যাপনচিত্র I শিল্পসঙ্গে যুগলবন্দী
শেখ মোহাম্মদ মারুফ; ঢাকা ব্যাংক পিএলসির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তাবাসসুম হোসেন; উদ্যোক্তা। জানুয়ারি ২০০৫ থেকে তাদের দাম্পত্য জীবন। কেমন কাটে এই সফল দম্পতির একান্ত মুহূর্তগুলো?
পরিচয়ের গল্প
২০০৩ সালের কথা। দুজনেই তখন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে কর্মরত। সেখানেই পরিচয়। তাবাসসুম হোসেন বললেন, ‘অফিসে দীর্ঘ সময় কাজ করায় আড্ডা, লাঞ্চ বা ডিনার—সবই তখন সহকর্মীদের সঙ্গে হতো। মারুফ খুব মজার মানুষ, কিন্তু শুরুর দিকে তাকে একটু অপছন্দ করতাম। কারণ, তার রসিকতা কখনো কখনো ছিল খোঁচাযুক্ত। তবে ধীরে ধীরে আড্ডার মাধ্যমে তার সম্পর্কে জানলে, তাকে ভালো লাগা শুরু হয়। তার পরিবারকেন্দ্রিক মনোভাব, মানুষের ব্যক্তিসত্তার প্রতি তার সম্মানবোধ আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে। আমাদের মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারও অনেকটা একই।’
অন্যদিকে শেখ মোহাম্মদ মারুফের ভাষ্য, ‘লাইফ পার্টনার নির্বাচনে মূল্যবোধ ও পরিবারের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাবাসসুমের ব্যক্তিত্বে যে স্বকীয়তা ও আন্তরিকতা ছিল, তা আমাকে মুগ্ধ করে। বিয়ে এমনই হওয়া উচিত, যেখানে দুজন স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে একসঙ্গে পথ চলতে পারে।’
ছুটির দিনের আয়োজন
ব্যস্ততায় কাটলেও ছুটির দিনগুলো তারা বিশেষভাবে উদ্যাপন করেন। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কিংবা নিজ বাসায় আমন্ত্রণ—এভাবেই জমে ওঠে এসব দিন। সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন। তাবাসসুম ও মারুফ দুজনেই স্বাস্থ্যসচেতন। একসময় মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করার অভ্যাস ছিল। এখন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে লাঞ্চ এবং বিকেলে ঢাকার বিভিন্ন স্ট্রিট ফুডের স্বাদ নেন। মিরপুর, বসুন্ধরা, নীলক্ষেত বা পুরান ঢাকার জমজমাট খাবারের দোকানে ঘুরে বেড়ানো কিংবা নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাদের ভালো লাগে।
ভ্রমণ ও শিল্পচর্চা
২০০৫ সাল থেকে তারা প্রতিবছর একসঙ্গে একাধিক দেশ ভ্রমণ করেন। যেকোনো নতুন জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, জাদুঘর ও ইতিহাস তাদের ভ্রমণে গুরুত্ব পায়। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মারুফের বাসায় রয়েছে পেইন্টিংয়ের এক দারুণ সংগ্রহ। তিনি বললেন, ‘শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল; কিন্ত তখন কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেই সামর্থ্য যখন তৈরি হলো, তখন থেকে এই সংগ্রহের সূত্রপাত। চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত জাদুঘরগুলোতে ঘুরেছি। মিকেলাঞ্জেলো, দা ভিঞ্চি, ভ্যান গঘ ও সালভাদর দালির শিল্পকর্ম দেখা আমার কাছে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে।’
তাবাসসুমের ভ্রমণে গুরুত্ব পায় ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্য। ইতালির অলিগলির ঐতিহ্য কিংবা তুরস্কের নান্দনিকতা তাকে মুগ্ধ করে।
শখ ও পছন্দ
