বিশেষ ফিচার I নীলিমায় নীল
বাংলার নীল। বেঙ্গল ইন্ডিগো। এর জগৎজোড়া খ্যাতি। চাহিদাও। ঔপনিবেশিকতাই একে প্রসারতা দিয়েছিল, যদিও বাঙালির ইতিহাসে তা এক যন্ত্রণার অধ্যায় হয়ে আছে। আজ আর নেই নীলকর সাহেবদের নিপীড়ন; বরং পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে সেই নীল আজ কল্যাণের বার্তাবহ। সমৃদ্ধির অনুঘটক। কেয়ার বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে পরিবর্তনের সেই গল্প সরেজমিনে ঘুরে এসে লিখেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার এস.এম. মাঈন উদ্দিন ফুয়াদ
গত সংখ্যার পর…
সূর্য ওঠার আগে নীল গাছ কাটতে হয় গাছের আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য এবং ২ ঘণ্টার মধ্যে জলাধারে ভেজাতে হয়। নীল গাছ কেটে এনে জাগ দেওয়ার আগে অবশ্যই পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়।
কমপক্ষে তিনটি হাউজে নীল গাছের পাতা ও ডাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রথম হাউজে পাতা ও ডাল পরিষ্কার পানিতে চুবানো হয়। পরিষ্কার ডাল পাতাগুলো তুলে দ্বিতীয় হাউজে সুন্দর করে সাজানোর পর পানি ভর্তি করা হয়। এমনভাবে নীল পাতা ও কা-গুলো রাখা হয়, যাতে পানির উপরে না ভাসে। সে জন্য লম্বা লাঠি আড়াআড়ি করে চাপ দেওয়া হয়। একে বলা হয় জাগ দেওয়া। এই অবস্থায় ১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। নীল গাছ ভিজিয়ে রাখা পানি টেনে তৃতীয় হাউজে তোলা হয়। এর অবস্থান আগের দুটি হাউজ থেকে উপরে হয়। তৃতীয় হাউজে নীল গাছ ভেজানো পানিকে শাওয়ার দিয়ে অক্সিডাইজ করতে হয়। মোটর লাগিয়ে পানিকে ক্রমাগত ঘূর্ণনের মধ্যে রাখতে হয়, যাতে অক্সিজেনের সংস্পর্শে বেশি আসে। অক্সিডাইজ করতে করতে এই পানির উপরের স্তরে প্রচুর ফেনা তৈরি হয়। এরপর ৮ ঘণ্টা পানি রেখে দেওয়া হয়। উপরের স্তরের পাতলা পানি ও ফেনা বের করে ফেলা হয়; ৮ ঘণ্টা পরে নিচের পানির স্তরে গাদ জমা হয়। এই গাদই মূলত প্রাথমিক নীল। পাইপ দিয়ে তা বের করে চুলায় সেদ্ধ করা হয়। এতে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। পানিশূন্য গাদটা পলিথিন মোড়ানো ট্রেতে করে রোদে শুকানো হয়। অনেক সময় রোদে না শুকিয়ে এই গাদকে জেলি হিসেবে রাখা হয় রঙ করার সুবিধার্থে। শুকনো নীলকে মেশিনে গুঁড়া করে পাউডার বানিয়ে এয়ার টাইট প্যাকেটে বাজারজাত করা হয়। তবে তৃতীয় হাউজে নীল গাছের পানি অক্সিডাইজ করার সময় সামান্য পরিমাণ ‘কস্টিক সোডা’ মেশাতে হয়।
২৫০ কেজি নীল পাতায় তৈরি হয় ১ কেজি নীল পাউডার। এই পরিমাণ নীল পাতা চাষ করতে জায়গা লাগে ২৫ শতক বা ১/৪ একর। ১ কেজি নীল পাউডার উৎপাদন করতে ৫ দিনে ৫ জন শ্রমিক লাগে; যাদের মজুরি দিতে হয় ৪ ডলার হিসেবে। নীল গাছ কাটা থেকে পাউডার করা পর্যন্ত ৬-৭ কেজি নীল তৈরিতে ৫ দিনে প্রায় ৪০ জন শ্রমিক লাগে। ‘কিং অব কালার’ হিসেবে খ্যাত এই নীল তৈরি যথেষ্ট শ্রম-সময়সাপেক্ষ আর ব্যয়বহুল। তবে প্রতি কেজি নীলের মূল্য ৬০ ডলার।
