কাভারস্টোরি I বিউটিউব
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিন ইউটিউব। যার বদৌলতে প্রতিমুহূর্তে বাজিবদল হচ্ছে সৌন্দর্যবিশ্বের। তৈরি হচ্ছে বিকল্প বাণিজ্যনকশা। ব্যক্তি পরিণত হচ্ছে ব্র্যান্ডে। আর ব্র্যান্ডগুলো হয়ে উঠছে ব্যক্তিনির্ভর। এ নিয়ে লিখেছেন জাহেরা শিরীন
নানা ধরনের সাজসামগ্রীতে ভরা একটা বিউটি বক্স আর আয়না। এ দিয়েই এত দিন চালিয়ে নেওয়া যেতো সাজের কাজ। কিন্তু এখন প্রয়োজন হয় আরেকটি অপরিহার্য উপাদান। সাজার সময় সামনে থাকা চাই মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটারের মতো যন্ত্র, যা অনায়াসেই যে কাউকে জুড়ে দেবে ইউটিউবের সঙ্গে। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি দেখা সাইটগুলোর তালিকার তৃতীয় স্থান বর্তমানে ইউটিউবের দখলে। যেখানে প্রায় প্রতিদিন শতকোটি মানুষের আনাগোনা। যাদের খোরাক মেটাতে প্রতি মিনিটে আপলোড করা হয় ৪০০ ঘণ্টার ভিডিও, প্রায় প্রতিদিনই। যার মধ্যে একটা বড় অংশ বরাদ্দ বিউটি বেসড কনটেন্টগুলোর জন্য। পরিসংখ্যান বলছে, গেল কয় বছরেই বিলিয়নের ওপর বিউটি ফোকাসড ভিডিও আপলোড হয়ে গেছে আমেরিকান এ ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইটে। আর সাড়া, তার পরিসংখ্যানও চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। জার্মান বেসড অনলাইন পরিসংখ্যান বাজার পর্যবেক্ষণ এবং বিজনেস ইন্টেলিজেন্স পোর্টাল স্ট্যাটিস্টিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬ তে মাত্র ৫৫ বিলিয়ন ভিউ পায় ইউটিউবের বিউটি বেসড কনটেন্টগুলো। যাতে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল বিউটি টিউটোরিয়াল, ডিআইওয়াই, রিভিউ আর ব্র্র্যান্ডের কালেকশনের মতো ভিডিওগুলো। বছরখানেকের মাথায় সৌন্দর্যসম্পর্কিত নানাবিষয় নিয়ে তৈরি ভিডিওগুলোর ভিউ বেড়ে গিয়ে ঠেকে ৮৮ বিলিয়নে। এরপর থেকে প্রায় প্রতি মাসেই বিউটি বেসড কনটেন্টগুলোতে কমবেশি ৭০০ মিলিয়ন ভিউ নিবন্ধিত করে ইউটিউব। এ থেকেই বোঝা যায়, সৌন্দর্যবিশ্বে ইউটিউবের উত্থান ইতিবাচক। দুর্নিবার। ফলে সৌন্দর্যবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বাজারজাতকারীসহ বড় বড় সব বিউটি ব্র্যান্ডও বুঝতে পারছে ইউটিউবের দাপট। শুধু সুন্দরী মডেলদের ফটোশপ করা ছবি দিয়ে তৈরি বিলবোর্ড, লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন আর বাজারে থাকা শেয়ার দিয়ে যে এখন আর ব্যবসা ধরে রাখা সম্ভব নয়, তা-ও বোঝা হয়েছে অনেকেরই। তাই ইউটিউবে উপস্থিতি পরিণত হচ্ছে বাজারকে পকেটে পুরে রাখার আবশ্যক অস্ত্রে।
মেকআপ হচ্ছে দেখে, শিখে দক্ষতা অর্জনের বিষয়। একসময় সাজে দক্ষ বোন, বন্ধু কিংবা পার্লারের কর্মী কিংবা প্রশিক্ষকেরা ছিলেন হাতেকলমে সাজ শেখার একমাত্র উপায়। কিন্তু সময়ের সন্ধিক্ষণে পাল্টে গেছে সেই ধারা। সোশ্যাল মিডিয়ার আকর্ষণীয় সাইট আর তাতে আপলোড করা ভিডিওগুলো আগেকার সৌন্দর্যচর্চার পথ মুছে দিয়ে বিকল্পহীন এক ধারায় পরিণত হয়েছে। এখন ইউটিউবে অভ্যস্ত টিউব জেনারেশনের কাছে সাজ শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভরসা বিউটি ইউটিউবাররা। যারা বেশি পরিচিত বিউটি ভ্লগার, বিউটি গুরু আর বিউটি ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে। এখনকার সৌন্দর্যপ্রেমীদের কাছে তাদের স্থান সেলিব্রিটিদের চেয়ে কিছু কম নয়। বিউটি ভ্লগারদের প্রতি ইউটিউব ব্যবহারকারীদের আসক্তি আর মনোযোগ লক্ষ করার মতো ঈর্ষণীয়। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিউটি ভ্লগারদের সাবস্ক্রাইবারদের সংখ্যা দেখলেই তা অনুমেয় হয়ে ওঠে। শীর্ষস্থানীয় অনেক ভ্লগারেরই সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা শত মিলিয়ন, এমনকি তারও বেশি। যারা নিয়মিত কাজ করেন ট্যালেন্ট এজেন্টদের সঙ্গে, ব্র্যান্ডেড বিউটি প্রডাক্ট লাইনের হয়ে। তথ্য আছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইউটিউবে আপলোড হওয়া ৫.৩ মিলিয়ন বিউটি ভিডিওর শীর্ষ ২০০টির মধ্যে ৮৬ ভাগই ভ্লগারদের তৈরি, ব্র্যান্ডগুলোর নয়। মানতেই হবে, সৌন্দর্যে আগ্রহী বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য ভোক্তাদের একটি বড় অংশ এখন ইউটিউবকেন্দ্রিক। যারা ভিডিও দেখে সিদ্ধান্ত নেন কোন ধরনের লুকে তারা সাজবেন বা কোন প্রডাক্টটা কিনবেন। সে ক্ষেত্রে বিউটিকেন্দ্রিক ব্যবসায় যুক্ত ব্র্যান্ডগুলোর স্বীকৃত কোনো স্থানই নেই সাইটজুড়ে; বরং বিউটি ভ্লগাররা এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। ইউটিউবের মোট বিউটি কনটেন্টগুলোর ৯৭ ভাগই তাদের দখলে। যেখানে ব্র্যান্ডগুলোর ভিডিও মাত্র ৩ ভাগ জুড়ে। ফলে বোঝা যাচ্ছে, ভোক্তাদের ওপর ব্র্যান্ডের নয়, বিউটি ভ্লগার নামক ব্যক্তিদের দাপটই বেশি। আর তা হবে না কেন! ব্র্যান্ডগুলোর ত্রিশ সেকেন্ডের ভিডিওগুলোতে পণ্য নিয়ে হালকার ওপর ঝাপসা একটা ধারণা পান ভোক্তারা। যেখানে ভ্লগারদের বিউটি ভিডিওগুলো তৈরি হয় বড়সড় ফরমেটে। কোনটা নতুন, কোনটা চলছে বাজারে- তার স্পষ্ট ধারণা মিলে যায়। কনটেন্টগুলো তৈরি হয় উপযোগী, উপকারী আর অনবদ্য সব বিষয়ে। শয়ে শয়ে মেকআপ লুক, পোশাকভেদে মানানসই সব সাজের টিউটোরিয়াল এই মিডিয়ায় থাকে, যা মানিয়ে যায় ডেস্ক থেকে ডেটে। ফলে ভ্লগারদের সঙ্গে স্বভাবতই ভোক্তার সম্পৃক্তি হয় সহজে। তৈরি হয় অনড় সম্পর্ক। দেরিতে হলেও বিউটি ব্র্যান্ডগুলো এ সম্পর্কের সূত্রটা ধরতে শুরু করেছে। এটাকে পুঁজি করেই ইউটিউবে স্থান দখলের জন্য প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলছে ব্র্যান্ডগুলোর ডেরায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ব্র্যান্ডগুলো তাদের প্রডাক্ট পাঠিয়ে দেয় বিউটি ভ্লগারদের কাছে। যা ব্যবহার করেই তারা বিভিন্ন লুক তৈরি করেন। তখন নির্দিষ্ট সেসব পণ্যের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ বাড়ে ভোক্তাদের। এসব বিউটি কোলাবরেশন ছাড়াও অনেকে বিউটি হল ভিডিও তৈরি করেন। অনেক ব্র্যান্ড তো এর থেকেও এগিয়ে। বিউটি ভ্লগারদের সঙ্গে নিয়ে তাদের অনুপ্রেরণায়, তাদের নাম দিয়ে ব্র্যান্ডগুলো তৈরি করে মেকআপ প্যালেট। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিউটি ভ্লগারদের নিয়ে তৈরি সব প্যালেটই ব্র্যান্ডের বেস্ট সেলিং প্রডাক্টের তালিকায় নাম লিখিয়ে নেয় সপ্তাহখানেকের মধ্যে। তবে বিপরীতটা যে হয় না, তা নয়। ব্র্যান্ড নিয়ে নেতিবাচক পর্যালোচনাতেও পিছপা হন না ভ্লগাররা।
বিউটি ভ্লগিং নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই দেশেও। সৌন্দর্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে সচেতন, আগ্রহী এবং পেশাদার এমন বেশ কয়েকজন বিউটি ভ্লগার মিলে যাবে। তারা দেশের সৌন্দর্যসচেতনদের জন্য কাজ করছেন প্রতিনিয়ত। বিউটি ভ্লগিং নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকেই। তো, আপনি পিছিয়ে রইবেন কেন! সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেতে উঠুন লাইক, শেয়ার আর সাবস্ক্রাইবিংয়ে।
ছবি: সংগ্রহ