ত্বকচর্চা I সংবেদনশীলতায় সতর্কতা
সংবেদী ত্বকের স্বাভাবিকতা বজায় রেখে সুন্দর হয়ে ওঠা খানিকটা ঝক্কির বটে! তবে অসম্ভব নয়
সৌন্দর্যবিশ্বজুড়ে এখনকার সবচেয়ে বেশি চর্চিত ত্বকধরন স্পর্শকাতর ত্বক। সম্প্রতি একটি ইউরোপিয়ান সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫২% মানুষের ত্বকে মিলেছে সংবেদনশীলতার উপসর্গ। তবে মজার তথ্য পাওয়া গেছে আরেকটি পরীক্ষা থেকে। যা বলছে, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মনে হয় তাদের ত্বক কোনো না কোনোভাবে স্পর্শকাতর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। অধিকাংশ মানুষের এই ধারণা ভুল যে, তাদের ত্বক স্পর্শকাতর। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট অব ডার্মাটোলজিক থেকে ‘ওভারইউসড ফ্রেজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে স্পর্শকাতর ত্বককে। এখানকার ডার্মাটোলজিস্টদের মতে পণ্যের ব্যবহারে অসাবধানতা, আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণেই হুটহাট করে স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি হতে পারে ত্বকে। তার মানে এই নয় যে, তার ত্বকের ধরনটাই এমন। তাই স্পর্শকাতর ত্বকের যত্নে যেমন সতর্কতা চাই, তা যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও জরুরি সাবধানতা।
স্পর্শে সংবেদী হয়ে পড়া এ ধরনের ত্বকের লক্ষণীয় উপসর্গ। যেমন খুব সহজেই লালচে হয়ে ওঠে ত্বক। চুলকানো ভাব ছাড়াও জ্বালাপেড়া হতে পারে। স্কিন টেক্সচারে অসামঞ্জস্য দেখা যায়। সঙ্গে বাড়তি উপদ্রব– হঠাৎ শুষ্ক ও টানটান দেখায় তো পর মুহূর্তেই হয়ে ওঠে তেলের খনি। যেকোনো ধরনের সৌন্দর্যপণ্যেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে স্পর্শকাতর ত্বক। র্যাশ উঠতে শুরু করে ত্বকে, সঙ্গে বাড়ায় অস্বস্তি।
সাধারণত ত্বকের একদম উপরের স্তরে অস্বস্তি স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি করতে পারে। আর এটা তখনই ঘটে, যখন ত্বকের এই স্তরের প্রাকৃতিক বেষ্টনীর কার্যকারিতা দুর্বল হতে শুরু করে বা নষ্ট হয়ে যায়। ত্বক স্পর্শকাতর হয়ে ওঠার আরও কারণ রয়েছে। প্রতিরক্ষা ছাড়া রোদে বেরোনো, বায়ুদূষণের প্রভাব, তাপমাত্রার হুটহাট ওঠানামা, অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়া ত্বকের সংবেদনশীলতা বাড়ায়। এ ছাড়া খুব বেশি গরম পানি কিংবা ক্লোরিনযুক্ত পানির ব্যবহার ত্বকে স্পর্শকাতরতার আরেকটি কারণ। গর্ভাবস্থায় কিংবা মেন্সট্রুয়াল সাইকেলের পরিবর্তন, অপর্যাপ্ত ঘুম, মনোদৈহিক চাপ আর দুশ্চিন্তা ত্বকের এই অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
ত্বক আসলেই স্পর্শকাতর কি না, তা নির্ধারণের জন্য রয়েছে বেশ কিছু সহজ পদ্ধতি। মুখত্বকের দুই পাশ হালকা থেকে মাঝারি চাপে আঙুল দিয়ে ঘষে নিয়ে লক্ষ করুন কোনো পরিবর্তন আসে কি না। ত্বক লালচে হয়ে গেলে বুঝতে হবে তা স্পর্শকাতর। এটি পরীক্ষার আরেক সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ফাউন্ডেশন থেকে ব্লাশ– ত্বকে প্রতিটি সৌন্দর্যপণ্যের প্রতিক্রিয়া দেখা। হয় লালচে হয়ে উঠবে ত্বক, নতুবা চুলকানি কিংবা অস্বস্তির উদ্রেক ঘটাবে।
পরিচর্যায় প্রতিদিন
সিটিএম– ক্লিনজিং, টোনিং ও ময়শ্চারাইজিং। স্পর্শকাতর ত্বকের মতো সমস্যাসঙ্কুল ত্বকের যত্নেও বহুল ব্যবহৃত এসব পদ্ধতির নিয়মমাফিক সঠিক চর্চাই যথেষ্ট। প্রতিদিনের সকাল শুরু হোক বিশেষভাবে তৈরি ক্লিনজিং লোশন দিয়ে। সালফেট ফ্রি কোমল ক্লিনজিং লোশনই এ ধরনের ত্বকে বেশি উপযোগী। যা সহনীয়ভাবে মেকআপ থেকে শুরু করে ত্বকের গভীরে থাকা দূষণ দূর করে। ত্বকের প্রাকৃতিক বেষ্টনীর ক্ষতি না করেই। তার পরপরই জরুরি টোনিং। এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া চাই অ্যালকোহল ফ্রি টোনার। বরং এতে থাকুক হোয়াইট