ইন্ডিগো পাউডার না হয় হলো, এখন জেনে নেওয়া যাক এর ডায়িং পদ্ধতি। ২০ গজ মার্কিন সুতি কাপড় রঙ করতে হলে ২ লিটার পানিতে ১ কেজি ইন্ডিগো পাউডার মিশিয়ে ২ থেকে ৭ দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর যে ভ্যাট তৈরি হবে, তা একটি বড় পাত্রে ২০ লিটার পানিতে ১ লিটারের সমপরিমাণ ভ্যাট মিশিয়ে ৫০০ গ্রাম হাইড্রোজ, ৪০০ গ্রাম কস্টিক সোডা দিয়ে ২০ গজ কাপড় চুবিয়ে রাখতে হবে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। শুধু তাতেই হবে না, এমনভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে পুরো কাপড়ে সমানভাবে ইন্ডিগোর এই মিশ্রণ লেগে যায়। তারপর কাপড় উঠিয়ে ছায়ার মধ্যে বাতাসে শুকাতে হবে। যত হাওয়া লাগবে, রঙ ততই গাঢ় হবে। রঙ হালকা করতে চাইলে ইন্ডিগোর পরিমাণ কম মেশাতে হবে। গাঢ় করতে চাইলে দুই থেকে তিনবার উল্লিখিত নিয়মে কাপড় ভিজিয়ে বাতাসে শুকাতে হবে।
ইন্ডিগো ডাই করার পর রঙ ফেলতে হয় না।
একই মিশ্রণে নতুন ডাই মিশিয়ে বারবার রঙ করা যায়। প্রাচীনকালে মাটির নিচে বড় কলসি বসিয়ে ইন্ডিগো রঙ সংরক্ষণ করা হতো। মিশ্রণের মাত্রার ওপর ব্যবহারের সময় অনুপাতে চিহ্নিত করে রাখা হতো, যাতে ব্যবহারে ভুল না হয়। বর্তমানে মাটির উপরেই বড় পাত্রে ইন্ডিগো ডাইয়ের মিশ্রণ সংরক্ষণ করা হয়। এই পাত্রগুলো সাজানো হয় ইন্ডিগো মিশ্রণের পরিমাণ অনুযায়ী। গাঢ় থেকে হালকা নির্দেশ করেই।
যদিও ইন্ডিগোকে ন্যাচারাল ডাই বলে থাকি; কারণ, এতে কিছুটা হাইড্রোজ ও কস্টিক সোডা মেশানো ছাড়া মূল ভ্যাটই তৈরি হবে না।
ন্যাচারাল ডাই পারদর্শীরা শতভাগ ন্যাচারাল ভ্যাট তৈরির চেষ্টা করছেন।
শতবর্ষ আগে এই উপমহাদেশে ইন্ডিগো ভ্যাট হাইড্রোজ আর কস্টিক সোডার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো চুন ও সাজিমাটি। ট্র্যাডিশনাল সেই পদ্ধতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
আগেই বলা হয়েছে, ইন্ডিগো পাউডার তৈরি একটি দীর্ঘ ও শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া। সঠিক বাজার পাওয়া না গেলে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অন্যদিকে যথাযথভাবে রঙ তৈরি করতে পারলে এর ক্রেতার অভাব হবে না। তেমনি বাজারের খোঁজখবর এবং নীল নিয়ে লিভিং ব্লুর দেশি ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়েছে, লিভিং ব্লুকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি নিরলসভাবে করে চলেছেন মিশায়েল আজিজ আহমাদ। লিভিং ব্লু লুয়েভে স্পেনের ১৫০ বছরের পুরোনো ব্র্যান্ড নাতাশা ফন হিরশহাউশেন, কানাডার মাইওয়া হ্যান্ডপ্রিন্ট ও আলোহা, স্যালি ক্যাম্পবেল অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির স্যাক্সনি ডাকস, ফ্রান্সের গ্যালারি লাফায়েত, জাপানের ক্যালিকো, ইবু মুভমেন্ট আমেরিকা, ভারতের জয়পুর ই-কমার্স- এসব ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছে।
কিছু ফ্যাশন শো ও প্রদর্শনীর সুবাদে ঈর্ষণীয় সাড়া পেয়েছে লিভিং ব্লু। সান্ট ফে ইন্টারন্যাশনাল ফোক আর্ট মার্কেট টেক্সটাইল প্রদর্শনীতে ২০১৪ থেকে ২০১৬ টানা তিন বছর অংশ নিয়েছে ব্র্যান্ডটি। বার্লিন ফ্যাশন উইকের অংশ গ্রিন শোরুমে উপস্থিত থেকেছে ২০১৫ থেকে ২০১৭ অব্দি। এই আসরে এথিক্যাল ফ্যাশন নিয়ে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই অংশ নেয়। প্যারিসে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনী মেজোঁ ডি এক্সেপশনসে অংশ নিয়েছে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০টি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। নিউইয়র্কভিত্তিক হোম টেক্সটাইলস প্রদর্শনী ‘নিউইয়র্ক নাও’তে গেছে ২০১৬ সালে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ার হস্তশিল্পভিত্তিক মেলা