এই শহর এই সময় I মুক্তির কল্পনা
আধিপত্য, শোষণ, উপনিবেশ, সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গ যেমন বারবার ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ঠিক তেমনই মানব ইতিহাসে মুক্তির আলাপ, স্বপ্ন ও দ্রোহ আয়োজন ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মানুষ ইতিহাস তৈরি করে যেমন, সে নিজেই হয়ে ওঠে ইতিহাস। কিন্তু মানব ইতিহাস ও ইতিহাসে মুক্তির আলাপ, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তির চিন্তা তথা দর্শন একমাত্রিক ও হোমোজেনিয়াস নয়, বরং তা বিচিত্র ও বহুরৈখিক এবং প্রবলভাবেই হেটারোজেনিয়াস। এই মানব ইতিহাসকে শুধু দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করার বদলে শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে বৈষম্য থেকে মুক্তি তথা সাম্যের সন্দর্ভ হাজির করেছিলেন কার্ল মার্ক্স। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ চলছে। এই উপলক্ষে সম্প্রতি ইউল্যাবে ‘লালন ও মার্ক্স-এর মুক্তির কল্পনা’ বিষয়ে ভাববৈঠকি ঢঙে আলাপ করলেন সংগীতশিল্পী, চিন্তক ও সমাজকর্মী অরূপ রাহী। আলাপের পাশাপাশি, নিজের বক্তব্যের ভাবকে গানের মধ্য দিয়েও পেশ করলেন।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) ইংরেজি ও মানবিক বিভাগ ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে কার্ল মার্ক্সের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ, লিটারেচার, কালচার অ্যান্ড পলিটিকস : মার্ক্স’ শীর্ষক কনফারেন্স আয়োজন করেছিল গত ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর। সেই কনফারেন্সের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই ভাববৈঠকি।
মার্ক্সের জন্মের দ্বিশতবর্ষে এই আলাপও জরুরি যে ইউরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতে বস্তুবাদের যে ধারণা, তা প্রাচ্যে অনেকাংশে পৃথক। তেমনই পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদনির্ভর সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ যেভাবে পুঁজির, পুঁজিকেন্দ্রিক জ্ঞান ও অর্থনৈতিক শ্রেণিনির্ভরতায় ইতিহাসের চিত্রের বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছে, পুঁজিবাদের সেই প্রজেক্টের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকভাবেই ভারতীয় সভ্যতা বা এই উপমহাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আলোকায়নের সমান্তরালে উপমহাদেশের নিজস্ব জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসর, সভ্যতার সমান্তরাল ধারণা এবং সেই অনুযায়ী মুক্তির ব্যাপারে চিন্তা, দর্শন ও আলাপ কিছুটা স্বতন্ত্র। কিন্তু পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদের সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে ও বিউপনিবেশায়নের আলাপে, পুঁজির বিরুদ্ধে দ্রোহ ও মুক্তির আলাপে মার্ক্সের বীক্ষণ আমাদের একান্তই প্রয়োজন। আর তার পাশাপাশি ইউরোপীয় আলোকায়নের সমান্তরালে উপমহাদেশে বা বিশেষত এই বাংলায় মানব মুক্তির যেসব আলাপ ও চর্চা চলেছে, সেই বিষয়ে দরকার নিবিড় পাঠ। এই নিবিড় পাঠে মার্ক্সের সঙ্গে লালন সাঁইকে হাজির করেছেন অরূপ রাহী। লালন সাঁই তথা বাংলার সাধু-ফকির-বাউলদের মারেফত-সহজিয়ার দর্শনে বস্তুবাদের স্বতন্ত্র ধারণা হাজির রয়েছে, এখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও তার চেতনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিনিবিড় বস্তুর ধারণা তৈরি হচ্ছে, যেখানে ‘আত্মা’ও বস্তু, পরম আত্মাও আসলে বস্তু। বস্তুর ভেতরেই ভাব…তার সঙ্গে সঙ্গে বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে এখানকার ফকির-সাধুরা যেভাবে চিন্তা-চেতনায়-ভাবান্দোলনের ভেতর দিয়ে লড়াই চালিয়েছেন, মার্ক্সের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে বাংলার এই সোশিও-পলিটিক্যাল তথা কালচারাল ও স্পিরিচুয়াল চিন্তা-চেতনাকে মেলাতে চেয়েছেন অরূপ রাহী। তাঁর আলাপে উঠে এলেন অ্যাঙ্গেলস, ফ্যানন, আলথুসার, গ্রামসির মতো দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। রাহীকে যন্ত্রানুষঙ্গে সহযোগিতা করলেন শরীফ সাধু এবং তাঁর দল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসের সূচনায় এই ভাববৈঠকি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এই মুক্তির আলাপ ও চর্চা চলছে যখন, তখনই আমাদের অদূরে চরম জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা। যারা সন্ত্রস্ত চেহারায় নাফ নদী পার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে এসে তাদের থাকতে হচ্ছে শরণার্থী শিবিরে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে তারা কেউ স্বামীহারা, কেউ সন্তানহারা, কারও স্ত্রীর রক্ত মিশে গেছে মিয়ানমারের মাটিতে। সন্ত্রাস আর উচ্ছেদের ভয়াবহ স্মৃতি তাদের আজও তাড়া করে বেড়ায়। উচ্ছেদ হওয়া এসব রোহিঙ্গার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এই উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জাতির শিশুসন্তানদের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউনিসেফ। নানাভাবে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের যৌথ উদ্যোগে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘জোডাস’ শিরোনামে একটি ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী, যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্বাস্তু যাপন, অভিশপ্ত শৈশব, জীবনসংগ্রাম ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ান ফটোজার্নালিস্ট প্যাট্রিক ব্রাউন তার লেন্সে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু যাপনের এসব ছবি তুলে ধরেছেন।
প্যাট্রিক ব্রাউন ফটোগ্রাফির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন। থ্রিডি ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড প্রেস অ্যাওয়ার্ড, পিকচার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড, নিউইয়র্ক ফটোগ্রাফি বুক অ্যাওয়ার্ডসহ ফটোগ্রাফির জন্য বহু বিখ্যাত পুরস্কার পেয়েছেন ব্রাউন।
অতনু সিংহ
ছবি: সংগ্রহ