প্রাগৈতিহাসিক I মিসরীয় মিথ
মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন মিসর নানা কারণে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সে সময়কার অধিবাসীদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে চর্চা এখনো কম হয় না
প্রাচীন মিসরে খাদ্য ও পানীয়ের জন্য নীল নদের তীরে চাষ করা প্রাথমিক ফসল বার্লি ও গমের ওপর নির্ভর করা হতো। মিসরীয় খাদ্যের ভিত্তি মূলত ছিল রুটি, বিয়ার ও শাকসবজি। অন্যদিকে, মাংস ছিল দামি এবং খুব কম চলতি। অধিকাংশ মানুষ মোটামুটি মৌলিক খাবারের ওপর নির্ভর করতেন। তবে উচ্চবিত্ত শ্রেণির পাতে দেখা মিলত বিদেশি ও বৈচিত্র্যময় খাবারের সম্ভার।
রুটি ও পোরিজ
রুটি ও পোরিজ ছিল প্রাচীয় মিসরের অধিবাসীদের মূল খাবার। উভয় খাবারই সাধারণত মিসরের দুটি প্রধান ফসল বার্লি অথবা ইমার গম দিয়ে তৈরি। মিসরীয় রন্ধনপ্রণালিতে সমতল, শঙ্কু, গোলাকারসহ সম্ভাব্য সব আকারে রুটি তৈরির চল ছিল। রুটিকে কখনো কখনো বস্তু বা প্রাণীর আকারও দেওয়া হতো। মিষ্টি বা সুগন্ধের জন্য ময়দার সঙ্গে লুপিন বীজ, ধনিয়া, ডুমুরের একটি ক্বাথ, পোস্ত বা রাইগ্রাস বীজের মতো বৈচিত্র্যময় উপাদান যোগ করা হতো।
রুটির সবচেয়ে সাধারণ শৈলী ছিল ময়দা, লবণ ও পানি দিয়ে তৈরি। ময়দা সাধারণত বৃত্তাকার বা ত্রিভুজাকার আকারে গড়া হতো; তবে রুটিকে মানব বা প্রাণীর আকার দেওয়ার চলও ছিল। একে চুলার ভেতরে, পাথরে বেক করা যেত। রুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বিভিন্ন ধরন উদ্ভাবিত হয়েছিল। কয়েক ধরনের রুটিতে ময়দা ও পানির মৌলিক উপাদান ছাড়াও চর্বি, তেল, ডিম বা দুগ্ধজাত খাবার মেশানো হতো। আবার তুলতুলে রুটি তৈরি করতে লেভেনিং ব্যবহার করা হতো। বিভিন্ন আকার ও সামঞ্জস্য বজায় রেখে রুটি বেক করতে বিশেষ ধরনের ওভেন ও প্যান ব্যবহারের রেওয়াজ ছিল। বেক করার আগে কখনো কখনো রুটির ওপর জুড়ে দেওয়া হতো বীজ, মসলা বা বাদাম।
পানীয় প্রস্তুতি
প্রাচীন মিসরে বার্লি বিয়ার ছিল ‘জাতীয় পানীয়’! পানির পাত্রে রুটি ও চূর্ণ বার্লি গাঁজন করে সাধারণত বাড়িতেই তৈরি করা হতো। গাঁজন সম্পন্ন হলে ফিল্টারের মাধ্যমে ছেঁকে জারে রাখা হতো। ফলে পণ্যটি পুরুত্ব পেত এবং পুষ্টিকর হয়ে উঠত। এতে সাধারণত অ্যালকোহলের পরিমাণ কম থাকায় দিনভর পানের উপযুক্ত ছিল। অন্যদিকে, রেড বিয়ার ছিল হালকা ও কম অ্যালকোহলযুক্ত; আর ব্ল্যাক বিয়ার কড়া। স্বাদ উন্নত করতে কখনো কখনো ফল ও মসলা মিশ্রণের যোগ ঘটত। বিয়ার উৎপাদনের এই পদ্ধতি এখনো আধুনিক মিসর ও সুদানে চলতি রয়েছে।
ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য অংশের তুলনায় মিসরে আঙুরের ফলন এত সহজে হয়নি। তাই ধনী অভিজাতদের জন্য অল্প পরিমাণে ওয়াইন উৎপাদিত হতো। ওই ভূখণ্ডে ওয়াইন তৈরির প্রাচীনতম প্রমাণ মেলে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং তা প্রারম্ভিক রাজবংশীয় যুগের শুরুর আগে। কিছু ওয়াইন গ্রিস ও মেসোপটেমিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছিল বলে ইতিহাসসূত্রে জানা যায়।
মিসরীয় ওয়াইন মাটির পাত্রে আঙুরের গাঁজনের মাধ্যমে তৈরি করা হতো। গাঁজনসৃষ্ট গ্যাস বের করার জন্য ব্যবহৃত হতো ছিদ্রযুক্ত পাত্র। এই পাত্র মাটির সিল দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হতো। তাতে জুড়ে দেওয়া হতো ওয়াইনের উৎস, গুণমান এবং উৎপাদনের বছরসংক্রান্ত তথ্যাবলি। কখনো কখনো খেজুর, ডুমুর, ডালিম বা খেজুরের রস থেকেও ওয়াইন তৈরি করা হতো। শেদেহ নামে একটি কড়া ওয়াইনও তৈরি করা হয়েছিল একসময়। এর রং ছিল লাল; অ্যালকোহল উচ্চমাত্রার। তবে এটির প্রস্তুতপ্রণালি সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।
পোলট্রি ও ডেইরি
শিম ছাড়াও দুগ্ধজাত খাবার, ডিম ও হাঁস-মুরগি ছিল প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার অধিবাসীদের প্রোটিনের প্রাথমিক উৎস। কৃষকেরা দুধ, মাখন ও ক্রিমের জন্য গরু, ছাগল ও ভেড়া পালন করতেন। ছাগল ও ভেড়া গবাদিপশুর চেয়ে কম খরচে পালন করা যেত বলে দরিদ্র কৃষকদের কাছে পছন্দের ছিল।
চিজমেকিং সম্ভবত নব্য প্রস্তরযুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১০২০০-২৫০০) মিসরে প্রবর্তিত হয়েছিল এবং সে দেশের প্রারম্ভিক রাজবংশীয় যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩১৫০-২৬১৩) এর শিল্প বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন ধরনের শক্ত ও নরম পনির তৈরি করার কারণে প্রাচীন মিসরের চিজমেকিং শিল্প সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিশেষায়িত হয়ে ওঠে। প্রাচীনতম আবিষ্কৃত পনিরের নমুনাটি ১৯তম রাজবংশের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ১২৯২-১১৮৯) মিসরের প্রাচীনতম শহর মেমফিসের মেয়র পতাহেমসের সমাধিতে চিত্রিত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
বন্য ও গৃহপালিত পাখি ছিল প্রাচীন মিসরে মাংস ও ডিমের প্রাথমিক উৎস। স্বাস্থ্যবান হওয়ার লক্ষ্যে গিজ, সারস ও হাঁসের মাংস খাওয়ার চল ছিল। কবুতর ও ঘুঘুর মাংস উপাদেয় খাবার হিসেবে বিবেচিত হতো। প্রাচীন মিসরীয়রাও পেলিকান ও উটপাখির মাংস, ডিম খেতেন। বড় আকার ও চমৎকার ঘ্রাণের কারণে উটপাখির ডিম খাদ্যতালিকায় বিশেষভাবে মর্যাদার অর্থে রাখা হতো। অন্যদিকে, ধারণা করা হয়, দক্ষিণ এশিয়া থেকেই প্রাচীন মিসরে মুরগির আগমন।
মাংস ও সামুদ্রিক খাবার
