ছুটিরঘণ্টা I সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ
দারুচিনি দ্বীপ সপরিবারে সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন ৭১ টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার পার্থ সন্জয়। সেই ভ্রমণমুগ্ধতার রেশ ছড়িয়েছে তাঁর অনবদ্য বয়ানে
বন্দরনায়েক বিমানবন্দরের রানওয়েতে যখন লঙ্কান এয়ারলাইনস ল্যান্ড করেছে, তখনো আকাশটা ঝকঝকে নীল। এর আগেই বিমানের জানালা থেকে দেখা হয়ে গেছে ভারত মহাসাগরের শান্ত ঢেউয়ের সৈকতে আছড়ে পড়া। এই হাতছানিতেই তো আসা কাঞ্চনময় দেশটিতে। যেখানে জীবনবাবুর নাবিক হারিয়েছেন দিশা। আর বনলতা চোখ তুলে দেখেছিল দারুচিনি দ্বীপ।
দেশটিতে পা রেখেই আমাদের গন্তব্য কলম্বো ছাড়িয়ে ১০৮ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি শহর, ক্যান্ডি। লঙ্কান এয়ারলাইনসের চটপটে বিমানবালার মতোই গ্রিন প্যারাডাইস ট্যুরের চিরাঙ্গা বীরাসুন্দারাও বন্দরনায়েক বিমানবন্দরে আমাদের অভিবাদন জানালো সিংহলিজ ভাষায় ‘আইয়ুবোয়ান’ বা ‘আপনি দীর্ঘজীবী হোন’ বলে।
চিরাঙ্গার গাড়িতেই আমরা ছুটলাম শ্রীলঙ্কার একসময়কার রাজধানী ক্যান্ডির দিকে। ঘণ্টা পেরোতেই নীল আকাশের রঙ কালো হতে শুরু করলো। ঝুম বৃষ্টিতে প্রায় চার ঘণ্টায় আমরা যখন পৌঁছালাম ক্যান্ডি শহর ছাড়িয়ে সাউথ ব্রিজেট কান্ট্রি বাংলোতে, তখন ঘড়িতে রাত আটটা। পাহাড়ের খাঁজে নিরিবিলি আশ্রয়। খুব বেশি অতিথি নেই। একটা ছমছমে পরিবেশ।
রাতের খাবাবের ব্যবস্থা করা হয়েছে বাংলোতেই। সেখানেই পরিচয় হলো অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলা জোয়ির সঙ্গে। তিনি কলম্বোতেই থাকেন। কাজ করেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কলম্বো শাখায়। উইকএন্ডে ক্যান্ডি এসেছেন শত বছরের পেরাডেনিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেনের দুষ্প্রাপ্য সব বৃক্ষ দেখতে। ক্যান্ডি এমনই। পর্যটকদের জন্য ঝাঁপি খুলে রেখেছে!
টেবিলে আমাদের জন্য পরিবেশিত সব খাবার নিরামিষ। নারকেল তেলে নয়, রান্না করা হয়েছে ভেজিটেবল অয়েলে। জোয়ির সঙ্গে জমে যাওয়া আড্ডায় শ্রীলঙ্কায় আমাদের প্রথম ডিনার।
এই শহরের নাম ক্যান্ডি দিয়েছে ব্রিটিশরা। স্থানীয় নাম মহানুয়ারা। অর্থ ‘বিগ সিটি’ বা বড় শহর। একসময়কার শ্রীলঙ্কার রাজধানী। রাজারানির শহর ক্যান্ডির বুক চিরে রয়েছে হ্রদ। ‘ক্যান্ডি লেক’। শহরে জলের চাহিদা মেটাতেই প্রাচীন রাজাদের তৈরি এই কৃত্রিম হ্রদ। পরদিন সকালে নাশতা সেরে এই হ্রদ ছুঁয়ে আমরা ছুটলাম ৮৫ কিলোমিটার দূরের শহর নুয়ারালিয়ায়।
নুয়া মানে শহর। আর এলিয়া অর্থ আলো। রামায়ণ বিশ্বাস অনুযায়ী, হনুমানের লেজের আগুনেই এই শহর জ্বলেছিল, তাই নুয়ারালিয়া। এই শহরেই ছড়িয়ে আছে লুকিয়ে রাখা সীতাকে আবিষ্কারের স্থানগুলো। ভক্ত হনুমান মন্দির তারই একটি। পাহাড়ের ওপর এই মন্দির। এখান থেকেই নাকি রাবণের ভাই বিভীষণের কাছ থেকে হনুমান জেনেছিলেন কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সীতাকে। নদী ছুঁয়ে অশোক বৃক্ষের নিচে সীতাকে দেখেছিলেন হনুমান এই পাহাড় থেকেই। আর সীতামাতা মন্দির সেই সীতাকে আটকে রাখার স্থান। এখানে রয়েছে হনুমানের বিশাল পায়ের ছাপ। ভক্তেরা সেই পায়ের ছাপে অঞ্জলি দেয় প্রতিদিন।
