skip to Main Content

ফিচার I কাঠ যখন আহার্য

কাঠেও তৈরি হতে পারে ব্যতিক্রমী ও সুস্বাদু খাবার। সাম্প্রতিক কালের এ এক চমকপ্রদ উদ্ভাবন। গত দুই দশকে যা আর্জেন্টিনার খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

রান্নার জন্য জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারের কথা কে না জানে। কিন্তু এটি যে খাদ্যবস্তু হতে পারে, তা কি ভাবা গেছে কখনো? সেটাই সম্ভব করেছে মলিকুলার গ্যাস্ট্রোনমি। এতে রান্নায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে খাবারের টেস্ট ও টেক্সচারের পরিবর্তন করা হয়। কাঠ ও বাকলে প্রচুর ফাইবার থাকা সত্ত্বেও তা মানুষের হজমযোগ্য নয়। তবে এমন একটি গাছ আছে, যা খাওয়ার উপযোগী, সুস্বাদুও বটে। গাছটির নাম আকারাতিয়া। আর্জেন্টিনায় জন্মানো এরই কাঠ খাদ্যোপযোগী। গাছটি প্রায় ১৫ মিটার (৫০ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে এবং এর মূল কান্ড খাওয়া হয়। এই ভোজ্য কাঠ তক্তা, মিহি গুঁড়া বা তুষ এবং ছোট ছোট চারকোনা পিসে পাওয়া যায়। এটি সিরাপ বা মধুতে ভেজানো থাকে। এ ছাড়া এই কাঠের সুস্বাদু জ্যাম ও চকলেট বান পাওয়া যায়।
এখন মডার্ন আর্জেন্টাইন কুজিনে আকারাতিয়া কাঠ একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। গাছটি সে দেশের খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। অনেক নামীদামি আর্জেন্টাইন রেস্টুরেন্ট সুস্বাদু পদ তৈরিতে এই কাঠ ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হচ্ছেন ফারনান্দো রিভালোরা। তিনি টপ শেফ মলিকুলার গ্যাস্ট্রোনমিস্ট। তার রেস্টুরেন্ট এল বাকিনোর মেনুতে এই ভোজ্য কাঠ প্রথম যুক্ত হয়। বুয়েনেস এইরেসে অবস্থিত তার রেস্তোরাঁর অনেক পদে, বিশেষ করে ডেজার্ট আইটেমে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ভোজ্য কাঠের স্পঞ্জের মতো টেক্সচার ও প্রাকৃতিক মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে সিরাপের মিষ্টতা জোড় বেঁধে অসাধারণ ডেজার্ট কম্বিনেশন তৈরি করে। বিশেষ করে আইসক্রিম ও জ্যাম বানাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। কিছু শেফ ঝাল খাবার রান্নায় আকারাতিয়া কাঠ ব্যবহার করছে।
নরম, চিউয়ি টেক্সচারের এই কাঠের স্বাদ অনেকটা মিষ্টিআলু বা মিষ্টিকুমড়ার মতো, তবে সেটা সিরাপ বা মধুতে ভিজানো অবস্থায়। দেখামাত্র আমসত্ত্ব বলে মনে হতে পারে। পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে অন্যান্য সবজি বা ফলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এটি ফাইবারের দুর্দান্ত উৎস। এ ছাড়া এতে রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান।
আকারাতিয়া গাছ আর্জেন্টিনার পারানা জঙ্গলের ভেতরে লম্বা পাইন দ্বারা সুরক্ষিত বিশেষ বনাঞ্চলে জন্মে। এসব এলাকার আদিবাসীদের উত্তরসূরিরা আগে থেকেই গাছটির ভেষজ গুণাবলি সম্পর্কে জানত। শরীরের আর্দ্রতা ও স্বাস্থ্য ধরে রাখতে তারা এই গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করত। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এই অঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ার পাস্কুটি খেয়াল করলেন, একমাত্র আকারাতিয়া কোনো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং কাগজ তৈরির জন্য বন উজাড় করার পর এই গাছ ফেলে দেওয়াই নিয়ম। তিনি এর কাঠ খাদ্যোপযোগী করার লক্ষ্যে গবেষণা শুরু করেন। সেটি ভোজ্য কাঠ উৎপাদনের পেটেন্ট পায় এবং পরবর্তীকালে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তা বাণিজ্যিকীকরণের জন্য কোম্পানি খোলেন। নাম আকারাতিয়া ডেলিকাতাসেন।
গাছের কাঠকে ভোজ্য করে তোলার ধারণা খাদ্য বা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় নতুন নয়। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা খাদ্যসংকট নিরসনের জন্য গাছ এবং গাছের ছালকে খাওয়ার উপযোগী করার উপায় খুঁজছেন। কিন্তু সাধারণ গাছে পাওয়া সেলুলোজ মানুষের হজমযোগ্য নয়। আকারাতিয়া গাছ সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর কোষ পানি এবং খনিজ উপাদানের আধার। অন্যান্য গাছের কাঠের চেয়ে এতে সেলুলোজের পরিমাণ অনেক কম। সাধারণত একটি পূর্ণাঙ্গ গাছে তা থাকে ৩৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। আকারাতিয়া গাছে সেটি মাত্র ১০ শতাংশ। এ ছাড়া কোষের কম ঘনত্বের জন্য এটি সহজে প্রচুর সুক্রোজ ও গ্লুকোজ শোষণ করতে পারে। লিগনিন কম থাকায় এটি নরম স্পঞ্জের মতো আকার ধারণ করে। খাদ্যোপযোগী করার জন্য প্রথমে গাছটিকে কেটে তিন থেকে চার ফুটের তক্তা বানিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করার নিয়ম। বড় পাত্রে তিনবার স্টিম করা হয় এর ভেতরকার অ্যাসিড অপসারণের জন্য। এরপর কাঠের তক্তাগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় তিনবার রান্না বা সেদ্ধ করতে হয়। এতে কাঠের কোষ দুর্বল হয়ে আসে। একদম শেষে এতে মেশানো হয় পেক্টিন, গ্লুকোজ এবং সুক্রোজ। ফলে কাঠের ভেতর থেকে পানি নিঃসরিত হয়। পাশাপাশি সুন্দর রঙ এবং টেক্সচারও পাওয়া যায়। বিশ্বের বিখ্যাত ও মেধাবী কালিনারি এক্সপার্টরা এই কাঠের অনন্য বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে বানাচ্ছেন সুস্বাদু ও ব্যতিক্রমী পদ।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top