প্রাচীন মিসরে অনেক গৃহপালিত পশুপালন করা হতো। এগুলোর মধ্যে ছিল গরু, ছাগল, গাধা, ভেড়া, হরিণ ও শূকর। প্রাণী বা দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদিপশু হিসেবে ব্যবহার করা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ছিল বলে মাংস খাওয়ার চল ছিল কম। তবে দেবতাদের কাছে নৈবেদ্য হিসেবে পশু বলিদানের রেওয়াজ ছিল। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫) ছাড়াও কিছু প্রাচীন সূত্রের দাবি, শূকরের মাংসের ব্যাপারে প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা যায়, শূকরের মাংস জনপ্রিয় ছিল না; তবে নিম্নবিত্তদের কেউ কেউ এই প্রাণীর মাংস খেতেন। এদিকে, কয়েকজন আধুনিক ইতিহাসবিদের মতে, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু পুরোহিত বা উচ্চ শ্রেণির মতো কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য ছিল। প্রাচীন মিসরে ওয়াইন্ড গেম মিট খাওয়ার চল ছিল। শিকার ছিল সমাজের উচ্চ শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত; তাদের সমাধি প্রায়ই শিকারের দৃশ্য দিয়ে সজ্জিত থাকত। গজেল, এন্টিলোপ ও জলহস্তীর মাংস সুস্বাদু হিসেবে বিবেচিত হতো এবং এসব প্রাণী মিসরের জলাভূমি ও তৃণভূমিতে পাওয়া যেত। এ ছাড়া হাঁস, গিজ ও কোয়েলের মতো গেম বার্ডও ছিল প্রচুর। ঈল নদী এবং হ্রদে মিঠাপানির মাছ, কার্প, ক্যাটফিশ ও ব্লু স্যামন পাওয়া যেত। গ্রে মুলেটের মতো উপকূলীয় মাছও জনপ্রিয় ছিল। মিসরের ঊষ্ণ জলবায়ু স্মোকিং ও ড্রাই মাছ সংরক্ষণের জন্য সহায়ক ছিল। এলিফ্যান্টফিশ, মিসরীয় ভাষায় মেজড ও গ্রিক ভাষায় অক্সিরিনকাস (তীক্ষ্ণ নাকযুক্ত মাছ) নামে পরিচিত। এই মাছকে খাবার হিসেবে পবিত্র বলে বিবেচনা করা হতো। পার-মেজড বা অক্সিরিনকাস শহরের নামানুসারে এর নামকরণ। প্রাচীন মিসরীয়রা মাছ ধরার জন্য সাধারণত জাল বা রড ব্যবহার করতেন।
মিষ্টি ও মিষ্টান্ন
কেক, পেস্ট্রিসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও মিষ্টান্ন খাওয়ার চল ছিল। এসবের মধ্যে প্রায়ই কাটা ফল, বাদাম বা মিষ্টি সিরাপ থাকত। প্রাচীন বিশ্বে মধু ছিল মিষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস। কারণ, তখনো দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রাচীন মিসরে আখ আমদানি করা হয়নি। মধু দামি হওয়ায় মিষ্টি হিসেবে খেজুর ও ক্যারোব (মটরশুঁটিবিশেষ) ব্যবহৃত হতো বেশি। মিষ্টান্ন তৈরিতে খেজুরের ময়দা ব্যবহারের চল এতই বেশি ছিল, পেস্ট্রি শেফদের ‘খেজুরের শ্রমিক’ (ওয়ার্কারস ইন ডেটস) নামে ডাকা হতো।
মিষ্টি স্বাদের টাইগার নাট মিষ্টিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। প্রাচীন মিসরের অষ্টাদশ রাজবংশের একজন উজিয়ার (ওটমান শাসনামলে উচপদস্থ ব্যক্তি) রেখমিরের (উচ্চবিত্ত মানুষের ব্যয়বহুল কবর) সমাধিটিতে মিসরীয় শিল্পের মাধ্যমে সজ্জিত টাইগার নাট কেক তৈরির চিত্র চিত্রিত ছিল। এই কেকগুলোকে সম্ভবত খেজুর ও মধুর সিরাপ দিয়ে পরিবেশন করা হতো, যা সমাধির দেয়ালে প্রস্তুত করার চিত্র দেখানো হয়েছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: সংগ্রহ