skip to Main Content

ফিচার I লুপ্তপ্রায় পিঠা

প্রযুক্তি ও নগরসংস্কৃতির চাপে গ্রামবাংলার অনেক পিঠা বিলুপ্তির পথে। কিছু অবশ্য আজও টিকে আছে। লিখেছেন সাবরিনা মুন্নী

ঋতু আর উৎসবভেদে ভোজনরসিক বাঙালির খাদ্যে রয়েছে ভিন্নতা। শীত মানেই গ্রাম কিংবা শহরে পিঠাপুলির ঘ্রাণ। হেমন্তের পাকা ধান কৃষকের ঘরে আসামাত্রই বাড়ির বউ-ঝি ব্যস্ত হয়ে পড়ে পিঠার আয়োজনে। খেজুরের রস, গুড়, চালের গুঁড়ার মিশ্রণের ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায় চারদিকে। গ্রামবাংলার পিঠা বানানো উৎসবেরই একটি অংশ। পৌষ মাসে নতুন চালের গুঁড়ায় পিঠা তৈরি হয় বলে এই উৎসবের নাম পৌষ পার্বণ। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ‘পৌষ পার্বণে’ এই উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় :
‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর
গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।
বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা
হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।’

কালের পরিক্রমায় অনেক পুরোনো অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে বাঙালির জীবনে। এখন কৃষকের ঘরে হেমন্তের পাকা ধান উঠলেও সেই পিঠা তৈরির সময় মেলে না। খুঁজে পাওয়া যায় না গাছিদের। খেজুরের রসের হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া যেমন দুষ্কর, তেমনি অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পিঠা-সংস্কৃতি। বাহারি নাম আর স্বাদের পিঠা ছাড়া বিয়ে, উৎসব- কিছুই বাঙালি চিন্তা করতে পারত না, সেখানেই আজ সগৌরবে জায়গা করে নিচ্ছে বিদেশি খাবার। বাংলাদেশে কত রকমের পিঠা তৈরি হতো, তার নির্দিষ্ট তালিকা করা আজও সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, তা ছিল শতাধিক রকমের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিঠাগুলো হলো চিতই, পাকানো, পাকোয়ান, পক্কন, পাটিসাপটা, কুশলী, ভাপা, ভাত, কাটা, নকশি, পুলি, দুধ, লাউ পায়েস, ছিট, লবঙ্গ, গোকুল, গড়গড়া, ম্যারা, মুঠা, সিদ্ধ, পুতুল, লরি, চাছি, সাগুদানা, ঝুড়ি, তারাজোড়া, জামাই, জামদানি, হাদি, পাটা, তেজপাতা, তেলেভাজা, ঝুরি, ফুলঝুরি, বিবিয়ানা, চষি পিঠা, খান্দেশা, গোলাপফুল, পাতা, সবুজ, কেক, গুলগুলা, ফুলকুচি, সেওই, ক্ষীরডুবি, খাস্তা, পেঁপের সন্দেশ, কড়ি, সি রিনচ, ঝিকমিক, পয়সা, সংসার, শিঙাড়া, বিবিখানা, চান্দ পাকোড়া, ঝালপোয়া, মালপোয়া, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি, সাজ, তেলপোয়া, ঝাল, বিস্কুট, খাস্তা, গজা, রুটি, দুধ পায়েস, কুলি, দুধকুলি, জামাই কুলি, জামদানি, হাঁড়ি, চাপড়ি, চুটকি, রসপুলি, কাটা, মুরালি, খান্দাশ, পয়সা, চুষি ইত্যাদি।
অঞ্চলভেদে এর নাম এবং উপকরণের ভিন্নতাও ছিল। এসব পিঠা কেবল শীতেই তৈরি করতে দেখা যায়। তবে এর কোনো কোনোটি কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখানে সীমিত পরিসরে প্রচলিত কিছু পিঠার উল্লেখ করা হলো :
গোকুল পিঠা
মধ্যযুগ থেকেই বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে বেশ প্রচলিত। চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড় ও কোরানো নারকেল সহযোগে বানানো পুর দিয়ে তৈরি হতো এই পিঠা। প্রধান উপকরণ ছিল এলাচি। পুরের সঙ্গে এই মসলার মিশ্রণ খুব ভালোভাবে মিশিয়ে নেওয়া হতো। পুর ঠান্ডা হলে তা চালের গুঁড়ার ডো বানিয়ে তার মধ্যে ভরে দেওয়ার নিয়ম। তারপর তেলে ভেজে রসে অথবা দুধে সারা রাত ভিজিয়ে রাখা হতো পিঠাটি।
সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা
উৎসবের আরেকটি খাদ্য কাটা সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা। সাতোশা এবং ঈদুল ফিতরে তৈরি করতে দেখা যায়। এ জন্য ২ কাপ চালের গুঁড়ার সঙ্গে ১/৪ কাপ ময়দার মিশ্রণে মন্ড তৈরি করতে হয়। তা বিশ ভাগে প্রতিটি লম্বা সরু লতার মতো করে তালুর কৌশলে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি অন্তর কাটার নিয়ম। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার শুধু চালের গুঁড়ার মন্ড দিয়েই পিঠাটি তৈরি হয়ে থাকে। এটি কাটার কৌশল সবাই রপ্ত করতে পারে না। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারাই সেমাই পিঠা তৈরিতে পারদর্শী হন। খেজুরের গুড়, দুধ ও নারকেল দিয়ে রান্না করা হয় এটি। গ্রামাঞ্চলে কড়া রোদে শুকিয়ে পিঠা বয়ামে তুলে সংরক্ষণও করার চল আছে।
চন্দ্রপুলি
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা। শহরেও অনেকে বানিয়ে থাকে। এই উপমহাদেশে, বিশেষত বাংলাদেশ ও ভারতে এই চন্দ্রপুলি খুব জনপ্রিয়। শুকনা কিংবা দুধ বা রসে ভেজানো- সবভাবেই এ পিঠা খেতে ভালো লাগে। চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠার কাইয়ের ভেতরে নারকেল, দুধ ও চিনি বা গুড়ের মিশ্রণের পুর থাকে। দেখতে অর্ধচন্দ্রাকৃতি, বানানো বেশ সময়সাপেক্ষ। ফলে জনপ্রিয়তা থাকলেও আজ এই পিঠা অনেকটাই অবহেলিত।
ক্ষীরমোহন
দুধ, ছানা, চিনির সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া এই পিঠা খেতে দারুণ মিষ্টি। সাধারণত বিয়ে, জন্মদিনের মতো উৎসবে অতিথি আপ্যায়নে ক্ষীরমোহনের বেশ কদর ছিল।
গোলাপ পিঠা
গোলাপ ফুলের মতো দেখতে। চালের গুঁড়া দিয়ে রুটি বানিয়ে কেটে কেটে তৈরি। পিঠা বানিয়ে তেলে ভেজে নিতে হয় প্রথমে। তারপর চিনির শিরার মধ্যে পিঠাটি কিছুক্ষণ চুবিয়ে পরিবেশন করার রীতি।
ম্যারা পিঠা
চেপা শুঁটকির ভর্তা আর ম্যারা পিঠা বৃহত্তর ময়মনসিংহের জনপ্রিয় খাবার। এই অঞ্চলে শীতের সকালে গোশতের ঝোলের সঙ্গে কুড়মুড়ে ম্যারা পিঠা খাওয়ার চল ছিল। একেক স্থানে একেকভাবে খাওয়া হয়। বানানো সহজ বলে নিয়মিতই এই পিঠা তৈরি করে। অনেক অঞ্চলে এটি মুঠি পিঠা নামেও পরিচিত।
জামদানি পিঠা
গাজীপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলে ঈদের অতিথি আপ্যায়নে এর কদর ছিল কয়েক বছর আগেও। রমজানের ১৫ দিন পার হলেই চালের গুঁড়া আর সিরিঞ্জ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত বাড়ির মেয়েরা। চালের গুঁড়ার কাই বানিয়ে সিরিঞ্জে ঢুকিয়ে কলাপাতার ওপর চলত নানান নকশা। কড়া রোদে কয়েক দিন শুকিয়ে তবেই তা ঘরে তোলার নিয়ম। মুচমুচে করে ভেজে তার ওপর চিনি ছিটিয়ে দেওয়া হতো।
মুগ পুলি
সকাল কিংবা বিকেলের নাশতায় রাখা হতো এই পিঠা। মুগ ডাল দিয়ে পুর তৈরি হওয়ার কারণে এতে আলাদা একটা ঘ্রাণ ছিল। চায়ের সঙ্গে গরম গরম মুগ পুলি খুব ভালো লাগত। ওপরে মুচমুচে, ভেতরে ডালের নরম পুর থাকার কারণে খেতে দারুণ। যেহেতু ঝাল পুর দিয়ে তৈরি, তাই স্বাদেও ভিন্নতা ছিল। যারা মিষ্টি পুলি পছন্দ করেন না, তাদের জন্যই এই পিঠা বানানো হতো।
আরও যেসব পিঠা মোগল আমল থেকে এই বাংলায় রাজত্ব করে যাচ্ছে, সেগুলো হলো পাটিসাপটা, গুজা, ডালরুটি, ছিট, ছানার মালপোয়া, দুধ পুলি। এ ছাড়া ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের অঞ্চল যেমন নবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য পিঠার মধ্যে মুখশল, চাপড়ি, গুলগুলা, খেজুর, ডিমের ঝাল পোয়া, ঝাল পাটিসাপটা, বিবিখানা, কলা, তিল পুলি, সাবুর, ম্যারা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি, ছিটরুটি ও জামাই পিঠা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, মাগুরা, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুরসহ সারা দেশেই পিঠা তৈরি হয়। সব অঞ্চলের পিঠাতেই স্থানীয় লোকঐতিহ্য আছে। নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের পিঠা হলো খোলাজা, ম্যাড়া, ডিমের বিস্কুট, নারকেল পুলি, গোলাপ, ডিমের পানতোয়া, ঝাল পানতোয়া, ঝুনঝুনি ও নারকেলের চিড়া। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হলো বিন্নি ভাত বা মধু ভাত। সেখানে কলা, নারকেল, বিন্নি চাল, চিনি দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে পিঠা তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এ পিঠার নাম আতিক্কা। আবার বিন্নি চালের গুঁড়ার সঙ্গে নারকেল, গুড় দিয়ে তৈরি হয় বিন্নি পুলি, যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত হাফাইন্না পিঠা বা গোইজ্জা পিঠা নামে। শরীয়তপুর বিখ্যাত বিবিখান পিঠার জন্য। জামালপুরের রোট পিঠা বা ওট পিঠা তৈরি হয় রান্না করা মাংস, চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, মরিচ- এসব মিশিয়ে। মাটির কলসিতে মিশ্রণটি ঢেলে চুলার আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় বিচিত্র পিঠাটি। সিলেটের গ্রামাঞ্চলে তৈরি হয় চুঙ্গাপুড়া পিঠা। বাঁশের মধ্যে কলাপাতা দিয়ে তার মধ্যে ভেজানো বিন্নি চাল (সিলেটি ভাষায় বিরন চাল) ভরে খড় দিয়ে মুখ আটকে চুলায় পোড়াতে হয়। সিলেটের আরেকটি জনপ্রিয় পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের একটি পরিচিত পিঠা হাত সেমাই। মেশিনে চালের গুঁড়ার মন্ড দিয়ে চিকন চিকন সেমাই কাটা হয়। তারপর ভাপে সেদ্ধ করে হাঁস ভুনা দিয়ে খাওয়া হতো। এমন বাহারি পিঠা আজ নেই বললেই চলে। অঞ্চলভিত্তিক পিঠার চলও ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top