skip to Main Content

টেকসহি I বই বৈভব

বইপ্রেমীদের জন্য আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারি মানেই মাসব্যাপী এক দারুণ আয়োজন। অমর একুশে বইমেলা। আন্তর্জাতিকভাবেও এ মাসে বই ঘিরে উদ্‌যাপন করা হয় এক বিশেষ দিবস

১৪ ফেব্রুয়ারি কী দিবস—এমন প্রশ্ন এলে সবার আগে ভালোবাসা দিবসের কথা মাথায় আসে অনেকের। কেউ কেউ হয়তো একধাপ এগিয়ে বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কিংবা সুন্দরবন দিবস। এত দিবসের দৌড়ে যদিও ভালোবাসা দিবসই এগিয়ে; তবে নিশ্চয়ই অনেকে জানেন, এই দিনের আরও একটি তাৎপর্যের গল্প। বিশ্ব বই প্রদান দিবস (ইন্টারন্যাশনাল বুক গিভিং ডে) হিসেবেও কিন্তু দিনটি পরিচিত। ভালোবাসার পাত্রে কেবল গোলাপ নয়, বইও যে অন্যতম অনুষঙ্গ, তা ছড়িয়ে দিতে পালন করা হয় দিবসটি। মূল লক্ষ্য, যত বেশি সম্ভব শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া, যা তাদের জ্ঞানার্জন, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করবে।
আমেরিকান সাহিত্যিক গ্যারিসন কেইলর বলেন, ‘বই এমন একটি উপহার, যা আপনি বারবার খুলতে পারেন।’ আসলেই তাই। বইয়ের দুই মলাটের আড়ালে যে বিস্ময় লুকিয়ে থাকে, তা বোধ হয় আর কোনো কিছুতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই তো ২০১২ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব বই প্রদান দিবস, যাকে বই উপহার দিবস হিসেবেও অভিহিত করা যায়। যুক্তরাজ্যের অ্যামি ব্রডম্যুর এই দিবসের প্রবর্তক।
ব্রডম্যুরের লক্ষ্য ছিল শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং তাদের এমন একটি দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, যেখানে বই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একসময় জন্ম নেয় বই উপহারের এক নীরব আন্দোলন। সেটি যুক্তরাজ্য থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ফ্রান্স, ইউক্রেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, নাইজেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়াসহ ৪৪টি দেশে বর্তমানে উদ্‌যাপিত হয় বই উপহার দিবস; প্রতিবছরই যার বিস্তার বাড়ছে। এই উদ্যোগে অংশ নিতে কোনো বড় প্রকল্প বা সংগঠনের প্রয়োজন পড়ে না। যে কেউ, যেকোনো জায়গা থেকে একটি বই দান করে অংশ নিতে পারেন এই অসামান্য আন্দোলনে।
বই যেহেতু ভালোবাসার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ, তাই হয়তো বইয়ের মাধ্যমে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিয়েছিলেন অ্যামি ব্রডম্যুর। তাই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভালোবাসার পাশাপাশি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সবচেয়ে সহজ ও সুন্দর উপায় হলো বই উপহার দেওয়া।
পৃথিবী বইয়ের হোক
বিশ্ব বই প্রদান দিবস পালনের লক্ষ্য পাঠাভ্যাসকে উৎসাহিত এবং বইয়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। আমরা একটি কথা প্রায়ই বলি, পৃথিবী বইয়ের হোক। আদতে কি তা হতে পেরেছে? ইউনেসকোর মতে, বিশ্বে কমপক্ষে ৭৭৪ মিলিয়ন মানুষ এখনো পড়া কিংবা লেখার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই এই দিবস শুধু পাঠকদের জন্য নয়, বরং এমন সকল মানুষের জন্যও, যারা এখনো বইয়ের আস্বাদ-আনন্দ গ্রহণ করতে পারেননি। তাই নতুন, ব্যবহৃত কিংবা ধার নেওয়া বই যত বেশিসংখ্যক শিশুর হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা খেয়াল রাখা এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য। স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগে দিনটি শিশুদের বই পাওয়ার সুযোগের বৃদ্ধি ঘটায় এবং তাদের মনে পড়ার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে। আমেরিকান লেখক নিল গাইমন বলেছেন, ‘বই দুর্দান্ত উপহার; কারণ, এর ভেতরে পুরো একটি পৃথিবী থাকে।’ তাই একটি বই উপহার দেওয়া মানে শুধু একটি বস্তু প্রদান করা নয়; বরং এটি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন অভিজ্ঞতা কিংবা এমনকি নতুন পৃথিবী উপহার দেওয়া।
আন্তর্জাতিক বই প্রদান দিবস আসলে সংহতির গল্প বলে। নিজের বাইরে অন্যের জন্য ভাবার গল্প বলে। দিবসটি লিখিত শব্দের শক্তি এবং এর জীবনে পরিবর্তন আনার ক্ষমতাকে উদ্‌যাপনের একটি চমৎকার উপলক্ষ; যা একদিকে সাক্ষরতার উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে এবং অন্যদের মধ্যে পড়ার প্রতি আজীবন ভালোবাসা সঞ্চারিত করতে পারে।
পালন পন্থা
বই প্রদান দিবস যেহেতু বই উপহার দেওয়ার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, দিনটির উদ্‌যাপন শুরু করতে পারেন বই উপহারের মাধ্যমেই। রম্য রচয়িতা ও ঔপন্যাসিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ তাই বই কিনে আরেকজনকে উপহার দিলে দেউলিয়া তো হবেনই না, বরং আরেকজনের হাসিমুখ দেখার সৌভাগ্য মিলবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তো সবকিছুই এখন ইন্টারনেটকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তাই এই যুগে হাতে হাতে বই দেওয়ার রেওয়াজ এই উৎসবের মাধ্যমেই কিন্তু টিকিয়ে রাখা যেতে পারে।
