ফিচার I ফুল-চা
পছন্দের পানীয়র প্রশ্নে অনেকেরই উত্তর ‘চা’। তবে এটি তৈরির উপকরণ কেবল চা-পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফুলের পাপড়িতেও তৈরি হতে পারে স্বাস্থ্যকর ও সুপেয় এই পানীয়
বিষাক্ত নয় এমন ফুল দিয়েই চা তৈরি সম্ভব। কিন্তু স্বাদের খোঁজ করলে হাতে গোনা কয়েকটি পুষ্পেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। যেমন জুঁই, চন্দ্রমল্লিকা, জবা, গোলাপ, অপরাজিতা, গাঁদা ইত্যাদি। এসব ফুলের বাগান থাকলে কিংবা বারান্দায় কয়েকটি গাছ বুনলে সেখান থেকেই পাপড়ি সংগ্রহ করা যেতে পারে। অন্যথায় অনলাইন কিংবা সুপারশপের দ্বারস্থ হতে হয়। সেখানে ফুলের শুকনা পাপড়ি মেলে। বাড়িতেও পুষ্প শুকিয়ে নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে পাপড়িগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর রোদে কিংবা আভেনে শুকিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
বাড়ির ফুলে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম। কেননা, শৌখিনদের মধ্যে কীটনাশক বা সার প্রয়োগের প্রবণতা খুব একটা দেখা যায় না। শুকানো পাপড়ি অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। ফলে চা-পাতার মতোই তা সংরক্ষণযোগ্য। গরম পানিতে শুকনার সঙ্গে তাজা পাপড়ি দিলেই ফুলের চা হয়ে যায়। সঙ্গে স্বাদমতো চিনি ও অন্যান্য উপযোগী মসলাও যোগ করা যেতে পারে।
ফুলের চা বেশ স্বাস্থ্যকর ও সুগন্ধযুক্ত। সুবাসের জন্যই অনেকে জুঁই-চা পছন্দ করেন। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে চৈনিকদের মধ্যে এই ফুলের চায়ের প্রচল ছিল। তবে বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়ে সতেরো শতকে। জুঁই-চা চীনে প্রেমের প্রতীক হিসেবে গণ্য। দেশটির উত্তরের বাসিন্দারা অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে এই ফুলের চা দিয়ে। জুঁই প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি। ফলে বাড়তি চিনি এড়িয়ে চলা যায়। জুঁই-চা পানে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত হয়। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। এই চায়ে ব্যথানাশী গুণ আছে। লোহিত রক্তকণিকার কোষঝিল্লি সুরক্ষিত রাখতে পারে জুঁই-চা।
স্বাদ ও গন্ধ ছাড়াও ফুলের চায়ের রঙ চা-পায়ীদের আকৃষ্ট করে। যেমন জবা ফুলের চা। বড় একটি পুষ্পের পাপড়ি সংগ্রহ করে প্রথমে ধুয়ে নিতে হয়। তা সরাসরিই ব্যবহার করা যায়; শুকানোর দরকার হয় না। প্রথমে পানিতে আদাকুচি, লেবু ও চিনি মিশিয়ে ফোটাতে হবে। তারপর তাতে ফুলের পাপড়ি ছেড়ে দিলে রঙ ছাড়বে। আরও কিছুক্ষণ পানি ফুটিয়ে চা গাঢ় হলে তা ছেঁকে নিলেই হয়ে যাবে জবা-চা। কাপে ঢেলে লেবুর রস মেশালে রঙ গাঢ় হবে। একটি গ্রিন টি-ব্যাগ ডুবিয়ে নিলেই জবা-চা পরিবেশনের উপযোগী হয়। অনেকে এই পানীয় ঠান্ডা করে বরফযোগেও পান করেন। জবা-চা হজমশক্তি বাড়ায়। বাওয়েল মুভমেন্ট উন্নত করে। কনস্টিপেশন সারায়। নিয়মিত জবা-চা পানে শরীরে শর্করার শোষণ কমে। ফলে ওজন কমে। জবা-চা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায়। জুঁই-চায়ের মতো এটিও হার্ট ভালো রাখে। পেটের রোগবালাই থেকে সুরক্ষা দেয়। পেপটিক আলসার সারাইয়েও কাজ করে এ ফুলের চা। এই পানীয় ভিটামিন সি-এর ঘাটতি মেটায়। ফলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে। সর্দিকাশি দূর করার জন্য এই চা বিশেষ উপকারী। জবার চা শরীরের টক্সিক বের করে দেয়। এতে লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ে। নার্ভাস সিস্টেমের প্রদাহও কমাতে পারে এ ফুলের চা।
