skip to Main Content

ঘরেবাইরে I আজকের অন্দর

সত্যকে লুকিয়ে রাখা নয়, বরং সুন্দর করে দেখানো। যাতে ভবনের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা অনুভব করা যায়

নান্দনিক বোধে পূর্ণতা দিতে স্থাপত্য এখন কেবল ভবনের বহির্ভাগ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ে বেশি চিন্তিত। তাই আকার এখন আর মূল ভাবনা নয়। উদ্দেশ্যগত, পরিবেশগত ভাবনা থেকে ভবনের আকৃতিতে আসার প্রক্রিয়াই হলো স্থাপত্যের আধুনিক শিক্ষা।
এই চর্চায় ভবনের ভেতরের ও বাইরের আবরণে আরোপিত সৌন্দর্য সরিয়ে ব্যবহারিক সুবিধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ, একজন পোশাক নির্মাতা যেমন মানব শরীরকে তার মূল বিষয় ভেবে কাজ করেন, স্থপতিও তেমনি। ফলে বেশ কিছু মিথ্যার আশ্রয় থেকে রেহাই পেল আমাদের সুন্দর ভবনগুলো। একটা ভবন কেবল পরিকল্পনামাফিক ইটের পর ইট গেঁথে দিয়েই তো শেষ হয় না, তাতে ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি লাগানোর ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রণাগার, পয়োনিষ্কাশন এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হয়।
অথচ ইলেকট্রিক তার বা পাইপকে অপরিকল্পিতভাবে ভবনের চারপাশ দিয়ে ঝুলতে দেখা যায়। এমনটি ভেতরেও দেখা যায়। ফলে স্থপতি যে উদ্দেশ্যে ভবনটা দাঁড় করালেন, তার কোনো ফলই বসবাসকারীরা আর পেলেন না। তাই এখন যত্ন করে ডাক্ট সিস্টেম বা নালিপথ ডিজাইন করা হয় আলাদাভাবে এসব পাইপলাইনের জন্য, যেন সেগুলো খুব গোছানো একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং মূল ভবনের ডিজাইনকে একটুও নষ্ট না করে। একইভাবে এই সিস্টেমের কারণে ইলেকট্রিক্যাল ও প্লাম্বিংয়ের সবকিছু পরিকল্পনামাফিক থাকায় কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা চিহ্নিত করে সমাধান করা সহজ হয়।
এ তো গেল বহির্ভাগের সমাধান, কিন্তু ভবনের ভেতরেও তো প্রচুর ইলেকট্রিক্যাল তার আর পানির পাইপলাইনের খেলা। সেগুলোর বেলায় কী হবে! হ্যাঁ, ওই একই ডাক্ট সিস্টেমের প্রয়োগ দেখা যায়। এবং সেই ডাক্ট লাইন ভবনের বাইরে দেখলে ভালোই লাগে; কিন্তু ঘরের ভেতরে দেখে অনেকেই নাক সিটকান। উত্তরাধুনিক ভাবনায় একটি ভবনে বসবাসরত মানুষের সারা দিনের কর্মকা- সেই ভবনেরই অঙ্গ এবং সেখানে ঘটতে থাকা কোনো কিছুই তুচ্ছ নয় এবং কোনো কিছুতেই লজ্জা বা আড়ালের কিছু নেই। তাই সেগুলো প্রকাশ্যে এনে কাজ করার ভাবনাকে আগলে রেখে এসব ডাক্ট লাইন যা ঘরের ভেতরে সিলিংয়ে থাকে, সেগুলোর নিচে আরেকটা ফলস সিলিং দিয়ে ঢেকে না দিয়ে বরং জীবনকে উদ্যাপনের মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবেশের সততা বজায় রেখেই কাজটি করা হয়। ফলে ভবন আর তাতে বসবাসরত মানুষের মাঝে গোপনীয়তা বা দূরত্ব ঘুচে যায়। মানুষ এবং তার আবাসের মাঝে এক সত্যের সম্পর্ক নিশ্চিত হয়। আমরা জানিই না যে আমাদের বাড়ির মেইন সুইচ কোথায়, কীভাবে অপারেট করা যেতে পারে কিংবা পাইপলাইনগুলো কোথায় কীভাবে আছে। গোটা বাড়ির মেকানিক্যাল দিকটা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তা নিয়ে কিছুমাত্র ধারণা নেই। অথচ এই মৌলিক জ্ঞানগুলো একজন মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপনের স্থান তার বাড়ি থেকেই চলে আসা দরকার।