দস্তকার নেচার বাজারে একটানা অংশ নিয়েছে ২০০৯-২০১৪ সালে। প্রাকৃতিক নীল ও নীলজাত পণ্য নিয়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মেলা ইন্ডিগো সূত্রাতে গেছে ২০১৭ সালে। লিভিং ব্লু এবং নাতাশা ফন হিরশহাউশেন কো ব্র্যান্ডে ২০১৭ সালে বার্লিন ফ্যাশন উইকে অংশগ্রহণ করেছে। ২০১৪ সালে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিলের ‘অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স’ পেয়েছে। ২০১৬ সালে ‘লুয়েভে ক্রাফট প্রাইজ’-এ ফাইনালিস্ট হিসেবে নির্বাচিত হয় লিভিং ব্লুর কাঁথাশিল্পী সোনারানী রায়ের একটি নকশিকাঁথা। সারা পৃথিবী থেকে ৩৯৫১টি হস্তশিল্প সেখানে জমা পড়েছিল। সেই সম্ভার থেকে শীর্ষ ২৬টিকে মূল তালিকায় রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি দেশীয় পর্যায়ে অরণ্য, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, প্রকৃতি, এমসিসি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে লিভিং ব্লু ইন্ডিগো সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া ভারত, তাইওয়ান, জাপান, কেনিয়া, আমেরিকা ও ফ্রান্সে ইন্ডিগো পাউডার রপ্তানি করে থাকে।
ইন্ডিগো একক রঙ হিসেবে যেমন অসাধারণ, তেমনি অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে আরও আকর্ষক রঙ উৎপন্ন করে। হরীতকী, খয়ের, ডালিমের খোসা, আনার, কলার মোচা, মঞ্জিতের শিকড়, গাঁদা ফুল, মেহেদি পাতা, চা-পাতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে ইন্ডিগোর মিশ্রণে অসাধারণ রঙ তৈরি হয়ে যায়।
বিশ্বজুড়ে ন্যাচারাল ইন্ডিগো ডায়িংয়ের চাহিদা ব্যাপক। অনেক জায়ান্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ডেনিম ডাই করা হচ্ছে ন্যাচারাল ইন্ডিগোতে। হয়তো সে নীল অন্য দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। তবে আমেরিকার একটি ডেনিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লিভিং ব্লুর কাছ থেকে ইন্ডিগো কিনছে। নীল চাষ আরও বিস্তৃত হলে পোশাকশিল্পে এর চাহিদা মিটবে পুরোপুরি।
ইতিহাসে নীল উৎপাদন শোষণ আর বঞ্চনার স্মারক হয়ে আছে। অথচ সময়ের পরিক্রমায় সেটাই আজ স্বনির্ভরতার হাতিয়ার।
এটা সত্য, আজ লিভিং ব্লু যে কাজটি করছে, অনেক আগেই মুক্তাগাছায় তা শুরু করেছিল মেনানাইট সেন্ট্রাল কমিটি বা এমসিসি। বর্তমানে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্থানীয়ভাবে স্বাবলম্বী উন্নয়ন প্রকল্প ‘কর্মভূমি’। রংপুরে ‘কালার ফ্রম দ্য চর ফেন্ডশিপ’। বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে চর অঞ্চলের পতিত জমি লিজ নিয়ে নীল চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া কুমিল্লার চিওড়ায় সীমান্তবর্তী জায়গায় ‘ভিটা ওয়ার্ল্ড এগ্রো প্রজেক্ট; পরীক্ষামূলকভাবে নীল চাষ শুরু করেছে।
ফ্যাশনে নীল আভিজাত্যের প্রতীক। নীল চাষ আজ দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যম। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে এর সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
এই লেখা তথ্যবহুল করতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন: টেকনিক্যাল অফিসার সৈয়দ মুর্তজা জাহাঙ্গীর, লিভিং ব্লুর প্রোডাকশন ম্যানেজার মজিবুল হক মমি, ‘নিজেরা কটেজ’-এর ডিজাইনার ও গবেষক ফাইকুজ্জামান বাদশা ও ডিজাইনার আশরাফুর রহমান।