skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I স্প্রিং স্পিরিট

পাতাঝরা শুষ্ক আবহাওয়া শেষে ঝিরঝির বাতাস আর ফুলের গন্ধ নিয়ে আগমন ঘটে বসন্তের। এমন সময়ে জুতসই খাদ্য বেছে নেওয়া শ্রেয়। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

প্রকৃতিপ্রদত্ত
ঋতুভেদে খাদ্যাভ্যাসেও আসে পরিবর্তন। প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যে। তীব্র শীত ও ঈষদুষ্ণ হাওয়ার লুকোচুরি খেলা চলে ফেব্রুয়ারিতে। মাসের প্রথমার্ধ থাকে শীতকালের দখলে, শেষার্ধ্ব বসন্তকালের। শীতলতা ও উষ্ণতার এমন মিষ্টিমধুর লড়াইয়ের দিনগুলোতে মানবদেহে কিছু রোগবালাই বাড়তি শক্তি নিয়ে মাথাচাড়া দিতে পারে। তাই এ সময়ে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন বিশেষ কিছু মেডিসিনাল ফুড।
শজনে
হাই মেডিসিনাল ইফেক্টের জন্য শজনেগুঁড়া বা মরিঙ্গা পাউডারের জনপ্রিয়তা বাড়বাড়ন্ত। নেপথ্যে প্রাথমিকভাবে ওজন কমানো বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকে বিবেচনা করা হলেও আরও কিছু রোগবালাই প্রতিরোধ বা নিরাময়ে এর ভূমিকা রয়েছে। জলবসন্ত, গুটিবসন্ত, হাম ইত্যাদি রোগ থেকে মুক্তি পেতে ডায়েটে রাখতে পারেন শজনে ফুল। একে বসন্তের সবচেয়ে উপাদেয় খাবার হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব। অন্যান্য ফুলের মতোই গাছে গাছে এ সময় শজনের ফুল সহজলভ্য। খাদ্য কিংবা পথ্য হিসেবে খেতে পারেন এই ফুলের বড়া কিংবা কারি।
নিমপাতা
ডিটক্সিফাই করতে পারলে শরীর যেমন বিষমুক্ত হয়, তেমনি সুস্থ সবল থাকে লিভার ও পাকস্থলী। সে ক্ষেত্রে মেডিসিনাল ইফেক্টসমৃদ্ধ কিছু হারবাল পাতে রাখা যেতে পারে এই বসন্তে। সকালে খালি পেটে খেতে পারেন নিমপাতার রস। এ ছাড়া এই পাতা হালকা ভেজে গুঁড়া করে নিয়ে ভাতের সঙ্গে কিংবা খালি পানিতে মিশিয়ে খাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের স্কিন ডিজিজ, অ্যালার্জি ও হাত-পা জ্বালা রোগ থেকে মুক্তি পেতে স্প্রিং ডায়েট হিসেবে রোজকার খাদ্যতালিকায় নিমপাতাকে জায়গা করে দিলে উপকার মিলবে।
মধু
হাঁচি, কাশির পাশাপাশি শ্বাসতন্ত্রের যেকোনো সমস্যা দূরীকরণে সুদূর অতীতকাল থেকে ঔষধি গুণের জন্য মধুর খ্যাতির শেষ নেই। বিভিন্ন ধরনের ফুল থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়। এই মিষ্টি তরল বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াল ও ভাইরাল অ্যাটাকের পাশাপাশি ডিহাইড্রেশন থেকে আমাদের শরীরকে সুরক্ষা দেয়, অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া কমায় এবং শরীর থেকে টক্সিক উপাদান বের করে দিতে সাহায্য করে। সে ক্ষেত্রে স্প্রিং ডায়েট হিসেবে সকালটা শুরু করা যেতে পারে হানি মিক্সড লিউক ওয়ার্ম ওয়াটার দিয়ে।
পুষ্টিপুষ্ট
শুষ্ক হাওয়ায় ধুলাবালু থেকেও হতে পারে নানা শারীরিক সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের এ সময় বাতাসে ধূলিকণা, ফুলের রেণু ওড়া বেড়ে যায়। অ্যালার্জির সমস্যা থেকে শুরু করে হাঁচি, কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখের নানাবিধ সমস্যা; যেমন চুলকানি ও চোখ লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বাড়ে। যারা অনেক বেশি সেনসিটিভ বা নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগছেন, তাদের নেওয়া চাই বাড়তি সতর্কতা। শরীরকে সময়োপযোগী রাখতে খাদ্যতালিকায় যুক্ত করা চাই কয়েকটি বিশেষ পুষ্টি উপাদান।
অ্যামাইনো অ্যাসিড
দেহে ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকলে যেকোনো ধরনের রোগ প্রতিরোধ করা তুলনামূলক সহজসাধ্য। বিভিন্ন ঋতুতে ফ্লু থাকে বিভিন্ন রকম। ইমিউনিটি পাওয়ার খারাপ থাকলে যেকোনো জীবাণুতেই সহজে ও দ্রুত সংক্রামিত হয়ে যাই আমরা। রেহাই পেতে, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা চাই পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড। সে ক্ষেত্রে মিল্ক ও মিল্ক প্রোডাক্টের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাছ, বাদাম, বীজ ও ডাল রাখতে পারেন ডায়েটে।
ভিটামিন এ
ফ্যাট সলিবল এই ভিটামিন মূলত একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। শীতের পরপর যে হালকা বাতাস বয়ে যায়, তাতে অনেকের ত্বকে পরিবর্তন আসে। ভিটামিন এ শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ত্বকের স্বাস্থ্যরক্ষা, টিস্যু গঠন, বিভিন্ন কোষের কাজসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন ধরনের ফলের রস; যেমন মাল্টা বা অরেঞ্জ জুস, ক্যারট জুস রাখা যেতে পারে।
সেলেনিয়াম
সাধারণত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন বা ফ্যাট ধরনের ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্টগুলোর প্রতিই আমাদের বেশ সচেতনতা থাকে। তা ভালো! তবে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টগুলোকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে ট্রেস এলিমেন্ট হিসেবে মানবদেহে সেলিনিয়ামের গুরুত্ব কম নয়। এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা স্প্রিং ডায়েটে বিশেষভাবে রাখা চাই।
এনার্জি বুস্টার
সাধারণত বসন্তকালীন যেসব রোগ আমাদের বেশি সংক্রমিত করে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সম্পন্ন খাবার প্রতিদিন পরিমিত গ্রহণের ফলে সেগুলোর প্রভাব যথাসম্ভব কমানো যায়।
রসুন
হাঁচি, কাশি, এমনকি অ্যাজমার মতো মারাত্মক শ্বাসযন্ত্র সমস্যার সমাধানেও সেই পূর্ব প্রচলিত মেডিসিনাল ফুড হিসেবে সবার প্রথমে নাম আসে রসুনের। এতে থাকা সেলেনিয়াম শ্বাসনালির প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এতে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এফেক্ট থাকায় গায়ে ব্যথা, হাঁচি-কাশির সমস্যা ইত্যাদি নির্মূলে উপকারী। তাই বসন্তে সুস্থ থাকতে সপ্তাহে ৩-৪ দিন ডায়েটে রসুনকে জায়গা করে দিতে পারেন। এটি রান্না করা ছাড়াও সকালে খালি পেটে বা ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সি ফিশ, কাঁকড়া, চিংড়িসহ অনিয়ন, ব্রাউন রাইস, ব্ল্যাক গ্রেপস ইত্যাদিও যথেষ্ট পরিমাণ সেলেনিয়ামের ভালো উৎস।
জুকিনি
শসার মতো দেখতে ফাইবার, ওয়াটার, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ফোলেট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর জুকিনি রাখতে পারেন ডায়েটে। শীতের পরপরই হঠাৎ আবহাওয়ার উষ্ণতায় অনেকের হজমে গন্ডগোল দেখা দেয়। এ সময়ে অনেক ধরনের সবজির সহজলভ্যতা কমে যাওয়ায় জুকিনি হতে পারে বেস্ট চয়েস। ডায়েটারি ফাইবারসমৃদ্ধ এই সবজি পেটের নানাবিধ সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে হজমক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। অন্ত্রের স্বাস্থ্যকেও ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া এতে বিটা ক্যারোটিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের কোষকে শক্তিশালী করে এবং ত্বককে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে সুরক্ষা দিয়ে তারুণ্য ধরে রাখার মাধ্যমে আমাদের রাখে এভারগ্রিন!
তারুণ্যের তরে
প্রকৃত অর্থে যেকোনো ঋতুতেই থাকা চাই সুস্থ সবল দেহ; আর তার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইল। মনে রাখা চাই, এলোমেলো জীবনযাপন কখনোই সুস্থ দেহ বা মনের জন্য উপযুক্ত নয়। সুস্থ থাকতে এবং তারুণ্য ধরে রাখতে সেই অনুযায়ী খাবার গ্রহণ জরুরি। সে ক্ষেত্রে শরীরকে ভেতর থেকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতে কিছু পরামর্শ মেনে চলতে পারেন।
 ফাল্গুনে নিজেকে হাইড্রেট রাখতে পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন নানা রকম ফলের জুস বা শরবত; অবশ্যই তা প্যাকেটজাত না হয়ে প্রাকৃতিক হওয়াই অধিক স্বাস্থ্যকর।
 ত্বক ও চুল প্রতিদিন পরিষ্কার রাখা চাই। স্কিনের অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনে বাড়তি কিছু চুলের যত্ন এমনকি ফেশিয়াল ও স্পা করতে পারেন।
 পোশাক বাছাইয়েও সচেতনতা জরুরি। পরপর একাধিক দিন একই পোশাক না পরে প্রতিদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ড্রেস সিলেক্ট করা শ্রেয়।
 ইয়োগা বা হালকা এক্সারসাইজের মাধ্যমে ফিটনেস দারুণভাবে ধরে রাখা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সারা দিনের এনার্জি বুস্টার হিসেবে খোলা বাতাসে ১০-১৫ মিনিট হালকা এক্সারসাইজ করে নিতে পারেন।
অবশ্য এই সুন্দর বসন্তে প্রপার গাইডলাইন গ্রহণের জন্য ত্বক বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া মঙ্গল।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top