ফিচার I সাংহাইয়ের পথনাশতা
কোনো শহরে যাওয়া মানে কেবল ঘোরাঘুরি নয়; স্থানীয় খাবারের স্বাদও নিতে হয়। সাংহাই ঘুরে সেখানকার নাশতার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তারকা শেফ শুভব্রত মৈত্র
আমি চীনা পদ রান্না করি বছর পাঁচেক ধরে। চা জন চৈনিক শেফের কাছেই রান্নার তালিম আর তাদের তত্ত্বাবধানেই কাজটি করি। তাই চীনে যাবার সুযোগ এলে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। আমি ও আমার তিন সফরসঙ্গীর জন্য এই ভ্রমণ ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। তবে আমি শহরটাকে ঘুরে দেখেছি একেবারে স্থানীয়দের মতো করেই, পর্যটক হিসেবে নয়। প্রথমেই আসা যাক অ্যানিসের কথায়। তার সঙ্গে আমার দেখা ও পরিচয় পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। তা বেশ আগেই। সে সাংহাইয়ের মেয়ে। ওকে আমি চিনি ফেসবুক থেকে। দেখা হয়েছিল একবার, তা-ও অনেক দিন আগে। আমাদের যাওয়ার খবর জানালে সে তো একবারে আহ্লাদে আটখানা। আমার এক্সাইটমেন্টও কম ছিল না।
তারপর এক বিকেলে আমরা পৌঁছে যাই সাংহাই। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হোটেল। সময় নষ্ট করতে আমরা রাজি নই। তাই চেক ইন করেই বেরিয়ে পড়ি। সাংহাই ভীষণ প্রাণচঞ্চল শহর। সেটা টের পাওয়া যায় এয়ারপোর্ট থেকেই। এই প্রাণময়তা আমি অনুভব করেছি দৃশ্য, শব্দ, বর্ণ, গন্ধ- সবেতেই।
সাংহাইয়ের প্রাণবন্ত ও আধুনিক জীবনধারা আমার মন জয় করে নিয়েছে। ওদের ঐতিহাসিক জলবিহার কেন্দ্রে পৌঁছে তো আমি মুগ্ধ। একে বলে বুন্ড। এটা ১ হাজার ৫০০ মিটার দীর্ঘ। এখানকার আধুনিক আর ঔপনিবেশিক আমলের বাড়িগুলোর সহাবস্থান চিত্তাকর্ষক।
এটা অবস্থিত হুয়াংপু নদীর দুপাশে। এপারে পুরোনো সাংহাই। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়িগুলো বহন করছে অতীত দিনের চিহ্ন। অন্য পারে আধুনিক আর অভিজাত সাংহাই। পুডং নামের এই নবীন এলাকা ব্যয়বহুলও। তুলনায় পুক্সি এলাকার বাড়িঘর পুরোনো, ফরাসি প্রভাবিত। সেখানে অপ্রশস্ত রাস্তার ধারে ছোট ছোট দোকান আর রেস্তোরাঁ। দেখলাম, এটাও কম ব্যয়বহুল নয়। স্যুভেনির শপগুলো চমৎকার। দেখতে বেশ লাগলেও হাত দেওয়া দায়।
সাংহাই, একটি বন্দরনগর। কিন্তু কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। সারি সারি বাস। সময়মতো আসছে আবার ছেড়ে যাচ্ছে। ফুটপাতের পাশে ফুটে থাকা লিলি শহরের সৌন্দর্য বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। সেই মধ্য উনিশ শতক থেকে এখানে এসেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ। ফলে তাদের রুচি ও ভাবনার ছাপ স্পষ্ট এই নগরীর স্থাপত্যে, শিল্পে, যাপনে।
সাংহাইয়ের সূর্যাস্ত দেখার মতো। নানা প্রান্তের হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় তা দেখতে। বুন্ডে এসে গোধূলির আকাশরেখা দেখা এক অভিজ্ঞতাই বটে। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা কল্পনাও করতে পারি না সেই ১৮৪০-এ কী ছিল এখানকার অবস্থা। কর্দমাক্ত, সরু রাস্তায় ভরা। অথচ কীভাবে বদলেছে এই শহর সময়ের সঙ্গে! একসময় এটা ছিল ব্রিটিশদের অধীনে। আঠারো শ ছেচল্লিশের দিকে পরিণত হয় বাণিজ্যকেন্দ্রে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকে বুন্ড।
এখানে এলে চারপাশের দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। নানা রঙের ফুলে ফুলে পূর্ণ বুন্ড দেয় অন্য এক ধরনের মুগ্ধতা। পুডংয়ের দিকে ফিরে দাঁড়ালে পেছনে থাকবে সারি সারি অট্টালিকা। এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির ভরকেন্দ্র। কয়েক শ বছর ধরেই। এখানেই রয়েছে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, ব্যাংক আর সংবাদপত্রের অফিস।
সাংহাইয়ের বুক চিরে বহমান হুয়াংপু বন্ধন গড়ে দিয়েছে দশটি ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে। ১১৩ কিমি দীর্ঘ এই নদী সেখানকার আগম-নিগমের গুরুত্বপুর্ণ মাধ্যমও। এর বুকে সান্ধ্যভ্রমণ মনোমুগ্ধকর। ক্রুজশিপে সওয়ার হলে। রাতে সাংহাই ধরা দেয় অপরূপ সৌন্দর্যে। মাত্র ৫০ মিনিটের জলবিহার। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় নদীর উভয়পারের দৃশ্যাবলি। রাতের চোখধাঁধানো আলোয় দুপারের স্থাপনাগুলো মোহনীয় রূপ ধারণ করে।
এই পুডংয়ের পাড়েই পাওয়া যাবে ৪৬৮ মিটার উঁচু টাওয়ার। এটাই চীনের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ষষ্ঠ সুউচ্চ টিভি ও রেডিও টাওয়ার। চারপাশে সবুজের মাঝে এই টাওয়ারের অবস্থান। তাই এর উপরে উঠে টাওয়ারকে মনে হয় জেড পাথরের উপরে যেন মুক্তো বসানো। অবশ্য ভেবেচিন্তেই করা হয়েছে এই টাওয়ার। না হলে এর নাম কেনইবা হবে পার্ল টাওয়ার? তথ্য বলছে, এই টাওয়ার সেবা দিচ্ছে নগরীর অন্তত ৯টি টেলিভিশন আর ১০টি এফএম রেডিও চ্যানেলকে।
পরের দিন সাতসকালে আমাদের সঙ্গী হয়ে যায় অ্যানিস। সিদ্ধান্ত হলো, জেড টেম্পল দেখতে যাবো। সাংহাইয়ের খাবার জিভে জল এনে দেয়। আর পথরসনা তো লা জবাব। সেটাও চেখে দেখতে হবে। চীনের অন্য শহরের পথরসনার সঙ্গে কোনো অমিল নেই সাংহাইয়ের। তবু কোথায় যেন একটা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। এই যেমন ধরা যাক শিয়াওলঙবাও (সুপ ডাম্পলিং), শেংজিয়াংবাও (প্যান ফ্রায়েড ডাম্পলিং) আর কিছু সুস্বাদু নুডলস। এখানকার নাশতাও বেশ মজার। পেয়ে গেলাম মন্দির চত্বরেই।
এই মন্দিরের আদি নির্মাণ ১৮৮২ সালে। পুনর্নির্মিত হয় ১৯২৮ সালে। সাদা জেড কুঁদে তৈরি দুটো বুদ্ধমূর্তি অসাধারণ। এখানে এলে এক অন্য রকম অনুভূতি হয়। মনে হয় সাংহাইয়ের আধুনিক আর ব্যস্তসমস্ত ঘেরাটোপের বাইরে এ এক শান্ত সমাহিত পরিবেশ। এখানেও সাংহাইয়ের উভয় রূপ একদিকে আধুনিকতা- অন্যদিকে টিকে থাকা পুরোনো। সকালের কোলাহলহীন শান্ত রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়েছে দোকানিরা। বিক্রি হচ্ছে নানা পদের নাশতা।
ফ্রায়েড ডো। মুচমুচে আর অনেকক্ষণ ধরে চিবানো যায়। এটা অন্য আর পাঁচটা ভাজা খাবারের মতোই। নামটাও বলিহারি। অয়েল ফ্রায়েড ডেভিল। তেলে ভাজা শয়তান। এর দোসর হলো ড্যাবিং। একেবারে মানিকজোড়। সাংহাইতে এটাই যেন ব্রেড অ্যান্ড বাটার। এই ড্যাবিং আসলে প্যানকেক। বলা যায় খাস্তা তিলের পিঠা। আরেকটা বেশ মজাদার পথনাশতা হলো সাংহাই স্ক্যালিয়ন প্যানকেক। এর আগে স্ক্যালিয়ন প্যানকেক বিস্তর খেয়েছি। কিন্তু এটা যে অভিজ্ঞতা আমাকে দিল, বলতেই হয়, এর ধারেকাছে আর কোনোটাই নেই। স্বাদে অতুলনীয়। মোটা, মোলায়েম আর জ্যামে ঠাসা। স্ক্যালিয়নও দেওয়া প্রচুর পরিমাণে। কেবল খাওয়া নয়, দোকানিকে এই প্যানকেক তৈরি করতে দেখাটাও অনন্য অভিজ্ঞতা। অবশ্য এই তাওয়ায় ভাজা পিঠা তৈরির পুরোটা দেখা সম্ভবও নয় আশপাশে অপেক্ষমাণ ক্রেতাদের ভিড়ের কারণে। এই মুচমুচে সুস্বাদু পিঠা দিয়েই তো এখানকার দিন শুরু হয়।
এটা ছিল সাংহাইতে আমাদের প্রথম সকাল। রাস্তার ধারে পথনাশতার সম্ভারে আমাদের গাল হাঁ হওয়ার জোগাড়। এর থেকে ভালো শুরু একটা দিন আর কী হতে পারে।
মন্দির চত্বরে খাবার পাওয়া যায়। সেখানে খেতে খেতে সময় কাটানোও যায়।
সকাল বা বিকেলের প্রিয় নাশতা কী- জানতে চাইলে সাংহাইয়ের যে কেউ দ্বিরুক্তি না করেই বলবে, গরম ধোঁয়া ওঠা এক বাটি শিয়াও অনতন। এটা আসলে অনতন সুপ। যে অনতন সুপ আমি খেয়েছি, তা থেকে এটা একেবারেই আলাদা। এর বৈশিষ্ট্য হলো র্যাপার আর স্টক। র্যাপার ভীষণ পাতলা। আর বিশাল পাত্রে সারাক্ষণ ফুটছে মুরগির স্টক।
এরপর বলতেই হয় জিয়াংবিংয়ের কথা। চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পথনাশতার একটি। চীনের নানা পদ সেখানকার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। তবে এটি বোধ হয় ব্যতিক্রম। কারণ, একে সংরক্ষণ করা হয়েছে বিশেষ গোপনীয়তায়। টক-ঝাল-মিঠে স্বাদ। মুচমুচে ভাজা করে ক্রেপ। মুং বিন ফ্লাওয়ারের উপর ডিম ছড়িয়ে প্যানকেকের মতো করেই ভাজা হয়েছে। এতে আবার সিলানথ্রো যেমন আছে, তেমনি আছে ঝাল স্বাদের স্ক্যালিয়ন আর টক স্বাদের আচার। এর উপর আর এক পরত সস আছে। মিঠে স্বাদের হয়সিন ও ঝাল স্বাদের চিলি সস।
সাতসকালেই ভেন্ডাররা পসরা সাজিয়ে বসে গেছে রাস্তার ধারে। তারা আসে সাইকেল বা মোটরসাইকেলে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ নিয়ে। গ্রিডল থেকে বালতি- কী থাকে না তাতে! তবে থাকে একটা টিনের বাক্সও, টাকা রাখার জন্য।
এই সাজসরঞ্জামের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ডিম। ডজন বিশেক হবে। সুন্দর করে কার্ডবোর্ডের খোপ খোপ ট্রেতে সংরক্ষিত। আবার তা সুন্দর করে রশি দিয়ে বাঁধা। বাড়ির বন্ধ দরজা বা বন্ধ কোনো দোকানের সামনে কিংবা রাস্তার কোনো কোণে তারা ঠিকই দাঁড়িয়ে পড়ে। আর প্রথম প্যানকেকটা তাওয়ায় ছাড়ার যা অবকাশ, এরই মধ্যে লাইন লেগে যায় খদ্দেরদের।
চীনের যেকোনো পথখাবারের তুলনায় জিয়াংবিংয়ের ইতিহাস পুরোনো। শাংডং প্রদেশের ২২০-২৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এর উৎপত্তি। উদ্ভাবক সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারকেরা। যুদ্ধ চলাকালে তারা তাদের সৈন্যদের জন্য এই প্যানকেক তৈরি করত। ধাতব বর্মের উপর আটার গোলা দিয়ে আগুনে সেঁকা হতো। তার উপর ডিম ভেঙে দিয়ে টপিং হিসেবে মিহি করে কাটা কাসুন্দি দেওয়া আচার, স্ক্যালিয়ন আর ধনেপাতা ছড়িয়ে দিত।
ভাজা হয়ে গেলে নিচের পিঠে হয়সিন সস আর লাইজিয়াও চিলি সস মাখিয়ে পরিবেশন করা হতো। বর্তমানে ভেন্ডাররা অবশ্য এটাকে বেশি ক্রিসপি করার জন্য অনতন শিট ভালো করে ভেজে দেয়। তার সঙ্গে লেটুস।
তিন মিনিট ধরে আমি কেবল অবাক হয়ে দেখলাম। তারপর প্রথম কামড়টা দিয়ে পুরোই হারিয়ে গেলাম। ততক্ষণে আমার পেছনে সারি দীর্ঘতর হয়েছে। তাই সেখান থেকে সরে গিয়ে হাতে ধরা জিয়াংবিং নিয়ে রাস্তার ক্রমবর্ধমান ভিড়ের মধ্যে সেধিয়ে গেলাম। হাঁটা লাগালাম হোটেলের দিকে। কারণ, আমার কাজ আছে। আর তা শুরু করা জরুরি। তবে এই সুন্দর সকালের রেশ এক্সপ্লোর করতে চাই সাংহাইয়ের লাঞ্চ আর ডিনারের নানা পদে। আধুনিক কিংবা ঐতিহ্যবাহী। হতে পারে পথের ধারে কিংবা কোনো সাজানো রেস্তোরাঁয়।
ছবি: লেখক
সাংহাইয়ের রাস্তায় শেফ শুভব্রত মৈত্র