এই একই চিন্তাকে ধারণ করে এখন কেবল আবাসিক নয়, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবন, অফিস বা রেস্টুরেন্টও গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে আশাতীত সাড়া পেয়েছে নতুন এই স্থাপত্যের ধারা। মা যেমন পারেন না কোনো সন্তানকে ফেলে দিতে, একইভাবে ডিজাইনারের পক্ষেও তার যন্ত্রপাতি লুকানো বেদনাদায়ক। তবে অনেক ডিজাইনার গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারেন, সেটা ভিন্ন আলাপ।
গুগলের অফিস ক্যাম্পাস এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মিটিং রুম, অবসর যাপনের স্থান, কাজের জায়গা- সবখানেই মাথার উপর দিয়ে সুন্দর করে সাজানো ডাক্ট লাইনগুলোর দেখা মেলে।
সজ্জা পদ্ধতিরও নান্দনিক দিক আছে। ম্যাটেরিয়ালের নিজস¦ সৌন্দর্য নেই। কিন্তু সুন্দর কম্পোজিশনের মাধ্যমে সেগুলোর মাঝে থাকা কাব্যগুণ ধরা পড়ে। দুনিয়াটা যেখানে চিহ্ন, তথ্য আর প্রতীকে ঠাসা, সেখানে প্রকৃত সত্য পেছনেই পড়ে যায়। তাই যখন সেগুলোর দেখা মেলে তখন পরমের সাক্ষাৎই বটে। এটা স্থপতি পিটার জুমথরের ভাবনা। তিনি কিশোর বয়সেই জানতে পেরেছিলেন, কবিতার রোম্যান্টিসিজমের উল্টো দিকের পথে সত্যের অবস্থান। আর সেই সত্যকে পেতে এই মেদহীন উদ্যোগ।
গুগলের অফিসে টেকনোলজির সমাধান ছিল প্রধান বিষয়। তাই টেকনোলজিই হয়ে গেল ডিজাইনের প্রধান চাবিকাঠি। জায়গায় জায়গায় ল্যাপটপের কানেকশন, ওয়াই-ফাই, মোবাইল ফোন থেকে ডেটা আদান-প্রদান এবং চার্জের ব্যবস্থা, সিকিউরিটি, সব জায়গায় ইলেকট্রিসিটি নিশ্চিত করা, যেকোনো জায়গা থেকে ল্যাপটপ বা মোবাইলের মাধ্যমে প্রদর্শনীর সুযোগ নিশ্চিতকরণ যখন প্রধান চাহিদা হয়, ডিজাইনটাও সেভাবেই গড়ে ওঠে। তখন জায়গাটিকে স্থাপত্যের একটা বিরাট বাক্সের বদলে মানব সংস্কৃতির আধার বলে বোধ হয়।
বর্তমানে মানুষের মনে ভীষণ ভয়। এই ভয় তাদের উদ্যমী হতে, প্রতিবাদী হতে, নিজের অধিকার আদায় করতে বাধা দেয়। সুদিন আসার অপেক্ষায় তারা বসে থাকে; কিন্তু তার জন্য কিছু করে উঠতে পারে না। ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের মৌলিক কাজ এই পরিস্থিতি নিয়ে। এ কারণে স্থাপত্যের বাক্সের কাঠামো ছাড়িয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিজীবনে প্রভাব রাখতে সক্ষম। মনভোলানো কাজ রোজকার সমস্যাগুলো লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সত্যের আনন্দদায়ক সাহচর্য সৎ জীবন যাপনে প্রভাব ফেলে।
গুগলের অফিসে কেবল ডাক্ট লাইনের প্রকাশ নয়, বিপ্লব আনা হয়েছে কর্মীদের বসার নিয়মেও। এত বড় করপোরেট মার্কেটে থেকেও নিজেদের চিহ্ন রাখতে পেরেছেন ডিজাইনার। কিউবিক্যাল বা ছোট ছোট কক্ষ ভেঙে এখন সবাই স্বচ্ছতা বজায় রেখে একসঙ্গে কাজ করছেন। ফলে কোনো পৃথক্করণের রাজনীতি ঘটার সুযোগ থাকে না। মানুষের এক হবার সুযোগ করে দেয় এই পরিবেশ।
স্থপতি ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ক্লাইভ উইলকিনসন নিজের অফিসেও কোনো দেয়াল তোলেননি। সর্বক্ষণ যে তাকে কেউ দেখছে, এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজে প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেও বাকি সব কর্মীর মতোই তার কাজের ডেস্ক ও জায়গা।
আসলে প্রতিটি ভবনের মাঝে আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতা আছে। যেন জীবন্ত কেউ লুকিয়ে আছে এর মাঝে আর আমাদের চালিত করছে। দেখা না গেলেও তা ইন্দ্রিয়নিষ্ঠ। এই উষ্ণতার আমেজ ব্যাখ্যাতীত বা ম্যাজিক্যাল, যার আলাদা কোনো দায় নেই কেবল নিজেতেই মগ্ন হওয়া ছাড়া। ধ্যানরত এক ভবন যেন ভেতর-বাহির দিয়ে সত্য ও সুন্দর।

 স্থপতি সুপ্রভা জুঁই
ছবি: সংগ্রহ
Shuprava.jui.arch@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top