তাবাসসুম রান্না করতে ভালোবাসেন। তার ফেসবুক পেজ “টিনা’স ফ্লেভার ফ্যাক্টরি” ২০১২ সাল থেকে জনপ্রিয়। বিলুপ্তপ্রায় খাবার পুনরুদ্ধার কিংবা বিদেশি খাবারের ফিউশন করাই তার পছন্দ। অন্যদিকে, মারুফের শখ ট্রেকিং, হাইকিং ও ফিশিং। নেপালের মুক্তিনাথ, ভারতের সান্দাকফুতে কিংবা উত্তরাখন্ডের ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারসে ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা তাকে এখনো রোমাঞ্চিত করে।
আড্ডার পাশাপাশি অবসর সময়ে সিনেমা দেখতে, গান শুনতে আর গল্পের বই পড়তে ভালোবাসেন মারুফ। সিনেমা দেখার প্রতি ঝোঁক সেই ছোটবেলা থেকেই। সিনেমা দেখার নেশায় বন্ধুরা মিলে একসময় একটি ফিল্ম সোসাইটি গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮৮-৯০ সময়কালে দল বেঁধে গ্যেটে ইনস্টিটিউট, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে গিয়ে মুভি দেখতেন। উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য হেভি মেটাল, মোজার্ট, বেটোফেন—সব ধরনের সংগীতের প্রতিই তার সমান আগ্রহ ও ভালোবাসা। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি বিশেষ ভালো লাগা কাজ করে। পছন্দের শিল্পীদের মধ্যে আছেন কলিম শরাফী, সুবিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মান্না দে, কিশোর কুমার, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, ফ্রেডি মার্কারি, আন্দ্রেয়া বোসেলি, জোশ গ্রোবান, জন ডেনভার প্রমুখ। পছন্দ করেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, স্টিভেন স্পিলবার্গ, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, আকিরা কুরোসাওয়া, স্ট্যানলি কুব্রিক প্রমুখের মুভি দেখতে।
বাসার ইন্টেরিয়র
তাদের বাসার সাজসজ্জায় রয়েছে শিল্প, ঐতিহ্য ও স্মৃতির ছোঁয়া। ভিনটেজ ও ভিকটোরিয়ান স্টাইলের সিম্পল ফার্নিচার, পেইন্টিং, ট্রাভেল স্যুভেনির, কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য এবং প্রচুর গাছ বাড়ির পরিবেশকে করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর। পোষা দুটি পার্শিয়ান বিড়াল ‘ওটস’ ও ‘গ্রেনোলা’ তাদের পরিবারেরই অংশ।
পোশাক ও অনুষঙ্গ
অফিসে সব সময় স্যুট পরতে হয়, তাই বাইরে কখনোই স্যুট পরেন না মারুফ। পাঞ্জাবি-পাজামা বা জিনস তার প্রিয় পোশাক। পাঞ্জাবি-পাজামাকে খুবই সুন্দর এবং স্মার্ট পোশাক গণ্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই এই পোশাককে অফিশিয়াল পোশাক করলে অনেক ভালো হতো।’ অন্যদিকে শাড়ি তাবাসসুমের প্রিয় পোশাক; পেস্টাল রঙের জামদানি তার খুব প্রিয়। ঘড়ি ও গান শোনার যন্ত্রপাতির প্রতি মারুফের বিশেষ আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। তাবাসসুম পছন্দ করেন ট্র্যাডিশনাল জুয়েলারি ও ব্যাগ।
মূল্যবোধ ও দর্শন
মারুফ বিশ্বাস করেন, ‘মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অনুভূতিকে সম্মান এবং অন্যের স্বার্থে আঘাত না করে নিজের লক্ষ্য অর্জন করা উচিত। পারলে মানুষের উপকার করুন; কিন্তু অপকার নয়।’ তাবাসসুম মনে করেন, মানুষ ও সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা তার জীবনের উদ্দেশ্য।
দাম্পত্য জীবনের দুই দশকে তারা জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে একে অপরের সঙ্গী হয়ে আছেন, যা তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও অর্থবহ করে তুলেছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন