ফিচার I ফিশ অয়েলের নতুন নিকাশ
ওমেগা-৩ এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রচলিত সম্পূরক পুষ্টি উপাদানের একটি। তবে নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগ বা স্ট্রোকের চিকিৎসায় এর প্রভাব নগণ্যই। অথচ এই ‘ফিশ অয়েল’ বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার
কোনটা ভালো- মাছ নাকি ‘ফিশ অয়েল’ ক্যাপসুল
ওমেগা-৩ বা ‘ফিশ অয়েল’ শিল্প নিয়ে আবার বিতর্ক উঠেছে। হৃদরোগের ওপর ওমেগা-৩ ব্যবহারের প্রভাব বুঝতে সম্প্রতি একটি গবেষণা চালানো হয়। ১ লাখ ২ হাজার ৫৯ জনের ওপর ৭৯ দফা পরীক্ষা চালিয়ে গবেষকেরা দেখতে পান, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ওমেগা-ফ্রির ভূমিকা খুব নগণ্য অথবা একদমই অকার্যকর।
তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গত ১৫ বছরে অন্তত ২০টি গবেষণায় একই চিত্র ফুটে উঠেছে। অথচ লোকজন সিফুড খাওয়া কমিয়ে ক্রমাগত ওমেগা-৩ ক্যাপসুলের দিকেই ঝুঁকছে। অবশ্যই তা শরীরের জন্য জরুরি। কিন্তু যে কারণ দেখিয়ে ওমেগা-৩ ব্যবহার করা হয় ব্যাপকভাবে, বাস্তবে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে এটি তেমন কোনো কাজেই লাগে না। ৩০ বিলিয়ন ডলারের এ ‘ফিশ অয়েল’ শিল্প বহুবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তবে এবার গবেষকেরা যথাযথ তথ্য সামনে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
শিল্পবিপ্লবের সময়কালে উত্তর ইউরোপজুড়ে রিকেট (শিশু-কিশোরদের অপুষ্টিজনিত রোগ) রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বয়ঃসন্ধিকালেই ওই কিশোরদের শরীর বেঁকে যেত। গবেষকেরা বলছেন, এটা ভিটামিন ডি-এর ঘাটতির ফল। তখন ওই শিশুদের ‘ফিশ অয়েল’ লাগিয়ে রোদে বসে থাকতে বলা হতো। রোদ থেকেই যেহেতু শরীর সরাসরি ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে পারে। আবার ফিশ অয়েলের উৎস কড মাছ। মাছের কলিজায় প্রচুর ভিটামিন ডি মজুত থাকে বলে ওই রোগের চিকিৎসায় কড লিভার অয়েলের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।
নরওয়ের ফার্মাসিস্ট পিটার মুলার রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কড লিভার অয়েল প্রস্তুত করেন এবং ঘোষণা করেন, এই তেলে এখন আর মাছের স্বাদ নেই। তিনি এক প্রচারাভিযান শুরু করেন। তাতে বলা হয়, রিকেট থাকুক বা না থাকুক, সুস্থ থাকতে সবাইকে প্রতিদিন চামচ ভরে ফিশ অয়েল খেতে হবে! এই প্রচারণার সাফল্যে ১৮৬৯ সালে যখন মুলার মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার নামে ছিল ৭০টি কড লিভার অয়েল উৎপাদনের কারখানা, প্রতিবছর সেগুলোয় প্রায় পাঁচ হাজার ব্যারেল ফিশ অয়েল প্রস্তুত করা হতো। পরবর্তীকালে ওমেগা-৩ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।
১৯৭০-এর দশকে প্রথম দিকে কেমিস্ট হানস ওলাফ ব্যাং এক ড্যানিশ জার্নালে পড়েছিলেন, গ্রিনল্যান্ডের ইনুইট জনগোষ্ঠীর মধ্যে হৃদরোগের প্রকোপ সবচেয়ে কম দেখা যায়। সহযোগী জর্ন ডায়ারবার্গকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য তিনি গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত উম্মানাক উপকূলে উপস্থিত হন। ওই সময়ে তিনি কিসের অনুসন্ধান করছেন, তা নিজেও জানতেন না! ১৩০ জন স্থানীয় মানুষের উচ্চতা-ওজনের বিবরণ লিখে, তাদের বোতলভর্তি রক্ত নিয়ে বাড়ি ফেরেন ব্যাং। সেখানে ১৩০ জনের রক্তে ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।
আংশিক তথ্যের ভিত্তিতে ইনুইট জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত ওই গবেষণায় ব্যাং ও ডায়ারবার্গ সিদ্ধান্ত দেন: ১. ইনুইট জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের সমসাময়িক পশ্চিমাদের তুলনায় উচ্চতর মাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করে; ২. স্বাস্থ্য তথ্যানুযায়ী, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক কম; ৩. সম্ভবত ওমেগা-৩-এর কারণেই ইনুইট জনগোষ্ঠীর মানুষদের শারীরিক অবস্থা অন্যদের চেয়ে আলাদা।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে ব্যথানাশক উপাদান আছে। তবে তা হৃদরোগে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখে না। এ তথ্যকে কেন্দ্র করেই নতুন করে ওমেগা-৩ নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা শুরু হয়। চলতি বছরের ১৮ জুলাই প্রকাশিত কোকরেন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় অবস্থান-নিরপেক্ষ অংশগ্রহণকারীদের ওপর চালানো পরীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য তুলে ধরা হয়। নির্দিষ্ট সময় ধরে তাদের ওমেগা-৩ ফিশ অয়েল ক্যাপসুল খাওয়ানোর আগে ও পরের লিপিড প্রোফাইল করা হয়। এর আগের গবেষণাগুলো মাত্রা ও আকারে ছোট হওয়ায় তাতে প্রশ্ন উঠলেও হৃদরোগে ফিশ অয়েলের অসারতা নিয়ে এত গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল না, যা আলোচ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
পূর্ববর্তী অনেক গবেষণায় আগে থেকে নির্ধারিত মানুষদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ফিশ অয়েলের সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ফিশ অয়েল কোম্পানির পক্ষে ওই সব গবেষণাকে খারিজ করা হয় কোকনারের সাম্প্রতিক এ গবেষণায়।
ফিশ অয়েল শিল্পের জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ টন সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। আজকের দিনে ধরা পড়া মাছের এক-চতুর্থাংশই ফিশ অয়েল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। সামুদ্রিক প্রাণীর নিধন কার্যক্রম বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বিভিন্নভাবে হয়ে আসছে। ১৮ শতকে উত্তর গোলার্ধে সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংসের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল তিমি। তখন তেল সংগ্রহ করার জন্য তিমি নিধন অভিযান চালানো হয়। ১৯ ও ২০ শতকে তা চলে আসে দক্ষিণ গোলার্ধে। সে সময় ওই অঞ্চলের চার লাখ তিমির মধ্যে ৩ লাখ ৯০ হাজারই গায়েব হয়ে যায়। তখন মার্জারিন, নাইট্রোগ্লিসারিন ইত্যাদি সংগ্রহের নামে সামুদ্রিক প্রাণী নিধনযজ্ঞ চালানো হয়।
২০ শতকের শেষের দিকে নিধনযজ্ঞ চালানো হয় আনকোভি, সারডিন, হেরিংয়ের মতো ছোট, তেলযুক্ত মাছের দিকে। ১৯৪০-এর দশকের শেষে এবং ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নিধনযজ্ঞ চলেছিল পেরু উপকূলে পেরুভীয় আনকোভেটা মাছের ওপর। কোনো একক প্রজাতির প্রাণী নিধনের এটি সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ মাছ তখন ধরা হতো, তার ১০ শতাংশই ছিল পেরুভীয় আনকোভেটা। ১৯৪০-এর দশকে এ মাছ ব্যবহৃত হতো কৃষিজমিতে সার হিসেবে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তা হয়ে গেল মুরগির বাচ্চার খাবার, ১৯৭০-এর দশকে গৃহপালিত কুকুর, বিড়াল শূকরের খাবার; ৮০ ও ৯০-এর দশকে স্যামন জাতীয় মাছের খাবার হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। এখন আনকোভেটা জাতীয় মাছ ব্যবহৃত হচ্ছে ডায়েট ইন্ডাস্ট্রির ‘এলিট পণ্য’ ফিশ অয়েল ক্যাপসুল হিসেবে। এ জন্য প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক প্রাণী নিধন করা হয়। যা ওজনে পুরো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ওজনের সমান। সম্প্রতি এ নিধনযজ্ঞে যুক্ত হয়েছে অ্যান্টার্কটিক ক্রিল। উল্লেখ্য, এ ক্রিল হলো তিমির প্রধান একটি খাদ্য।
ক্রিল ধরার জন্য দক্ষিণ মহাসাগরে ২০০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প চালু হয়েছে। প্রকল্পের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ক্রিল অয়েল ‘ফসফোলিপিড’ সমৃদ্ধ, অর্থাৎ এতে ফসফেট রয়েছে। এটাও বলা হচ্ছে, এতে জৈব উপাদান বেশি, তাই গ্রাহকেরা ফিশ অয়েলের পরিবর্তে ক্রিল অয়েল বেশি পছন্দ করবে।
অন্যদিকে, অনেক প্রতিবেদনেও খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মাছ ও সিফুড শরীর ও পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী। মাছ শুধু ওমেগা-৩ প্রদান করে না, এ থেকে আরও পাওয়া যায় যথেষ্ট আমিষ ও ক্যালরি। ১০০ গ্রাম স্যামনে আছে ১৩৯ ক্যালরি এবং ২৩ গ্রাম আমিষ। যেখানে ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে আছে ২১০ ক্যালরি এবং ২০ গ্রাম আমিষ। অথচ এ মাছ যখন ফিশ অয়েল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তখন তার ক্যালরি ও আমিষ কোনো কাজেই লাগে না। উপরন্তু এ থেকে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসৃত হয়।
গ্রিনল্যান্ডের ইনুইট জনগোষ্ঠীর হৃদরোগে আক্রান্তের নিম্নহারের জন্য ফিশ অয়েলের কথা বলা হলেও তারা কিন্তু ওই ক্যাপসুল খেত না! তাদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল সিফুড ও সামুদ্রিক মাছ। আর বহু গবেষণায় স্পষ্ট যে, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে জীবন-যাপন পদ্ধতিও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ প্রভাব ফেলে। অথচ রমরমা ফিশ অয়েল বাণিজ্যে এ বিষয়গুলো খুব সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়।
অনিকেত হিল্লোল
[ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত পল গ্রিনবার্গের একটি কলাম অবলম্বনে নিবন্ধটি রচিত। পল গ্রিনবার্গ পেঙ্গুইন প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘ওমেগা প্রিন্সিপাল: সিফুড অ্যান্ড দ্য কুয়েস্ট ফর আ লং লাইফ অ্যান্ড আ হেলদিয়ার প্ল্যানেট’ গ্রন্থের রচয়িতা।]