নুয়ারালিয়াতেই আছে সীতার অগ্নিপরীক্ষাস্থলও। বৌদ্ধ-অধ্যুষিত এই অঞ্চলে অগ্নিপরীক্ষাস্থলটি যেন ধ্বংস না হয়, তাই এর চারপাশে তৈরি করা হয়েছে বৌদ্ধমন্দির। সেই মন্দিরের মাঝেই সীতার অগ্নিপরীক্ষাস্থল। দর্শনীর বিনিময় প্রবেশ করতে হয়।
পাহাড়ি শহর নুয়ারালিয়ার বুক চিরে হ্রদ। সেই হ্রদে সি পে ইনের ওঠানামা। আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অনিন্দ্য স্থাপত্যের সব ঘরবাড়ি। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ২০০০ ফুট ওপরের এই শহর এখনো ধরে রেখেছে ব্রিটিশ স্থাপত্য ঐতিহ্য। শহরের পোস্ট অফিসটি সেই স্থাপত্যশৈলীরই পূর্বসূরি। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নুয়ারালিয়া শ্রীলঙ্কার অন্য শহরগুলো থেকে বেশ ঠান্ডা। দেশের শৈলাবাসও বলা হয় একে। আর আছে নয়ন জুড়ানো চায়ের বাগান। বিখ্যাত সিলন চায়ের উৎসভূমি ক্যান্ডি থেকে বিস্তৃত এই নুয়ারালিয়ায়। দিনভর নুয়ারালিয়ায় কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে আমরা পৌঁছালাম ক্যান্ডিতে।
ওলন্দাজ, ইংরেজ ও পর্তুগিজ উপনিবেশের সময়ে ক্যান্ডি ছিল শেষ স্বাধীন দুর্গ সিংহলি রাজাদের। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে এই শহর ইংরেজরা কৌশল করে দখল নেয়। পৃথিবীর সব বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর কাছে এই শহর বিশেষভাবে পূজিত। কারণ, এই শহরের ‘দালাগা মালিগাওয়া’ বা ‘টেম্পল অব দ্য টুথ’ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত আছে। এখানকার স্নানগৃহটি হ্রদের তীরে স্থাপিত। বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়ানো বৌদ্ধমন্দিরটি অনেক পুরোনো আর এখানকার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র। ভেতরে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, তবে মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা মানা। সার্ক দেশগুলোর পর্যটকদের জন্য প্রতি টিকিটের মূল্য এক হাজার সিংহলিজ রুপি। মন্দিরের বাইরে যত চান ছবি তুলতে পারবেন। এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
টেম্পল দিনে এক রকম সুন্দর আর রাতে আরেক রকম। রাত হলে এখানে হাজারো মোমবাতি জ্বালানো হয়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেই দৃশ্য দেখতেই দিনভর ক্লান্তি মুছে আমরা গেলাম মন্দিরে। তখন পূজার সময়। মন্ডপের দরোজা বন্ধ। ভক্তের দীর্ঘ লাইন। একসময় পূজা শেষ হলে লাইন ধরে আমরাও পৌঁছাই যেখানে সংরক্ষিত আছে বুদ্ধের দাঁত, সেই মন্ডপের সামনে। দেখা মেলেনি। কারণ, বুদ্ধের দাঁত বিশেষ দিনগুলোতেই দর্শনার্থীদের দেখানো হয়। তবে রাতের মঙ্গল আলোর সৌন্দর্য মেখেছি আমরা। জ্বেলেছি মোমবাতি। সাদা ধবধবে টুথ টেম্পল তখন মোমের আলোয় অপার্থিব!
পরদিন সকালে ঘুরে দেখলাম ক্যান্ডি শহর। এমন একটা স্থান নেই যেখানে সৌন্দর্যের এতটুকু ভাটা পড়েছে। আগেই বলেছি, শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজন্যবর্গের সর্বশেষ রাজধানী এই শহরটা। একসময়ের দাপ্তরিক নাম ছিল সেনকান্ডাগালা শ্রীবর্ধনা মহা নুয়ারা। ঔপনিবেশিক শাসনামলে পর্তুগিজদের ক্যানডিয়া ইংরেজদের হাতে পড়ে সংক্ষেপিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত ক্যান্ডিতে এসে ঠেকেছে। শহরের ভিউ পয়েন্ট থেকেই শেষবার আমরা দেখলাম অপরূপ ক্যান্ডি। তারপর ছুট।
আমাদের এবারের গন্তব্য বেনটোটা। তবে তার আগে নির্মল এক আনন্দ উপহার পেলাম পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজে। ক্যান্ডি ছাড়িয়ে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মাওয়া নদীর তীর ঘেঁষে পিন্নাওয়ালা। পাহাড় আর পাহাড়ি নদী মাওয়া, যার উৎপত্তিস্থল রাসাওয়া পাহাড় (এই পাহাড়েই নাকি রাবণের সৈন্যদের জন্য তলোয়ার তৈরি হতো)। সেই নদী ঘেঁষেই এতিম হাতির আবাসস্থল পিন্নাওয়ালা।
রাস্তার একধারে এতিম ৮৬টি হাতির বাস। রাস্তা পার হয়ে হাতিগুলো দিনে দুবার এই মাওয়া নদীতে স্নান করতে আসে। আর তা দেখতেই রাজ্যের দর্শনার্থী। চাইলে নিজ হাতে খাইয়েও দেওয়া যায় হাতিদের। আমার আট বছরের মেয়ে ধ্রুপদি দাস রঙ আর ষাটোর্ধ্ব মা, দুজনেই বেশ আনন্দ নিয়ে দেখেছেন হাতির স্নান।
অরফানেজে ঢুকতে টিকিটের দাম পড়বে বিদেশিদের জন্য ১০০০ রুপি আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর পর্যটকদের জন্য ৭৫০ রুপি করে।
বেনটোটায় পৌঁছালাম রাতে। নদীর নামে শহর। এবারের হোটেলটা নদী ঘেঁষে। রাতে খুব একটা বুঝতে না পারলেও সকালে তিনতলার রুমের বারান্দায় দাঁড়াতেই যেন নদীর পানিতে মুখ ভাসলো। বেশ শান্ত নদী, বেনটোটা। প্রায় মোহনার কাছাকাছি আমাদের হোটেল আমবার। বোটে করে সকালটা ঘোরা হলো নদীতেই। মোহনা বলেই বেনটোটার শাখানদীর লোনা জলে কুমিরের অভয়ারণ্য। সেই অরণ্য ঘুরলাম আমরা দারুণ রোমাঞ্চ নিয়ে। আর দেখলাম ভারত মহাসাগর কেমন করে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েছে বেনটোটার জল।
বেনটোটা থেকে গল। ইবনে বতুতার গল। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিখ্যাত অ্যাডামস পিক হয়ে দিনাওয়ার শহর থেকে গলে এসেছিলেন তিনি। ইবনে বতুতা লিখেছেন, এরপর সেখান থেকে আঠারো মাইল দূরের ছোট শহর কালি হয়ে কালানবু (বর্তমানের কলম্বো) গেলাম। এই কালিই গল। ইবনে বতুতার কথা গলবাসী গর্বের সঙ্গে মনে করেন। ষোড়শ শতকে এই শহরে আসেন পর্তুগিজরা। লোরেঞ্জো ডি আলমেইডার নেতৃত্বে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে এক পর্তুগিজ জাহাজ ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য গলে নোঙর করে। তারপর ৮২ বছর ছিল পর্তুগিজদের আনাগোনা। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহলি রাজাদের কাছ থেকে শহরটি দখল নেওয়ার পর শুরু হয় গল দুর্গ নির্মাণ। ওলন্দাজরা শহরটি দখল করে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে; ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের দখলে আসার আগে ১৫০ বছর ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রায় তিন শতাব্দী আগে ওলন্দাজরা ৯০ একরের আয়তন ঘিরে সুবিশাল গল দুর্গ তৈরি করে, যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে সবাইকে স্বাগত জানায়। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে টিকে থাকা বিখ্যাত গল দুর্গ ইউনেসকোর চোখ এড়িয়ে যায়নি। ১৯৮৮ সালে একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গল দুর্গের আয়তন প্রায় ৩৬ একর, যার চারপাশ দিয়ে দুর্গপ্রাচীরের প্রশস্ত বাঁধ, প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষার জন্য কালজয়ী কেল্লা। এ রকম তিনটি র্যামপার্ট করতে সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়েছে অকাতরে। এই মহাযজ্ঞে শ্রম দেওয়ার জন্য ওলন্দাজরা নিয়ে এসেছিল ইন্দোনেশিয়া ও মোজাম্বিক থেকে শ্রমিক। ৪০০ বছর পেরিয়ে আজও মনে হয় নতুনের মতো। দুর্গপ্রাচীরের উপরে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেই দৃষ্টিগোচর হয় মহাসমুদ্রের উচ্ছ্বাস আর মহাকাশের বিশালত্ব। সুবিশাল দুর্গের মাঝে হেঁটে বা গাড়িতে ঘোরাফেরা করা যায়। সবখানেই যেন অতীত কথা কয়। দুর্গের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে গল দুর্গের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ গল বাতিঘর। লৌহনির্মিত গোলাকৃতি এই টাওয়ার সুবিন্যস্তভাবে ওপরে উঠে গেছে একেবারে ২৬.৫ মিটার পর্যন্ত। প্রতি ১৫ সেকেন্ডে দুটি শুভ্র আলোর ঝলকানিতে এখনো সে জীবন্ত। তবে প্রাচীন বাতিঘরটি ওলন্দাজরা নির্মাণ করেছিল ১৮৪৮ সালে, যা ১৯৩৬ সালে আগুনে পুড়ে যায়।
গল ফোর্ট ছুঁয়েই গল স্টেডিয়াম। স্বপ্নের এক ক্রিকেট ভেন্যু। শহরজুড়ে ট্যুরিস্ট আর ট্যুরিস্ট। বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান আর রাশান। ভারত মহাসাগরের সৈকতের হাতছানিতে ভরেছে এই পর্যটকদের মন। উল্টো পিঠে আছে বেদনাও।
এই সৈকতেই ২০০৪-এ আছড়ে পড়েছিল প্রলয়ংকরী সুনামি। ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ৩৫ হাজারের বেশি প্রাণ। যাদের মধ্যে বড় সংখ্যায় ছিল পর্যটক। ‘সুনামি হনগাঞ্জী বিহারে’র ১৮.৫ মিটার লম্বা বৌদ্ধমূর্তি সেই সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতাকে মনে করেই তৈরি।
আমাদের শেষ গন্তব্য কলম্বো। সকাল থেকে দুপুর চষে বেড়ালাম শহর কলম্বো। ওয়াটার টেম্পল, পন্নাবালামেস্মরণ মন্দির, ইনডিপেনডেন্ট স্কয়ার আর আর্ট স্ট্রিটÑ এক লহমায় দেখা শেষ। দুপুরের পর শপিং শেষে হোটেল ক্ল্যারিয়নেই রাতের ডিনার। সকালে ফ্লাইট। ভোরের আলো ফুটতেই হোটেল ছাড়লাম। বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে সাদা শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের ময়ূরকণ্ঠী পোশাকের বিমানবালা আবারও আমাদের অভিবাদন জানালো। বললো ‘আইয়ুবোয়ান’!
ছবি: লেখক