টি এক্সট্র্যাক্ট, গ্রিন টি, ক্যামোমাইল আর বিসাবোললের মতো প্রশান্তিকর এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানগুলো। বেটা গ্লুকানও স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য দারুণ। এটা ত্বকের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অক্ষত রাখে। সারায় অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা। এই ত্বকের জন্য ময়শ্চারাইজার বেছে নেওয়ার সময় লক্ষ রাখা উচিত, এতে যেন সিনথেটিক সুগন্ধির ছিটেফোঁটা না থাকে। কারণ, এগুলো ত্বকে আরও জ্বালাপোড়া ভাব সৃষ্টি করতে পারে, সঙ্গে অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশনও তৈরি হতে পারে। সিনথেটিক ডাই আর অ্যালকোহল ফ্রি হওয়া চাই ময়শ্চারাইজারগুলো। স্পর্শকাতর ত্বকে সানস্ক্রিন ইজ আ মাস্ট। তবে তা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে চাই সতর্কতা। জিঙ্ক অক্সাইডযুক্ত সানস্ক্রিনগুলো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী। কারণ, এগুলো অকারণেই জ্বালাতন করে না ত্বককে। টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইড দেওয়া সানস্ক্রিনও বেছে নেওয়া যেতে পারে, তবে মাঝারি কিংবা গাঢ় স্কিনটোনে এগুলো সাদা প্রলেপ রেখে দেয়, সুন্দরভাবে ত্বকে মিশতে পারে না। নিদেনপক্ষে এসপিএফ ৪০ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করা চাই এ ধরনের ত্বকে।
এই ত্বকের জন্য রাতের রূপরুটিনও প্রায় একই রকম। শুধু সানস্ক্রিনটা না মাখলেই চলবে।
সপ্তাহ শেষে
ত্বক স্পর্শকাতর বলেই যে এক্সফোলিয়েশন এড়িয়ে যেতে হবে, তা কিন্তু নয়। বরং এমন প্রডাক্ট এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া উচিত, যা ত্বকের সংবেদী প্রবণতা বাড়াবে না; বরং কোমল হাতে, কোনো ধরনের জ্বালাপোড়া ভাব ছাড়াই ত্বকের মৃতকোষ সারাইয়ে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে সেরাম বেসড এক্সফোলিয়েটর দারুণ অপশন। গ্লাইকোলিক অ্যাসিড বেসড সেরামগুলো ব্যবহারের উপযুক্ত হলেও অনেক সময় এগুলোও অস্বস্তিকর অনুভূতি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য ল্যাকটিক অ্যাসিডে তৈরি সেরাম আরও নিরাপদ। নিরুপদ্রবও বটে। সপ্তাহে অন্তত দুবার এসব সেরামের ব্যবহার ত্বককে রাখবে মৃতকোষমুক্ত। জেল বেসড মাস্কও ব্যবহার করা যেতে পারে নিয়ম করে। তাতে স্পর্শকাতর ত্বকের জ্বালাপোড়া আর অস্বস্তি কমে আসতে পারে। ওয়াটার বেসড হাইড্রেশন দিয়ে ত্বককে আর্দ্র ও উজ্জ্বল রাখতেও দারুণ উপযোগী এ মাস্কগুলো।
পনেরো দিন পর
শুধু মুখত্বক নয়, গলা, ঘাড়, পিঠসহ পুরো শরীরের অন্যান্য অংশের বাড়তি যত্ন প্রয়োজন পনেরো দিন অন্তর। সঙ্গে কেমিক্যাল পিল ব্যবহার করা যায়, তবে স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য তা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান। ন্যাচারাল ফ্রুট এক্সট্রাক্ট থেকে তৈরি পিল ছাড়াও ল্যাকটিক আর গ্লাইকোলিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ পিলও এই ত্বকের যত্নে দারুণ। আলফা হাইড্রোক্সি অ্যাসিড আর নানা ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে তৈরি পিলও স্পর্শকাতর ত্বকে দারুণ মানানসই।
মাসে একবার
অন্তত একবার ফেশিয়াল প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো কোনো স্যালন বেছে নিতে হবে। সঙ্গে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অবশ্যই জরুরি। পার্ল, গোল্ড, প্যারাফিন আর ডায়মন্ডের মতো ফেশিয়ালগুলো স্পর্শকাতরতায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে এগুলো এড়িয়ে ফ্রুট, চকলেট কিংবা আয়ুর্বেদিক উপাদান দিয়ে করা ফেশিয়ালগুলো এই ত্বকে বেশি জুতসই।
জাহেরা শিরীন
মডেল: হীরা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস