গে জর্দা। অবশ্য এ ধরনের খাবার পরিবেশন পরের দিকে আর দেখা যায়নি।
কবি জীবনানন্দের বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবারের গল্পের কাছাকাছি স্মৃতির উল্লেখ পাই সৈয়দ মীর ফজলুল হকের লেখনীতে। পঞ্চাশের দশকের বিয়ের খাবারের প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তখনকার দিনে কমিউনিটি সেন্টার ছিল না। তাই তখন সবাইকে মসজিদে এনে বসানো হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে পোলাও খাওয়ানোর প্রচলন ছিল না। কিন্তু অতিথিদের টি-পার্টি দিয়ে আপ্যায়িত করা হতো। হাফ প্লেটে থাকত একটি করে প্যাটিস ও কেক, দুটি কাবাব, চা-বিস্কুট আর পরিমাণমতো পানি।’ খুব সম্ভবত এ ধরনের বিয়ের খাবারের চল ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মাঝে। তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন কলকাতা থেকে, আর্থিক এক টানাপোড়েন থাকার যথেষ্ট কারণ আছে সে সময়টায়। অন্য অনেক স্থানে এর বিপরীত চিত্রই দেখা যেত।
হাকিম হাবিবুর রহমানের পৌত্র ঢাকা নিয়ে, বিশেষত ঢাকার খাবার নিয়ে লেখালেখি করছেন তার নানার তথ্যসূত্র ও নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে। তিনি বলেছেন, ঢাকার বিয়ের খাবার হলো মোরগ পোলাও। সৈয়দ আলী আহসানও তার চতুর্থ দশকের স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট করে বলেছেন, ঢাকার বিয়ের খাবার মোরগ পোলাও। এই মোরগ পোলাওয়ের প্রস্তুতির বর্ণনা দিয়েছেন যেটির মোরগে এক ফোঁটাও পানি লাগানো যেত না। একটি পাত্রে কাঁচা দুধ থাকত। চামড়া ছিলে পরিষ্কার করে ছোট টুকরোগুলো দুধের মধ্যে ফেলে দেওয়া হতো। আর ভালোমতো কচলে দুধ দিয়ে ধুয়ে ময়লা, অতিরিক্ত চর্বি ফেলে দেওয়া হতো। তারপর আরেকটি পাত্রে রাখা দুধে শেষবারের মতো মাংস ধোয়া হতো। এই মোরগ পোলাও রান্নাতেও ব্যবহার করা হতো দুধ আর খাঁটি ঘি। ঘিয়ের পরিমাণ এতই বেশি থাকত, আলাদা একধরনের ঢালু চীনামাটির পাত্র ব্যবহার করা হতো, যার সবচেয়ে ঢালু অংশে একটা ফুটো দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে ঘি জমা হতো। আর এর সঙ্গে থাকত প্রচুর বাদাম, পেস্তা ও জাফরানের আঁশ। হাকিম হাবিবুর রহমানও এই মোরগ পোলাওয়ের গুণগান করে গেছেন। তার ভাষ্যে, ‘…খাচ্ছা যাকে এখন মোরগ পোলাও বলে, এখানকার বিশিষ্ট জিনিস।… অন্যান্য শহরে যাকে মোরগ পোলাও বলে, তার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না।… খাচ্ছা পোলাওয়ে মুরগির গোশত দেওয়া হয় এবং মুরগির গোশতের টুকরা আস্ত রাখা হয় না। এর পরিচয় এই যে গোশত মিশ্রিত থাকা সত্ত্বেও আলাদা দেখাবে।… এরূপ মোরগ পোলাও ঢাকা ছাড়া কোথাও রান্না হয় না এবং ঢাকাবাসী ছাড়া এটা কেউ রান্নাও করে না।’ মূলত এই মোরগ পোলাও-ই ঢাকাই বিয়ের একবারে আদি ও আসল খাবার।
তবে রইসদের মধ্যে বিরিয়ানির চল ছিল শুরু থেকেই, মানে ঢাকার আবারও সুদিন ফিরে আসার পর থেকেই। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাবুর্চিরা ঢাকায় এসেছিলেন। এই আগমন মোটামুটি দেশভাগ পর্যন্ত চলেছিল। কেউ বিহার, কেউ মুর্শিদাবাদ, আবার কেউ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্য ফেরাতে। তাই কাচ্চি একেবারে উচ্চবিত্ত অভিজাতদের জন্য বরাদ্দ ছিল, একদম আলাদা করে। তবে মধ্যবিত্ত আমজনতা পর্যায়ের খাবার ছিল মোরগ পোলাও। অবশ্য শুধু মোরগ পোলাও খাইয়ে কি আর অতিথি বিদায় করা যায়? মোরগ পোলাও ছিল মেইন ডিশ; সঙ্গে থাকত মুরগির রেজালা, শামি কাবাব আর মাঝে মাঝে চুমুক দেওয়ার জন্য একান্তই আমাদের এই এলাকার পানীয় বোরহানি। শেষ পাতে মিষ্টিমুখ করার জন্য খোরাই ফিরনি বা শাহি টুকরা। দেশভাগের পর সৌভাগ্যে অবনতি, বিভিন্ন এলাকার মানুষের ঢাকায় আসা, অর্থনৈতিক সংকট—সব মিলিয়ে মোরগ পোলাও তার জায়গা হারায়। এমনকি দোকানগুলো থেকেও হারিয়ে যেতে থাকে আদি, আসল মোরগ পোলাও এবং তার রেসিপি।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে মোরগ পোলাওয়ের জায়গা নিয়েছিল মোতি পোলাও। তবে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দশক ঘোরার আগেই হোগলা পোলাও বা খুস্কা পোলাও তার জায়গা নিয়ে নেয়। মোতি পোলাওয়ের মোতি হলো মাংসের কোফতার কাবাব। ছোট ছোট মার্বেলের চেয়ে আরেকটু ছোট আকৃতিতে গড়ে, দমে দিয়ে দেওয়া হতো পোলাওয়ের সঙ্গে। প্রতি গ্রাসেই যেন কয়েকটি কোফতা উঠে আসে, এমন পরিমাণে সেটা পোলাওয়ে দেওয়া হতো। এই কোফতা শক্ত হতো না; ভঙ্গুর ও মোলায়েম হতো। শীতকালে এর সঙ্গে যোগ করা হতো সবুজ মটরদানা। হোগলা পোলাও বা খুস্কা পোলাও চল্লিশের দশকেই ছোট ছোট দাওয়াতে অপরিহার্য হতে শুরু করেছিল, পরের দশকের শেষে সেটাই হয়ে গিয়েছিল বিয়ের অপরিহার্য খাবার। আমরা জানি, পোলাও রান্নার অপরিহার্য উপাদান হলো আখনি বা মাংসের রস। এই সাদা পোলাও রান্না করা হতো এবং এখনো হয় আস্ত মসলার সাদা আখনি দিয়ে; মাংস দিয়ে নয়। মোতি পোলাওয়ের সঙ্গে, আর পরে সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে মুর্গ মুসাল্লাম, শামি কাবাব আর খাসির রেজালা। তবে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে একটি বিষয় বেশ সাধারণ ছিল। শুরুতে এক টুকরা তিন কোনা ঢাকাই পনির অথবা মাওয়া পরিবেশন করা, স্যালাদের সঙ্গে। রইস বা অভিজাতদের খাসির কাচ্চি বিরিয়ানির সঙ্গে সদা সঙ্গ দিয়ে এসেছে বোরহানি, জালি কাবাব আর আলুবোখারার চাটনি। রন্ধনশিল্পী সজীব মোহাম্মাদ জানালেন, তার এক দাদির বিয়ে হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শুরুতে; সেখানে মেনু ছিল খাসির বিরিয়ানি, টিকিয়া আর শেষ পাতে দই। মোটামুটি বেশ কিছুদিন ওই দশকের ট্রেন্ড চলেছিল ঢাকায়। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালের দিকে শুরু হয় দ্রুত ট্রেন্ড বদলের খেলা। আর এ সময়েই কমিউনিটি সেন্টারের ট্রেন্ড ভালোমতো চালু হয়। এর আগ পর্যন্ত বাবুর্চি ভাড়া করে আনার রীতিই জনপ্রিয় ছিল; আর ডেকোরেটররা ছিল ওয়ান-স্টপ সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে—বাবুর্চি থেকে হাঁড়ি-পাতিল, ক্রোকারিজ, চেয়ার-টেবিল, শামিয়ানা-তেরপল—সবকিছুই তারা দিত। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে খাবারের বদলের মূল কারিগর ছিলেন দেশভাগের সময় ওপার থেকে আসা লোকেরা।
আবারও সেই গত শতকের শুরুর মতো দেখা যেতে থাকে দুই কোর্সে খাবার পরিবেশন। প্রথম কোর্সে শিরমালের কাছাকাছি ধরনের নান, গরু ভুনা বা খাসি ভুনা ও সবজি। এই সবজি ছিল ঢাকায় চায়নিজ খাবারের বিপুল জনপ্রিয়তার সুবাদে বিয়ের অনুষ্ঠানে খানিকটা ফিউশন হয়ে আসা একটি পদ। মেইন কোর্সে ছিল কাচ্চি বিরিয়ানি, জালি কাবাব, বোরহানি, আলুবোখারার চাটনি, দেশি মুরগির রোস্ট। শেষ পাতে জর্দা বা খোরাই ফিরনি। মাঝে কিছুদিন চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে আসা আরেকটা পদ—ক্রাম্বড চিকেন ফ্রাই দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তবে গেল নব্বইয়ের দশক থেকেই কাচ্চি মোটামুটিভাবে স্থায়ী সদস্য হয়ে ওঠে বিয়ের খাবারের মেনুতে। ২০০০ সালে এসে এটা বদলে গিয়ে প্রথম কোর্সে চলে এসেছিল নান, চায়নিজ ঢঙের সাদা সবজি, রোস্টের বদলে চিকেন টিক্কা বা শাসলিক, আর সঙ্গে গরু বা খাসির কালাভুনা। আর উচ্চ মধ্যবিত্তরা এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল মাছ ভাজা বা চিংড়ি আর টিকিয়া। বলে রাখা ভালো, ফার্মের মুরগি এ দেশের বিয়ের মেনুতে এখনো ব্রাত্য; শুধু টিকিয়া আর জালি কাবাবে এর ব্যবহার শুরু হয় দেশে পোলট্রিশিল্পের বিকাশ শুরুর পর, ক্যাটারারদের কস্ট কাটিংয়ের জন্য। কারণ, গরু ও খাসির মাংসের দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি সাদা পোলাওয়ের আরেকটি ক্ল্যাসিক ধারা বজায় ছিল বরাবরের মতো। ২০০৫ সালের দিক থেকে এখন পর্যন্ত মোটামুটি চলছে দুটো ধারা—একটি কাচ্চির, আরেকটি সেই ক্ল্যাসিসিস্ট ঘরানার সাদা পোলাওর। বিরিয়ানির যে ধারা, সেখানে আগেকার মতোই স্যালাদ, জালি কাবাব, বোরহানি, আলুবোখারার চাটনি, ক্র্যাম্ব চিকেন ফ্রাই রয়েছে; শেষ পাতের জন্য জর্দা। সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে ধারায় রয়েছে টিকিয়া, মুরগির রোস্ট, মুরগি ফ্রাই, চায়নিজ সবজি, লাল ভুনা আর কালাভুনার মাঝামাঝি গরুর ভুনা বা রেজালা আর ফিরনি।
তবে ওপরের সব কটায় একেবারে খাওয়া শেষে যে ব্যাপার থাকত আর এখনো আছে, তা হলো পান। উৎসবের ভোজের সবশেষে পান খাওয়ার রীতির কথা পাওয়া যায় সেই দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ অব্দি। কখনোবা সোজা সরল ট্র্যাডিশনাল চুন, সুপারি, জর্দা, খয়ের মেশানো; কখনো আবার বাহারি মিষ্টি পান।
খাবারের এত বিবরণ দেওয়ার পর ‘সাহেবানা খাওনে’র প্রসঙ্গ না টানলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নিয়ম ছিল জামাইয়ের সামনে ৪৫ পদের খাবার পরিবেশনের—যার ভেতরে আস্ত খাসির রোস্ট (এটা আগে ছিল আফগান ঘরানার পোড়া কাবাব গোত্রীয়, যা এ দেশে কালের বিবর্তনে খানিকটা পোড়া, খানিকটা গ্রেভি হয়ে গেছে, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর জায়গা এখন দখল করেছে মুরগির রোস্ট), খাসির রান ভাজা, খাসির চাপ, গরুর চাপ, কবুতর ভাজা, তিতির ভাজা, বড় বাগদা চিংড়ি ভাজা, আস্ত ইলিশ ও রুই ভাজা, হাঁসের রোস্ট, গরুর কোফতা-কারি, হান্ডি কাবাব, নার্গিসি কোফতা, পনির কাবাব, দই, মালাইকারি, রসমালাই, জাফরানি ফিরনি ইত্যাদি। এখনো জামাইয়ের জন্য খাবারের প্রাচুর্য ও বাহুল্য দেখা যায়।
আরেকটা ট্রেন্ড চালু হয়েছিল গত শতকের শেষ দশকে। এখনো রয়েছে অল্পবিস্তর। সেটা হলো চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বিয়ের আয়োজন। যারা চিরাচরিত নিয়মের থেকে একটু ভিন্নতা দেখাতে চাইতেন, তারাই এটা করতেন। প্রথমে আসত চিকেন অনথন আর ঘন থাই স্যুপ, এরপর মেইন কোর্স হিসেবে টেবিলে আগমন ঘটত মিক্সড ফ্রাইড রাইসের আর সেটার সঙ্গত দিত চায়নিজ ভেজিটেবল ও ফ্রাইড চিকেন; মাঝে মধ্যে চিকেন বা বিফ সিজলারও দেখা যেত। সঙ্গে মিষ্টিজাতীয় কিছু সেভাবে না থাকলেও মিষ্টি পান বা মিছরি-মৌরি-ধনিয়া-চিনির রঙিন বল দিয়ে তৈরি মসলা দেওয়া হতো।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছুই বদলে যাবে সামনে। তবে বিয়ের খাবারের আবেদন যে কমবে না, তা বলা যায় নিশ্চিন্তে। একের পর এক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিয়েবাড়ির কাচ্চি আর পোলাওয়ের দোকানের প্রাচুর্যই বলে দেয় সেটা।
তথ্যসূত্র:
‘পুরানো ঢাকার হারানো দিন’/ মীর ফজলুল হক, সুবর্ণ, ২০১৫; ‘দেখা অদেখা ঢাকা’/ মুহাম্মাদ আরিফুর রহমান ও আহমেদ রাশেদ, কবি প্রকাশনী, ২০২৩; ‘ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি’/ সাদ উর রহমান, ঐতিহ্য, ২০১৬; ‘উৎসবের ঢাকা’/ সাদ উর রহমান, ঐতিহ্য, ২০১৮; ‘ষাট বছর আগের ঢাকা’/ সৈয়দ আলী আহসান, বাতায়ন প্রকাশন, ২০০৩; ‘ঢাকাই খাবার’/ হাবিবা খাতুন ও হাফিজা খাতুন সম্পাদিত, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১০; আন্তর্জাতিক রন্ধনশিল্পী সজীব মোহাম্মদের পারিবারিক স্মৃতিচারণা
ছবি: সংগ্রহ