দিবসটি পালনের জন্য স্থানীয় লাইব্রেরি, স্কুল, শেল্টার বা কমিউনিটি সেন্টারে বই দান করতে পারেন। এটি অন্যদের জন্য সাহিত্য উপভোগের সুযোগ সৃষ্টি করবে। আমাদের অনেকের বাড়িতে পুরোনো বই আছে। নতুন বইয়ের পাশাপাশি যদি পুরোনো বইও দান করা যায়, তাতে বইয়ের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয় বৈকি কমে না। পাশাপাশি গণপরিসরে একটি বই রেখে আসতে পারেন। বাস স্টপেজ, রেলস্টেশন, ক্যাফে বা পার্কে রেখে যেতে পারেন বই। কে বলতে পারে আপনার রেখে যাওয়া একটি বই পথশিশুদেরও জ্ঞান অর্জনের নতুন পথ খুলে দিতে পারে!
বই কেবল কয়েকটি পৃষ্ঠা বা মুদ্রিত শব্দ নয়; এগুলো একেকটি কল্পনার জানালা, শেখার মাধ্যম এবং ক্ষমতায়নের হাতিয়ার। একটি বই উপহার পাওয়া মানে অনেক শিশুর জন্য একটি নতুন জগতের দরজা খুলে দেওয়া। গল্প তাদের নতুন সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত করায়, যা একই সঙ্গে সহমর্মিতা ও চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করে।
উপহার উপায়
প্রজন্মের হিসাবে আমরা এখন জেন-আলফা পেরিয়ে জেন-বেটা যুগে আছি। একুশ শতকের এক-চতুর্থাংশ পেরিয়ে যাওয়ার পর বই কেনা হয়তো অনেকের কাছে অপচয়ের নামান্তর! অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন যেকোনো উপলক্ষের উপহার ছিল বই। কালের পরিক্রমায় নতুন অনেক উপহারের ঝলক এসেছে, নানা বাহানায় কমেছে বই উপহার। মলাট উল্টিয়ে শুভেচ্ছাবার্তা লেখার দিনও কমে গেছে। তবে বইয়ের সঙ্গে একাত্মতা তৈরির সময়ের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এখনো সুযোগ আছে নানা চটকদার উপহারের আড়ালে বইয়ের আবেগ ছড়িয়ে দেওয়ার। তবে বই উপহার দেওয়ার জন্য কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি।
উপহারের জন্য এমন বই নির্বাচন করা শ্রেয়, যা প্রাপকের বয়স, পছন্দ ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মলাট উল্টে শুভেচ্ছাবার্তা লেখার দিন ফিরিয়ে আনতে পারেন উপহারের মাধ্যমে। মনের কথা সহযোগে বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে দিতে পারেন বিশেষ বার্তা। প্রযুক্তির উৎকর্ষ বাড়ার পর বইয়ের দুনিয়ায় যুক্ত হয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক লেখকের বই। দেশীয় সাহিত্যকে উৎসাহিত করতে উপহার হিসেবে বেছে নিতে পারেন স্থানীয় লেখকদের বই। তা যেমন একদিকে পাঠক আর লেখকের মধ্যে একটি বন্ধন তৈরি করবে, তেমনি বইয়ের জগতে খুলে দেবে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার।
হেঁটে হেঁটে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মতো একজন বইয়ের জাদুকর বাংলাদেশেও ছিলেন। নাটোরের পলান সরকার। আজ হয়তো তিনি নেই; কিন্তু বইদাদু কিংবা বইপ্রেমী নাম তার এখনো রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আলোর ফেরিওয়ালা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্য নিজের টাকায় বই কিনে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতেন। আবার পড়া বই ফেরত নিয়ে নতুন বই দিয়ে আসতেন নিজেই। নিজের বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছিলেন পাঠশালা। পলান সরকারের কাছে বই বিতরণের জন্য কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন পড়ত না। নিজ উদ্যোগেই নীরবে চালিয়ে গেছেন বই বিতরণের আন্দোলন।
পলান সরকার আজ জীবিত না থাকলেও বই বিলানো কিন্তু থেমে নেই। নাটোরে না হলেও পলান সরকারের উত্তরসূরি হিসেবে জামালপুরে বই বিতরণ এবং পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন আসাদুজ্জামান। পড়াশোনার খরচ চালাতে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করলেও বইয়ের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা থেকে তিনি নিজ জেলায় তৈরি করেছেন ১৬টি পাঠাগার। মানুষকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে নিজের বাড়ির বারান্দায়, রেলস্টেশনে, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তৈরি করেছেন পাঠাগারগুলো। বইয়ের ফেরিওয়ালা হিসেবে পরিচিত আসাদুজ্জামান মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েও বই পৌঁছে দেন।
মানসিক চাপ কিংবা বিষণ্নতা কমাতে বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। তাই বই নিজে পড়ুন, উপহার দিন। কে বলতে পারে, পাতা উল্টে পড়তে গিয়ে বই হতে পারে আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু!

 সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top