প্রায় একই পদ্ধতিতে তৈরি হতে পারে গোলাপ-চা। এ ক্ষেত্রে শুকনা কিংবা তাজা- উভয় প্রকার পাপড়িই ব্যবহার করা যায়। গোলাপের পাপড়িগুলো প্রথমে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে, তারপর একটি পাত্রে পানি ও পাপড়ি দিয়ে অল্প আঁচে ফোটাতে হয় মিনিট পাঁচেক। চুলা নিভিয়ে আদা ও দারুচিনিগুঁড়া মিশিয়ে দিতে হবে। কেউ কেউ এলাচিগুঁড়াও যোগ করেন। এবার মিশ্রণটি এক মিনিট ঢেকে রাখতে হবে। এরপর পান করা যেতে পারে। শুকনা পাপড়ি দিয়েও গোলাপ-চা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে তাজা পাপড়ির জায়গায় শুকনাগুলো দিলেই চলবে। ঘরে গোলাপ না থাকলে বাজার থেকে কিনে আনা যেতে পারে। তবে সেসব পাপড়িতে হোয়াইট টি, শুকনা ক্যামোমাইল ফুল ও রোজমেরি মেশানো থাকে। গোলাপ-চায়ের উপকারিতাও অনেক। এটি পানে ওজন কমে। এ চায়ে থাকা অ্যান্টিইনফ্লামেটরি শরীরের ফোলাভাব কমায়। ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সারায়। ইউরিন ইনফেকশন থাকলে গোলাপ-চা পানে উপকার মেলে। ভিটামিন সি থাকায় অন্যান্য ইনফেকশন থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়ে। গোলাপ-চা মনকে ফুরফুরে করে। ত্বক ও চুলের উন্নতিও ঘটায়।
রঙ, স্বাদ ও পুষ্টিগুণে অনন্য নীল-চা। তৈরি হয় অপরাজিতা থেকে। প্রথমে প্রয়োজনমতো পানি ফুটিয়ে নিতে হবে। তাতে শুকনা অপরাজিতার পাপড়ি যোগ করলে রঙ ধীরে ধীরে নীল হয়ে আসে। এবার কয়েকটি পুদিনাপাতা দিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে। ছেঁকে কাপে ঢেলে মধুযোগে পরিবেশন করা যেতে পারে। চায়ের রঙ আরও গাঢ় চাইলে লেবুর রস যুক্ত করতে হবে। অপরাজিতা-চা মনকে দিনভর চাঙা রাখে। এতে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান আছে। ডাইইউরেটিক হওয়ায় এ চা ইউরিনেশনে সাহায্য করে। এতে সাইক্লোটাইডের অ্যান্টিএইচআইভি ও অ্যান্টিটিউমার গুণ রয়েছে। এ ফুলের চা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। এর ফ্লাভনয়েড চামড়ায় কোলাজেন তৈরি করে ইলাস্টিসিটি বাড়ায়। ফলে বলিরেখা পড়ে না। অ্যান্থোসায়ানিন থাকায় চুল পড়ার সমস্যা দূর করে। স্ক্যাল্পে রক্তসঞ্চালন ত্বরান্বিত করে হেয়ার ফলিকল বাড়ায় অপরাজিতা-চা। তা ছাড়া রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত পানে মানবদেহ ক্ষতিকর সংক্রমণ থেকে রেহাই পায়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এ ফুলের চা বিশেষ উপকারী। এটি হজমশক্তি বাড়ায়। লিভারে বাইল তৈরিতে সাহায্য করে। এ ছাড়া বমিভাব কাটাতেও পান করা যেতে পারে অপরাজিতা-চা।
মধুযোগে সুপেয় হয় গাঁদা-চা। এ ফুলের কিছু পাপড়ি রোদে শুকিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তারপর পানি ফুটিয়ে তাতে পাপড়িগুলো ছেড়ে পাত্রটি ঢেকে দিতে হবে। এই অবস্থায় মিনিট দশেক ফোটালে তৈরি হবে গাঁদা-চা। নামিয়ে ছেঁকে নিলে পরিবেশনের উপযোগী হয়। মিষ্টতা আনতে যোগ করা যাবে মধু। গাঁদার চা পানে গ্যাস্ট্রিক দূর হয়। এই ফুল ক্যানসার প্রতিরোধী। পাকস্থলী, ব্রেস্ট ও কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে এটি কার্যকর। এই ফুলের চা ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। নিয়মিত পানে ব্রণ সারে। অনিয়মিত ঋতু¯্রাবের সমস্যা দূর করতে গাঁদা-চা পথ্যতুল্য। মাসিকজনিত পেটব্যথাও কমায়। গাঁদা-চা পানে টিউমারও প্রতিরোধ হতে পারে।
এসব ছাড়াও লেমন বার্গামট, ল্যাভেন্ডার, ক্যামেলিয়া, বি-বাম ইত্যাদি ফুল দিয়েও সুস্বাদু চা হয়।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট