ফিচার I মৃত্যুদ্বারের খাদ্যসেবক
প্রাগুস্টেটর বা খাদ্য-স্বাদক। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর একটি। যত দূর জানা যায়, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে এ পেশার সূত্রপাত। প্রতিদিন কয়েকবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে খাদ্য পরখ করতে হতো বলে সহজে এ পদে কেউ চাকরি করতে চাইত না। তাই বাধ্য করা হতো। অবশ্য বেতন ছিল বেশ
প্রাচীন রোমে একধরনের চাকরি ছিল। পদের নাম প্রাগুস্টেটর। রাজা কিংবা সম্রাটের সামনে পরিবেশিত খাবারে কোনো বিষ মেশানো আছে কি না, তা পরখ করাই ছিল এই পদস্থ ব্যক্তিদের কাজ। এতে যেকোনো সময় প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকত। তাই ক্রীতদাসদেরই এমন কাজে নিয়োগ করতেন রোমান শাসকেরা। সেকালে বিষ প্রয়োগে সম্রাটদের হত্যা করা ছিল শত্রুপক্ষের একপ্রকার যুদ্ধকৌশল। ইতিহাসে এমন মৃত্যু অসংখ্য। রোমান সম্রাট ক্লদিয়াসকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। মৌর্য সম্রাজ্ঞী দুর্ধরা তার স্বামীর জন্য তৈরি খাবার খেয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আধুনিক যুগেও খাবার পরীক্ষা করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাতে তোলার রীতি চালু রয়েছে। অ্যাডলফ হিটলারের খাবার পরখকারী মারগট ভোল্ক রোজ সকাল ৮টায় খাদ্য চেখে দেখতেন। তা খেয়ে তিনি জীবিত থাকলে তবেই সেই খাবার হিটলারের পাতে দেওয়া হতো। ভ্লাদিমির পুতিনও একজন খাদ্য পরখকারী নিয়োগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ, রোনাল্ড রিগ্যানসহ সাম্প্রতিক বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টের খাবারের নিরাপত্তায়ও এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্রাচীনকালে শুধু খাবারই নয়, পানীয়ও পরখ করে দেখা হতো। ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত তুর্কি সিরিয়াল সুলতান সুলেমানের রসুইঘরে একজন খাদ্য পরখকারীকে দেখা যায়। ইউসুফ-জুলেখা সিরিজেও রাজার পাশে পানপাত্র হাতে একজন ভৃত্যের দেখা মেলে। তারা ক্রীতদাস হলেও এ কাজের বিনিময়ে তাদের প্রচুর অর্থ দেওয়া হতো।
প্রাণনাশের আশঙ্কা ছাড়াও এই পদে চাকরির আরও কিছু সমস্যা ছিল। রাজাদের কিছু খাবার ও পানীয়ের স্বাদ ছিল ভীষণ উৎকট ও বিশ্রী। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওসব চেখে দেখতে হতো পরখকারীদের। সম্রাটেরা তাদের বিশ্বস্ত কাউকে এ পদে নিয়োগ দিতেন।
মোগল আমলে, বিশেষ করে আকবরের সময়ে সম্রাটের কাছে খাবার পরিবেশনে বেশ কড়া নিয়ম মানা হতো। তার রাজকীয় রসুইঘরে থাকতেন একজন কোষাধ্যক্ষ এবং একজন গুদামরক্ষক। কয়েকজন কেরানি দিয়ে কাজ চালাতেন তারা। রান্নার কাজে একজন প্রধান পাচক থাকতেন, যাকে সঙ্গ দিতেন প্রায় ৪০০ জন রাঁধুনি। আকবরের রাঁধুনি হতে রীতিমতো পরীক্ষা দিতে হতো সেই আমলে।
অন্য অঞ্চলের রাজাদের মতো মোগলরাজদের মনেও বিষ মেশানো খাবার খেয়ে মৃত্যু ঘটার ভয় কাজ করত। ‘বাবর: দ্য ফার্স্ট মোগল ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, বাবরকে একটি ভোজসভায় বিষ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেখান থেকে প্রাসাদে ফেরার পর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কয়েকবার বমি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অবশ্য সেযাত্রায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে মোগল সম্রাটেরা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেন।
