আলাপন I অমর হওয়ার জন্য লিখি না -ইমদাদুল হক মিলন
স্বাধীনতা-উত্তর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় বাঙালি লেখকদের মধ্যে ইমদাদুল হক মিলন অগ্রগণ্য। সম্প্রতি এই তারকার মুখোমুখি হন চঞ্চল আশরাফ ও অতনু সিংহ। সেই আড্ডায় উঠে এসেছে এই লেখকের তারকা হয়ে ওঠার গল্প, সাহিত্যের বিষয়আশয়, প্রেম ইত্যাদি। তুলে ধরা হলো তারই অংশবিশেষ
ক্যানভাস: আপনার লেখকজীবনের শুরু নিয়ে আমরা আলাপ আরম্ভ করতে পারি।
ইমদাদুল হক মিলন: লেখক হবো, ঠিক এমন চিন্তা থেকে লেখকজীবন শুরু হয়নি। আমরা পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় থাকতাম। সেখানকার জগন্নাথ কলেজে তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। একটা পাঠাগার ছিল, তার নাম হচ্ছে সীমান্ত গ্রন্থাগার, কলেজ থেকে বাসায় ফিরে ওই পাঠাগারে বই পড়তে যেতাম, খেলাধুলা করতাম না। বই পড়া একটা নেশার মতো ছিল। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। ছোটবেলায় আমি থাকতাম নানির কাছে। বিক্রমপুরে মেদিনীম-ল বলে একটি গ্রাম আছে, এই গ্রামটা হচ্ছে এখন যেখানে পদ্মা সেতু হচ্ছে, সেই মাওয়ার ঠিক আগের গ্রাম। আমার ১০টা ভাইবোন ছিল, মা তাদের সামলাতে পারতেন না বলে আমাকে মেদিনীম-ল গ্রামে নানির কাছে রেখে এসেছিলেন। মা বাবা ও অন্য ভাইবোনেরা ঢাকাতেই থাকতেন। নানির কাছে যখন থাকতাম, তখন নানি আমায় নানা রকম রূপকথার গল্প পড়ে শোনাতেন। এর ফলে গল্পের প্রতি, কাহিনির প্রতি, বইয়ের প্রতি ওই বয়সেই আমার একটা আগ্রহ জন্মেছিল। নানার বাড়িতে কিছু রূপকথার বইটই ছিল। তো এইভাবে আমার পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠার পর আমি যখন ঢাকা শহরে এলাম, তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলাম। বই পড়ার নেশা থেকেই আমাদের বাসার পাশেই সীমান্ত পাঠাগারে যাওয়া শুরু করলাম। সেখানে প্রায়ই একজন তরুণ লেখক আসতেন। তিনি তখন আমার বয়সী বা আমাদের থেকে এক-দুই বছরের বড়। তখন তাঁর লেখা বিভিন্ন পত্রিকার ছোটদের পাতায় ছাপা হতো। যেমন ধরুন চাঁদের দেশ, সাত ভাই চম্পা- এ ধরনের ছোটদের পাতায় যখনই তাঁর লেখা ছাপা হতো, তিনি সেই লেখাটার পেপার কাটিং নিয়ে আসতেন। আমার মনে হতো কেমন যেন অহংকার করে তিনি আমাদের ওই লেখাগুলো দেখাচ্ছেন। তখন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল প্রচুর বই পড়লেই লেখক হওয়া যায়। এই চিন্তা থেকেই লেখা শুরু। একটা গল্প লিখি। গল্পটা ছোটদের। তখন পুরান ঢাকায় প্রচুর বাঁদর ছিল। সাধনা ঔষধালয় যেখানটায়, তার কাছেই আমাদের বাড়ি। ওই এলাকায় তখন প্রচুর বাঁদর ছিল। আমার ছোট ভাইয়ের আবার একটা বাঁদরের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব ছিল। একটা বাঁদর প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো, তার হাতটা একটু ভাঙা, সে আমার ভাইয়ের হাত থেকে রুটি, কলা এসব নিয়ে খায়। এই দৃশ্যটা দেখার পর মনে হলো এটা নিয়ে একটা গল্প লেখা যায়। ওই নিয়ে আমার প্রথম গল্পটা লিখলাম, গল্পটার নাম ছিল বন্ধুত্ব। ১৯৭৩ সালের কথা বলছি, তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। তো ওই গল্পটা কীভাবে কোথায় পাঠানো যায়, তা দুয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন পূর্বদেশ নামের একটা পত্রিকা বের হতো। অবজারভার হাউজ থেকে। আমি একটা পত্রিকা জোগাড় করে ডাক মারফত গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম। এবং বিস্ময়করভাবে পরের সপ্তাহে লেখাটা ছাপা হয়ে গেল। খবরের কাগজে আমার নাম ছাপা হয়েছে, লেখা ছাপা হয়েছে, অনেকগুলো পত্রিকা কিনে নিলাম। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করলেন না যে, ওটা আমারই লেখা। আমাদের পরিবারের অনেকে বিশ্বাস করল, অনেকে আবার বিশ্বাস করল না। এর ফলে আমার একটা জেদ চেপে গেল, যে আমায় বিশ্বাস করাতে হবে যে আমি লিখতে পারি। ১৯৭৪ সাল নাগাদ একটা বড়দের গল্প লিখে ফেললাম, গল্পটার নাম হচ্ছে শঙ্খিনী। এই গল্পটা অনেকগুলো কাগজে পাঠালাম। তখন ফটোকপি করাও সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই হাতে অনেকগুলো কপি করে বেশ কয়েকটা কাগজে পাঠিয়ে দিলাম। সে লেখা ছাপা হলো কি না যখন খবর নিতে গেছি, সাহিত্য সম্পাদকেরা খুব গালাগাল করলেন। বললেন, এটা কোনো লেখা হয়েছে? এই গালিগালাজের কারণ, গল্পটা এক কিশোরের সঙ্গে তার ফুফুর প্রেমের সম্পর্ক হতে যাচ্ছে এমন বিষয়কে নিয়ে…। তখন কলকাতা থেকে দেশ পত্রিকার মতো আরেকটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। পত্রিকাটার নাম অমৃত। ‘অমৃত’ পত্রিকার ঠিকানায় আমি গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম। এখানেও আমার সৌভাগ্য যে পরের সপ্তাহেই গল্পটা ছাপা হলো এবং ঠিক এডিটোরিয়াল পেজের পরেই। এটা ছাপা হওয়ার পর আমার বিশ্বাস হলো যে আমি আসলে লিখতে পারি।
ক্যানভাস: আপনার কথাসাহিত্যে দেখা যায়, সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ আপনার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘নিরন্নের কাল’ অথবা ‘শবমেহের’কে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘টোপ’। আরেকটা ‘নূরজাহান’। আমরা দেখি যে এ ধরনের রচনায় দায়বদ্ধতার চাপ কাজ করে। তো সেই চাপে শিল্পমান ক্ষুণœ হওয়ার একটা ঝুঁকিও থাকে। এই ঝুঁকি আপনি কীভাবে মোকাবিলা করেন?
ইমদাদুল হক মিলন: আপনারা সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে শিল্পমানের বিষয়টির কথা টেনে আনলেন। এই ব্যাপারে আমি বলব, একজন লেখক যখন তাঁর দেশ বা সমাজ নিয়ে ভাববেন, তখন তার সময়কার সমাজে বা দেশে যে বড় ঘটনা ঘটছে, সেটা তাঁর লেখায় অবশ্যই আসা উচিত। কোনো লেখক হয়তো সেটা লেখার জন্য অপেক্ষা করেন। যেমন দেশভাগ নিয়ে এখনো লেখা হয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়। শবমেহের নিয়ে উপন্যাস লেখার সময় আমার মনে হয়েছে, ১২-১৩ বছরের কিশোরী মেয়ে দালালদের খপ্পরে পড়ে পতিতালয়ে এসেছে কিন্তু সে পতিতা হবে না, এটা তার প্রতিজ্ঞা। তাকে নানাভাবে টর্চার করা হচ্ছে কিন্তু তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, সে পতিতা হবে না। মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায়। এই ঘটনা আমাদের সমাজে একটা বড় ধাক্কা। আমাদের গ্রামের মেয়েরা এভাবে নানা খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়, তাই আমি ওই ঘটনাটি নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলাম। এক-দুই বছরের মধ্যে ওই ঘটনাটি ধরার চেষ্টা করেছিলাম আমার মতো করে। প্রত্যেক লেখকেরই নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আমি লেখার চেষ্টা করেছি। উপন্যাসটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।… নূরজাহান মৌলবাদীদের শিকার হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ’৯৪ সালে। সিলেটের কমলগঞ্জ থানায়, ওখানকার আঠারো বছরের একটি মেয়ে, ওই মেয়েটির প্রতি গ্রামের মসজিদের ইমাম মান্নান মওলানার বাজে দৃষ্টি ছিল। সেই কারণে গরিব দিনমজুর মা-বাবা মেয়েটিকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়। কিছুদিন পর তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেল। রীতি অনুযায়ী, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে নব্বই দিন ছেড়ে থাকে, তাহলে সেটা তালাক হয়ে যায়। মেয়েটি তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু সমাজের নানা কুদৃষ্টি তার ওপর পড়ে। ফলে তার বাবা-মা তাকে আরেকটা বিয়ে দেয়। প্রথম স্বামী ছেড়ে যাওয়ার ৯ মাস পর তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তখন ওই মান্নান মওলানা একটা ফতোয়া জারি করে যে বিয়েটা বৈধ নয়। মসজিদের ইমামের কথাই যেহেতু গ্রামের আইন, তাই গ্রামবাসী তার কথা মেনে নিল। মওলানা ফতোয়া জারি করল, মেয়েটিকে মাটির গর্তে পুঁতে এক শ একটি পাথর ছুড়ে মারা হবে। এবং তার বাবা-মা- স্বামীকে এক শ একটি করে বেত্রাঘাত করা হবে। মেয়েটি এভাবে ফতোয়ার শিকার হলো। এই অপমানে সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনাও আমাদের সমাজকে ধাক্কা দিয়েছিল। আমি আমার উপন্যাসে এই ধাক্কাটা ধরার চেষ্টা করেছি। এই উপমহাদেশে মৌলবাদের প্রথম শিকার হন নারীরা, আমি এই বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। এই ঘটনা ঘটেছিল সিলেটে, কিন্তু সিলেটের গ্রামজীবন, সেখানকার ভাষা ইত্যাদি যেহেতু আমার জানা নেই, তাই আমি উপন্যাসের পটভূমি সিলেটের বদলে বিক্রমপুরে নিয়ে এলাম। কারণ, বিক্রমপুরে আমি জন্মেছিলাম, সেখানকার মানুষের জীবনযাপন, খুঁটিনাটি বিষয়ে আমি অবগত। তিন পর্বে উপন্যাসটি লিখেছিলাম। আঠারো বছর সময় লেগেছিল। উপন্যাসটি পাঠক মহলে সাড়া ফেলেছে। পাঠক গ্রহণ করবেন কি বর্জন করবেন, সেই চিন্তা নিয়ে আমি লিখি না। অমরত্বের জন্যও আমি লিখি না।
ক্যানভাস: দুই বাংলার কোন কোন সাহিত্যিক আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
ইমদাদুল হক মিলন: একজনের কথা খুব বেশি করে বলতে পারি। তিনি হলেন সমরেশ বসু। আমাদের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে সমরেশ বসুকে আমার খুব বড় লেখক বলে মনে হয়। কী কারণে এমনটা মনে করি সেটা বলি। তখন লিখে জীবনধারণ করাটা ছিল একপ্রকার অসম্ভব। এমন এক সময় সমরেশ বসু তাঁর জীবনধারণের জন্য অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে লেখালেখিকে বেছে নিয়েছিলেন। যেহেতু তাঁকে লিখে রোজগার করতে হবে, সেহেতু তিনি প্রচুর বাজার চলতি লেখা লিখলেন। পাশাপাশি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেতে পারে, এমনও লেখা তিনি প্রচুর লিখেছেন। যেমন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’। তারপর ‘বি টি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতী কাফে’, ‘বাঘিনী’, ‘গঙ্গা’। আবার এর ফাঁকে লিখলেন তুলনামূলক হালকা লেখা ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘ছুটির ফাঁদে’। আবার কালকূট নামে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সমস্ত লেখা তিনি লিখেছেন। ‘কোথায় পাবো তারে’ কিংবা ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’র মতো লেখার কোনো তুলনা হয় না। এই লেখক আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। সচ্ছলতার জন্য লেখার পাশাপাশি ‘নূরজাহান, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’র মতো উপন্যাসও আমায় লিখতে হবে, এই বিষয়টা আমি সমরেশ বসুর থেকেই শিখেছি।
ক্যানভাস: ফর্ম এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তো ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ইমদাদুল হক মিলন: বাংলা সাহিত্যে ফর্ম নিয়ে সবচেয়ে বেশি এক্সপেরিমেন্ট করেছেন কমলকুমার মজুমদার। তিনি পুরো উল্টো একটি স্রোতের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আরও অনেকের কথা বলতে পারি। এদের ক্ষেত্রে বিষয়ের থেকে আঙ্গিক নানা সময় গুরুত্ব পেয়েছে। আমিও ফর্ম নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। এক্সপেরিমেন্টটা কী রকম, তার উদাহরণ দিই। প্রায় ৩০ বছর আগে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম ‘বনমানুষ’ নামে। এই উপন্যাসের গোটাটাই আমি সংলাপের মাধ্যমে লিখেছিলাম। তিনটি পার্টে। পারিবারিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে এবং গহিন অরণ্যে কীভাবে ভাষা ব্যবহার বদলে যাচ্ছে, তা আমি তিনটি পার্টে তিন ধরনের ভাষাবিধির সংলাপ ব্যবহার করে লিখেছিলাম। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও অনেক পরে এমন সংলাপনির্ভর লেখা লিখেছেন। এ ছাড়া আমি হাজাম গোষ্ঠী নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। হাজাম গোষ্ঠী মুসলিমদের মধ্যে বেশ প্রান্তিক, অথচ খৎনা করানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতির একটি কাজ তারা করে থাকে। আমি তাদের নিয়ে বুনেছিলাম নিজেদের পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সেই গল্প। তাতে মূল চরিত্র তার নিজের বয়ানেই গল্পটা বলছেন। এই গোটা উপন্যাসে বিক্রমপুরের ডায়লেক্ট ব্যবহার করেছিলাম।
ক্যানভাস: আপনি কলকাতায় বেশ জনপ্রিয়, কিন্তু নিরপেক্ষভাবে আপনার কি এটা কখনো মনে হয়েছে, বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের ধারা যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা নানা সময় এমন একটা ভাব দেখায় যে তারাই বাংলা সাহিত্যের মূল কেন্দ্র? কলকাতার যে এই ব্যাপারে একটা আধিপত্যবাদী মনোভাব আছে, এটা কি অস্বীকার করবেন?
ইমদাদুল হক মিলন: এটা ঠিক যে দেশভাগের আগে থেকে কলকাতা বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র ছিল। এই বাংলার নানা লেখক যেমন ধরেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা সমরেশ বসু, এরা তো সবাই এই বাংলার লেখক, পরে তাঁরা কলকাতায় গিয়ে লেখালেখি করেছেন। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানে লেখালেখির প্রকাশনার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটটি ছিল। পত্রপত্রিকা, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদি তুলনায় অনেক কম ছিল। কলকাতা পরেও বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র থেকে যাওয়ার এটা একটা কারণ বলে আমি মনে করি। আমাদের সব লেখকই কলকাতানির্ভর ছিলেন। যেমন ধরুন, জসীমউদ্দীনের সব বই কলকাতা থেকে বেরিয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের নিজস্ব একটা চেহারা আমরা পেতে লাগলাম। যদিও তার আগে থেকেই শামসুর রাহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস- এ রকম কিছু লেখক আমাদের ছিলেন। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রটি যখন আমরা পেলাম, তখন প্রচুর পত্রিকা বেরোতে লাগলো, প্রকাশনা সংস্থা তৈরি হলো, ধীরে ধীরে আমরা পায়ের তলায় একটা শক্ত মাটি পেলাম। কিন্তু কলকাতায় যে ব্যাপার বহু বহু বছর ধরে চলে আসছিল, সেটা কলকাতা সহজে ভুলতে পারছিল না। তার ফলে তাদের মনে এ রকম ভ্রান্ত ধারণা হয়তো কাজ করেছে যে বাংলাদেশে এখনো সেভাবে সাহিত্য বা তার পরিকাঠামো ডেভেলপ করেনি। কিন্তু যখন কলকাতা বইমেলায় ধীরে ধীরে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন বাড়তে লাগলো, তারপর থেকে কলকাতায় কিন্তু আমাদের কদর বেড়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেনরা আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতার বাজারে আমাদের বড় লেখকদের বই প্রচুর পাওয়া যায়। আমার পঞ্চাশটি বই বেরিয়েছে আনন্দবাজার থেকে।
ক্যানভাস: মাল্টিমিডিয়া, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মুদ্রণ মাধ্যমের সামনে কতোটা চ্যালেঞ্জ এসেছে বলে আপনি মনে করেন?
ইমদাদুল হক মিলন: ডিজিটাল লাইফের কারণে আমরা বই থেকে ধীরে ধীরে সরছি। যদিও আমি বিশ্বাস করি, মানুষ আবার বইয়ের কাছেই ফিরবে। যেহেতু ডিজিটাল জগতের একটা ধাক্কা এসে লেগেছে আমাদের ওপর, এই ধাক্কাটা কাটাতে অনেকটা সময় লাগবে। কিন্তু ধাক্কা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। তবে আমাদের এখানে কেউ যদি লিখে জীবনধারণ করতে চান, তাঁকে টেলিভিশন, ফিল্মের স্ক্রিপ্ট, নিউজ মিডিয়া- এসবের ওপরেও নির্ভর করতে হয়। মৌলিক সৃজনশীল লেখালেখি করে এখানে বেঁচে থাকা দুষ্কর। সেটা নিয়েও ভাবা দরকার। আর আপনারা যে চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন, সেই চ্যালেঞ্জকে নিয়েই তো এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, নানা ধরনের ই-বুক বের হচ্ছে, সেটা একভাবে পাঠকের কাছে যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, যতই আধুনিক প্রযুক্তি আসুক, মানুষ শেষমেশ আদিতেই ফেরে।
ক্যানভাস: আপনি তো অনেক প্রেমের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, আপনি প্রেমকে কীভাবে দেখেন?
ইমদাদুল হক মিলন: প্রেমের চেয়ে আশীর্বাদ মানুষের জীবনে আর কিছু নেই। যে মানুষ প্রেম পাননি, তার চেয়ে হতভাগ্য আর কেউ নেই।
ক্যানভাস: আপনার প্রথম প্রেম?
ইমদাদুল হক মিলন: সাহিত্যের আলোচনায় এসব থাক।
ক্যানভাস: আচ্ছা, এখনো প্রেমে পড়েন?
ইমদাদুল হক মিলন: প্রেমে পড়ি। আচ্ছা, প্রথম প্রেমের বিষয়টা বলি। ওই কিশোর বয়সে প্রেমের অনুভূতি তো এক রকম। যা-ই হোক, আমি আমার এক খালার প্রেমে পড়েছিলাম। আমার মায়ের মামাতো বোন সেই খালা। আমার মনে হতো, ওই খালার চেয়ে সুন্দরী পৃথিবীতে আর নেই। প্রথম প্রেম বললে সেটাই। আমার সেই খালা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে ফ্লোরিডায় থাকে, এখনো অসামান্য সুন্দরী সেই খালা।
ক্যানভাস: আপনার খালার সঙ্গে প্রেমের অনুষঙ্গই কি আপনার প্রথম জীবনের গল্পের মধ্যে এসেছিল?
ইমদাদুল হক মিলন: হ্যাঁ, বলতে পারেন। তবে খালা নন, উনি ফুফু। সেখাওে একটা ভালো লাগার ব্যাপার তৈরি হয়েছিল। আসলে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সমাজে প্রথম প্রেমের আকর্ষণ কিন্তু তৈরি হয় নিকট কোনো আত্মীয়ের প্রতিই। কারণ, ওই বয়সে গ-িটা অনেকটা ছোট থাকে।
ক্যানভাস: বাংলা ভাষার কোন পাঁচটি উপন্যাস আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ?
ইমদাদুল হক মিলন: এভাবে গুনে গুনে বলতে পারবো না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা, বিভূতিভূষণের ইছামতী আর সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াই চরিত মানস। এর পাশাপাশি আখতারুজ্জামানের চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা এবং ওয়ালীউল্লাহের লালসালু তো রয়েছেই।
ছবি: আশরাফ শাজাদ