ফিচার I বিবাহে বাঙালি
বাঙালির বিবাহ অনুষ্ঠান সম্প্রদায় ভিন্ন হলেও লোকাচারে একই রকম। বিয়ের লোকাচারের মধ্যে বাঙালির যে পরিচিতি-সত্তা ফুটে ওঠে, সেসব নিয়েই লিখেছেন অতনু সিংহ
কবুল কবুল উচ্চারণ, বিবাহ নিবন্ধন ও মোনাজাত। অথবা অগ্নিকুন্ড প্রদক্ষিণ ও উলুধ্বনির আবহে মালাবদল, পাত্রের হাতে রঙিন হয়ে ওঠা কন্যার সিঁথি। মূলত বিবাহকে কেন্দ্র করে এই বাংলার মানুষ দুই ধরনের দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত। বাংলাদেশ তথা গোটা বঙ্গের মুসলমান ও সনাতন বিশ্বাসের মানুষের বিয়ের ক্ষেত্রে মৌলিক ফারাক ধর্মকেন্দ্রিক। কিন্তু এই ফারাকটুকু ধারণ করেই দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাঙালির নিত্যযাপন পরিচালিত হয় অভিন্ন লোকাচারকে কেন্দ্র করে। ধর্মীয় নয় বরং এই অঞ্চলের ভাষাগত পরিচয়-সত্তাই এর ভিত্তি। বাংলার গণমানুষের অধিকাংশই বাঙালি, সেই বাঙালি হিন্দুই হোক কিংবা মুসলমান, তার পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভাবনাপ্রক্রিয়া, ভাববিনিময়ের ধরন ইত্যাদির ক্ষেত্রে মূলগত বা কাঠামোগত কোনো ফারাক নেই।
এ কথা ঠিক, এই অধুনান্তিক সময়ে বাঙালি বিয়ের ক্ষেত্রে লোকাচারের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বৈভব ও বিত্ত প্রদর্শনে। যদিও তার পাশাপাশি বিবাহকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় বা আইনি চুক্তি ও ধর্মীয় বিধান পালনের রীতি আজও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অক্ষুণ্ন, কিন্তু ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে জাতিসত্তার নিজস্ব লোকাচারগুলো, যা আসলেই সাংস্কৃতিক পরিচিতি-সত্তার চিহ্ন বহন করে।
নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লৌকিক যাপন নির্ভর করেই প্রবাহিত হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি। বাঙালির দিনযাপনের নিত্য আচার-অভ্যাসের ভিত্তি বা ‘বেস’-এর মধ্যে তাই ধর্মের চেয়েও ক্রিয়াশীল সমাজ ও সংস্কৃতি। আর অবকাঠামো বা সুপার স্ট্রাকচারের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়। যা হোক, মোট কথা, বাঙালির সংস্কৃতির মূলগত ভিত্তির ক্ষেত্রে যে ঐক্য, সেটাই প্রতিফলিত হয় জীবনের মৌলিক কতগুলো ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লোকাচারের মধ্যে। বিবাহ সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। অঞ্চলভেদে অবশ্য বাঙালির বিয়েকেন্দ্রিক লোকাচারে হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে কিছু আঞ্চলিক লোকাচারে ফারাক তৈরি হয়, কিন্তু মোটা দাগে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলিমের বিয়ের লোকাচার এক। কেননা ভাষা, লোকাচার ও লোকযাপনই তৈরি করে জাতির পরিচিতি-সত্তা। বাংলার হিন্দু-মুসলমানের বিয়ের অভিন্ন লোকাচার তাই বাঙালি পরিচিতি-সত্তার অনেক বিষয়ের মধ্যে প্রতিনিধিস্থানীয়।
বাঙালির বিয়ের লোকাচারগুলো তৈরি হয়েছে মূলত প্রকৃতিনিবিড় সৌন্দর্যধারণা আর কামশাস্ত্রকে কেন্দ্র করে। তার চেয়েও এই লোকাচারগুলোর ভাবনার নিগূঢ়ে রয়েছে পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্ম হয়ে ওঠার প্রণোদনা। পাত্র ও পাত্রীর একাত্ম হওয়ার আগে একে অন্যকে জেনে নেওয়ার নানা লৌকিক ব্যবস্থাপনা। শুধু পাত্রপাত্রীই নয়, তাদের সমাজ, স্বজনও দুটি মানুষের ঘর বাঁধার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঁধা পড়ে আত্মীয়তায়। দুজন মানুষের পরিণয় দুটি গোষ্ঠী, দুটি সমাজ, দুটি অঞ্চলকে একই সূত্রে গাঁথে। তবে অনেক লোকাচারই যেহেতু তৈরি হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, তাই সামন্তব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিক নানা প্রকরণও কোনো কোনো লোকাচারের মধ্যে রয়ে গেছে।
বিয়ের আগে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের লোকাচার কতগুলো পর্বে বিভক্ত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কনে দেখা বা পাত্র দেখা, কনে ও পাত্রপক্ষের মধ্যে পাকা দেখা ও আশীর্বাদ বা পানচিনি। পারিবারিকভাবে সম্বন্ধ করে বিয়ের ক্ষেত্রেই প্রাক্-বিবাহ পাত্র-কন্যা দেখার এই আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। তবে প্রণয়-বিবাহের ক্ষেত্রেও অনেক সময় বাবা-মায়ের সম্মতি নিয়ে ঐতিহ্য মেনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্র-কন্যা দেখা ও পাকা দেখার পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আর পাকা দেখার মধ্য দিয়ে বিয়ের কথাবার্তা ও দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে আশীর্বাদ বা পানচিনি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। পাত্র-কন্যার কাছের আত্মীয়স্বজন একে অন্যকে মিষ্টিমুখ করান, খয়ের-সুপারি-মসলাসহযোগে সাজা পান বিনিয়ম হয়। ওই দিন পাত্র-পাত্রীর মধ্যে অঙ্গুরীয় বিনিময়ের রিচ্যুয়ালও রয়েছে। তবে লৌকিক আচারের নাম করে পাত্রী দেখার সময় তাকে হেঁটে দেখাতে বলা, তার চলন-বলন দেখে টীকা-টিপ্পনী করা অথবা পাত্রীর পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে গুঞ্জন করা, পাত্রীকে সামাজিক অনুশাসন-সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন করা এবং পণপ্রথার প্রসঙ্গ টেনে আনার মতো বিষয়গুলো পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এগুলোকে কোনোভাবেই লোকাচারের মধ্যে ফেলা যায় না।
আশীর্বাদ বা পানচিনির পরে আসে নির্ধারিত বিয়ের কার্যসূচি। বিয়ের আগে অনুষ্ঠিত হয় ‘গায়েহলুদ’। পূর্ব বাংলায় বা আজকের বাংলাদেশে গায়েহলুদের জন্য আলাদা দিন নির্ধারিত থাকে, আর পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গায়েহলুদ অনুষ্ঠিত হয় বিয়ের দিন সকালে। বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম- উভয়ের ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। তবে পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম ও মফস্বলে অনেকের বিয়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান (বিশেষত বাঙালি মুসলমানের) সকালে অনুষ্ঠিত হলে বিয়ের আগের দিন গায়েহলুদ হয়। আর বাংলাদেশে তো গায়েহলুদকে কেন্দ্র করে বিরাট আনন্দযজ্ঞ চলে। জন্ম-বিবাহ-মৃত্যুকেন্দ্রিক জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিয়ে, আর এতে পাত্রীকে রূপলাবণ্যে ফুটিয়ে তুলতে গায়েহলুদ গুরুত্বপূর্ণ। শুধুই পাত্রী নয়, পাত্রকেও হলুদ মাখানো হয়। পাত্রের কাছে পাত্রীর রূপলাবণ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই পাত্রীর কাছেও পাত্রের শরীর ও মন তো আকর্ষণীয় করে তোলার দাবি রাখে। তাই গায়েহলুদের এই আয়োজন। তারপর হলুদগাত্র বা হলুদ মাখা শরীরে গোসল বা হলুদ স্নান… দুটি মানুষের বিয়ে উপলক্ষে তাদের গায়েহলুদকে কেন্দ্র করে হলুদ খেলায় মেতে ওঠেন আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব।
গায়েহলুদের গানও বাঙালির বিয়ের একটি মুখ্য লোকায়ত অনুষঙ্গ। বিয়েকেন্দ্রিক নানা গান গায়েহলুদ উপলক্ষে পরিবেশিত হয় মূলত পাত্রীর বাড়িতে। যেমন সুনামগঞ্জের জনপ্রিয় গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গানটি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন, কিন্তু নাটক-চলচ্চিত্রে এই গান বহুল ব্যবহৃত। বাংলার লোকসংস্কৃতির মধ্যে বাঙালির লোকাচারকেন্দ্রিক এই গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই গানে কন্যাকে সাজিয়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে,
লীলা বালী লীলা বালী ভর যুবতী সই গো
কী দিয়া সাজাইমু তোরে।
মাথা চাইয়া সিন্থি দিমু ঝাঝরি লাগাইয়া সই গো
কী দিয়া সাজাইমু তোরে।…
দুই বাংলার রাজনৈতিক পুনর্মিলনের কাক্সক্ষায় বিবাহ আখ্যানের আবহে নাট্য আন্দোলনের ন্যারেটিভকে ‘কোমলগান্ধার’ ছবিতে তুলে ধরেছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। তিনি সেই ছবিতে একটি গানকে বারবার ব্যবহার করেছেন। গানটিও বাঙালির গায়েহলুদ তথা বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি গান। আজও গায়েহলুদে কোথাও কোথাও এই গানটা গাওয়া হয়। গানটি হলো,
আমের তলায় ঝামুর ঝুমুর কলার তলায় বিয়া
আইলারে সোন্দরীর জামাই মাথায় মুকুট দিয়া
মুকুটের তলে তলে চন্দনের ছিটা
সুন্দরী কইন্যারে দিলা সিন্দুরের ফোঁটা।…
গায়েহলুদকে কেন্দ্র করে আরও একটি মজার গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গানটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ের। কিন্তু লোকায়ত একটা ভাব আছে। গানটা হলো-
বলি হাই ক্লাস, লো ক্লাস সব জাতি
বাবা ধুমে ধামে করে তাদের বিয়ে শাদী
গায়ে হলুদের দিনে মজা হয় যে বেশি
আবাল বৃদ্ধ বনিতা তার মুখে থাকে হাসি…
অনেক ক্ষেত্রেই গায়েহলুদকে কেন্দ্র করে পাত্রের বাড়ি থেকে কন্যার বাড়িতে অনেক ‘তত্ত্ব’ আসে। এই তত্ত্ব কিন্তু থিওরি নয়। উপহারসামগ্রী। পাত্রীর সাজসজ্জা ও রূপসজ্জাসামগ্রী, পাত্রীর বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্য উপহার আর ফল, মিষ্টান্নসহ নানা খাদ্যসামগ্রী থাকে তত্ত্বের তালিকায়। সেগুলো নানাভাবে সাজানো হয়। তৈরি করা হয় ক্ষীরের পুতুল, ক্ষীরের প্রজাপতি, নানা কিছুর আকার দিয়ে ফল ও সবজি কাটা হয়, উপহারের শাড়ি ও পোশাককে এমনভাবে ভাঁজ করা হয়, যাতে তার আকার হয়ে ওঠে নৌকা কিংবা পালকির মতো। পাত্রের বাড়িতেও এই তত্ত্ব যায়, তবে তা বিবাহ কার্যসূচির শেষ লগ্নে।
এরপর আসে বিয়ের দিন। বিয়েকে কেন্দ্র করে মালাবদল, কড়ি খেলা, দুয়ার আটকানো, বাসি বিয়ে, বিয়ের ছড়ার মতো হাজারো লোকাচার রয়েছে।
অনেক লোকাচারের মধ্যে রয়ে গেছে নানা যৌন প্রসঙ্গ। তবে বাঙালি মুসলমানের দেনমোহর দেওয়া, বিয়ে পড়ানো আর বাঙালি হিন্দুর অগ্নিকুন্ড প্রদক্ষিণ ও মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে কন্যার মাথায় পাত্রের সিঁদুর দানের মতো ধর্মীয় প্রথার মধ্যেও জায়গা করে নিয়েছে নানা লৌকিক উপাদান। সেগুলো বিয়ের সময় উপস্থিত মানুষজন আজও উপভোগ করেন। বিয়ের দিন বরযাত্রী আর বউভাতের দিন কনেযাত্রীও দুটি পরিবারের মধ্যে একাত্ম হয়ে ওঠার এক আনুষ্ঠানিক আয়োজন। তা ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন আর ভোজসভা তো রয়েছেই। অনেক ক্ষেত্রেই বউভাতের দিন স্বয়ং বউ নিজের হাতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের খাবার পরিবেশন করেন। বাসররাত জাগা স্বজন-বন্ধুদের মধ্যে নানা দুষ্টুমি, মজার ঘটনা বাঙালির বিয়েকে করে তোলে রঙিন, ঠিক যেন সিনেমার মতো…
আবার বিয়েকে কেন্দ্র করে মন-কষাকষি, দুই গ্রামের মধ্যে লাঠিখেলা, কোথাও আবার তা থেকে উত্তেজনা তৈরি হওয়ার মতো এমন অনেক বিষয় ছিল, যেগুলো কিছু সময়ের জন্য পরিস্থিতি ভারী করে তুললেও তারপর সূচনা হতো পাত্র ও কন্যার পারিপার্শ্বিক দুটি সমাজের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন। আর সেসব হয় না হয়তো, তবে সেসবের স্মৃতির মধ্যেই আজও যেসব লৌকিক আচার জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির বিয়েতে, সেই সব লোকাচার বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমের বাংলার পরিচিতি সত্তার সেতুতে আপন করে রেখেছে।
একইভাবে বাঙালি বৌদ্ধ ও বাঙালি খ্রিস্টানদের বিয়েতে ধর্মীয় প্রসঙ্গের বাইরেও বাংলার লোকাচার প্রায় একই রকম, একটু কম বা বেশি। তবে বাংলার অন্যান্য নৃসত্তার বিয়ের মাধুর্য ও লোকাচার অন্য রকম। তাদের বিয়ের লোকাচার বাংলার লৌকিক যাপন ও লোকসংস্কৃতিকে বর্ণময় করে রেখেছে।