আকবরের রন্ধনশালায় খুব বিশ্বস্ত একজন খাদ্য পরীক্ষক ছিলেন। রসুইঘরের ভেতরে সব পদ একটু করে চেখে দেখতেন। খাদ্যে বিষ না থাকার বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলেও আরেক দফায় সেই পদগুলো চেখে দেখতেন রন্ধনশালার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। তাকে বলা হতো মির-বাকাওয়াল। মোগল আমলে এটি ছিল রন্ধনশালার সবচেয়ে সম্মানীয় পদ। বেতনও লোভনীয়।
সম্রাট আকবরের রোজকার খাদ্য মেনু ঠিক করতেন তার নিজস্ব হাকিম। তিনি ঋতু ও সম্রাটের শারীরিক অবস্থা বুঝে খাদ্যতালিকা তৈরি করতেন। সেই ফর্দ রাখা হতো ভীষণ গোপন। হাকিম ছাড়া অন্য কেউই তা জানত না। সূর্য ওঠার আগে ওই হাকিম সম্রাট আকবরের রন্ধনশালায় গিয়ে নির্দেশনা দিতেন। সেই অনুযায়ী তৈরি হতো সম্রাটের খাবার। সব ধরনের উপকরণ প্রস্তুত থাকত আকবরের গুদামঘরে। রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত রন্ধনশালায় হাকিম উপস্থিত থাকতেন। শুধু কি তাই, সম্রাটের খাবারে ঔষধি গুণ যুক্ত উপাদান থাকছে কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখতেন তিনি।
হাকিমের নির্দেশনায় সম্রাট আকবরের বিরিয়ানির চালের প্রতিটি দানায় সিলভার অয়েলের প্রলেপ দেওয়া হতো, যেন হজমে সমস্যা না হয়। এমনকি এ খাবার যেন সম্রাটের যৌনশক্তি বাড়ায়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হতো। সম্রাটের জন্য তৈরি খাবারগুলো মির-বাকাওয়ালের কড়া নজরদারিতে মসলিনের ব্যাগে ঢুকিয়ে সিল করা হতো। পরে একটি চৌকস দলের পাহারায় পাঠানো হতো প্রাসাদের ভোজনকক্ষে। এতে পাত্র পরিবর্তন কিংবা খাবারে বিষ মেশানোর কোনো সুযোগ থাকত না। সম্রাটের টেবিলে খাবারগুলো আনার পরই সেগুলো খোলা হতো।
এখানেই শেষ নয়, আকবর খাবার টেবিলে আসার পর মির-বাকাওয়াল আরও একবার প্রতিটি পদ কয়েক চামচ নিজের জিবে ফেলতেন। এরপর খাদ্য গ্রহণ শুরু করতেন সম্রাট। প্রাসাদের অন্যদের আকবরি খাবারের স্বাদ গ্রহণের অধিকার ছিল না।
ইতিহাসের আনাচে-কানাচে রাজা-সম্রাটদের হেঁশেলে সেবা দিয়ে গেছেন অনেক খাদ্য পরীক্ষক। তাদের ইতিকথা হয়তো সেভাবে ইতিহাসে লেখা হয়নি। তবে অ্যাডলফ হিটলারের একজন খাদ্য পরীক্ষক দশকখানেক আগে এসেছিলেন জনসমক্ষে। মারগট ভোল্ক। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, নিজের ৯৫তম জন্মদিন ঘিরে একটি সংবাদপত্রে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগপর্যন্ত কেউ তার সেই পরিচয় জানত না। মারগটের ভাষ্যমতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের বছরগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে হিটলারকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর। সঙ্গে ছিলেন আরও ১৪ তরুণী। আড়াই বছর ধরে খাবারের প্রতিটি গ্রাসের সঙ্গে মৃত্যুভয় তাড়া করেছে মারগটসহ বাকিদের। শত্রুরা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চক্রান্ত করছে—এই আতঙ্কে ভুগতেন হিটলার। তাই ১৫ জনকে দিয়ে খাবার পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
হিটলার ছিলেন নিরামিষাশী। বাজারের সবচেয়ে দামি শাকসবজি দিয়েই তৈরি হতো তার প্রতিদিনের খাবার। তবে প্রতিটি দানাতেই ছিল মৃত্যুভয়। প্রতিদিনই মারগটের মনে হতো, আজই হয়তো তার জীবনের শেষ দিন। মৃত্যুর দুই বছর আগে সেই ইতিহাস প্রকাশ করে গেছেন তিনি। আরও জানিয়েছেন, হিটলারের ফুড টেস্টার হওয়ার কিছু সুবিধাও ছিল। যুদ্ধ শেষের অভাব-অনটনের বছরগুলোতে অধিকাংশ জার্মান আধপেটা থাকলেও হিটলারের খাদ্য পরীক্ষক হওয়ায় প্রতিদিনই ভূরিভোজ হতো মারগটসহ ওই ১৫ তরুণীর।
আহমেদ শিবলী
ছবি ও চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট