ফিচার I ক্যালেন্ডার
তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান যুগে ছবিশোভিত সেই ক্যালেন্ডার অপস্রিয়মাণ। কিন্তু এর অতীত বড়ই ঐশ্বর্যময়
ক্যালেন্ডার কেবল সময়গণনার সুযোগ করে দেয় না, কালের বহমানতার সংস্কৃতিকেও চিনিয়ে দেয়। তাই এটি বৈচিত্র্যময়। কিন্তু ডিজিটাল যুগে ক্যালেন্ডারের সেই বৈচিত্র্যের রূপ-রঙ-আকার এখন অনেকটাই গায়েব। ইভেন্টনির্ভর কিছু ক্যালেন্ডার অবশ্য আজও রয়ে গেছে।
সময়ের ধারাকে আমরা নদীর সঙ্গে তুলনা করি। ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জির পাতা পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা টের পাই সময়ের বয়ে যাওয়া। তবে এখন আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় পরিবর্তন এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান যুগে দেয়ালে কিংবা পড়ার টেবিলে ক্যালেন্ডারের চল অনেকটাই কমে গেছে। বরং মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, আইপ্যাডসহ ডিজিটাল গ্যাজেটগুলোয় ক্যালেন্ডার এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। যদিও বিভিন্ন ইভেন্টনির্ভর ক্যালেন্ডার আজও রয়েছে। যেমন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ক্যালেন্ডার, আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার ক্যালেন্ডার, ফ্যাশন উইক ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। কিন্তু ক্যালেন্ডার বলতেই নেচার ফটোগ্রাফি, ধর্মীয় ও পৌরাণিক দৃশ্য। সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার উপস্থাপনা ইত্যাদি মুদ্রিত দেয়ালের দিনপঞ্জি অথবা টেবিলের মাসলিপির স্মৃতি আজও অম্লান অনেকের কাছে। এ ছাড়া তারিখ, বার, ছুটির দিন সমন্বিত ডেট ক্যালেন্ডারও উল্লেখযোগ্য। তবে দিনপঞ্জিকার বা বর্ষপঞ্জির গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী একেকটি সংস্কৃতির ক্যালেন্ডারে বিশেষ কিছু চিহ্ন, রঙ ও লিপি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যেমন সৌরগণনার শকাব্দ বর্ষপঞ্জি, চান্দ্রগণনার হিজরি বর্ষপঞ্জি আর সৌর ও চান্দ্রগণনার মেলবন্ধনে বঙ্গাব্দ সন গণনার বর্ষপঞ্জির মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। সাদৃশ্যও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ক্যালেন্ডার হলো পাশ্চাত্যের গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি। খ্রিস্টাব্দ রীতির এই বর্ষপঞ্জিকে বিশ্ব পরিমন্ডলে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির এক আদেশানুসারে ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই বর্ষপঞ্জির প্রচলন ঘটে বলে জানা যায়। যদিও প্রথম দিকে হাতে গোনা কিছু রোমান ক্যাথলিক এই বর্ষপঞ্জিকে গ্রহণ করেছিল। পরে বিভিন্ন দেশ তা গ্রহণ করে। এর আগে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি ছিল জনপ্রিয়। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে জুলিয়াস সিজার এর প্রবর্তন করেন। রোমান বর্ষপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে এই ক্যালেন্ডার প্রণীত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ অব্দে তা কার্যকর হয়। রোমান সাম্রাজ্য ও ইউরোপের বিপুল অংশে একটি উদীয়মান ক্যালেন্ডার ছিল। ১৫৮২ সালে এর সংস্কারের মাধ্যমে তখনকার পোপ গ্রেগরি থার্টিন গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন করেন। জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিকাতেও বছরের হিসাব ৩৬৫ দিনে এবং মাসের সংখ্যা ছিল ১২। এতেও প্রতি ৪ বছর পর ফেব্রুয়ারি মাস অধিবর্ষ বা লিপ-ইয়ার হতো। ৩৬৫.২৫ দিনে এক বছর এই ক্যালেন্ডারে। উল্লেখ্য, জুলিয়ান ও গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির গণনা সৌর পদ্ধতিতেই হয়ে থাকে।
ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বর্ষপঞ্জি হলো শকাব্দ। বঙ্গাব্দ প্রচলনের প্রায় ৫১৫ বছর আগে আর খ্রিস্টাব্দ প্রচলনের ৭৮ বছর পরে এই বর্ষগণনা বা দিনপঞ্জিকার রীতি প্রচলিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন ভারতীয় রাজা শালীবাহনের প্রয়াণ দিবস থেকেই শকাব্দের সূচনা। রাজা শালীবাহনের রাজত্বকালে একবার বহিরাগত শকেরা তার রাজ্যে আক্রমণ করে। কিন্তু শালীবাহনের প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণে শক বাহিনী পরাজিত হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ‘শকারি’ উপাধি। তখন থেকে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিষয়ক গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্তের’ সৌরবর্ষ গণনার নিয়ম বা রবিসংক্রান্তি অনুসারে শকাব্দের গণনা শুরু হয়। সৌরগণনার হিসাবে আবর্তিত আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য বর্ষপঞ্জি হলো শ্যামদেশীয় বা সৌর বুদ্ধাব্দ, পারসিক বা ইরানি বর্ষপঞ্জি এবং বাইজেন্টেনীয় বর্ষপঞ্জি।
চান্দ্রগণনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বর্ষপঞ্জি হলো ‘হিজরি’। এটি মূলত ইসলামি ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করেন। কুরায়েশদের অত্যাচারে মক্কা থেকে নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় চলে গিয়েছিলেন। নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করার ক্ষেত্রে নবীজির এই ঘটনাকে ইসলামে ‘হিজরত’ বলা হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনা গমন বা হিজরতের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই হিজরি সাল গণনার সূচনা হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৭ হিজরি অর্থাৎ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর সাত বছর পর চান্দ্রগণনার নীতি অনুসরণ করে চান্দ্রমাসের হিসাবে এই পঞ্জিকা প্রবর্তন করা হয়। এ ছাড়া চান্দ্রগণনায় আরও একটি বর্ষপঞ্জি হলো বুদ্ধাব্দ বা বুদ্ধনির্বাণাব্দ। শাক্যমুনি বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ দিবস থেকে এই অব্দের সূচনা। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫৪৩ বছর আগে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশীনগরে বুদ্ধের নির্বাণপ্রাপ্তি হয় বলে কথিত। ওই দিন থেকে ১ বুদ্ধাব্দের সূচনা। প্রতিবছর চান্দ্র বৈশাখ মাসের বুদ্ধপূর্ণিমা থেকে এই বর্ষপঞ্জি শুরু হয়। তবে চান্দ্রাব্দ অনুসরণ করলেও এর গণনাপদ্ধতি সৌরসিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর ফলে চান্দ্রাব্দ হওয়ার পরেও এই বর্ষপঞ্জি ঋতুচক্রের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া চায়ান বা চীনা বর্ষপঞ্জি, কোরীয় বর্ষপঞ্জি, নেপাল সংবৎ, বিক্রম সংবৎ, মায়া পঞ্জিকা, গুপ্তাব্দ, মঘী, বিক্রমাব্দ, ত্রিপুরান্দের মতো কিছু প্রাচীন বর্ষপঞ্জিও চান্দ্রাব্দনির্ভর। আর বঙ্গাব্দের ব্যাপারে আমরা জানি, আকবরের আমলে ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ শিরাজী চান্দ্র হিজরি ও সৌরগণনার মেলবন্ধনে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেছিলেন।
ইংরেজদের ব্যবহৃত গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে দিন ও মাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা ক্যালেন্ডারে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঋতু ও তিথি। সৌরসিদ্ধান্তের ঋতুচক্র আর চান্দ্রগণনার তিথি- এই দুই-ই বাংলা দিনগণনা বা বর্ষগণনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সবক্ষেত্রেই মুদ্রিত ক্যালেন্ডার অপরিহার্য, যাতে ঋতুচক্র থেকে তিথি কিংবা মাস ও ছুটির দিন নির্দেশিত থাকে।
বর্ষপঞ্জির মুদ্রণে সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক প্রেক্ষিত ইত্যাদি ফুটে ওঠে ইমেজের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ক্যালেন্ডারেরও তাই এক রকম উদ্দেশ্য থাকে। এটি যখন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন বা জনসংযোগের মাধ্যম, তখন এরও থাকে নির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্স। ইমেজের ব্যবহৃত হয় তা সামনে রেখেই। ফলে, ধার্মিকদের জন্য যে ছবি ব্যবহার করা হয়, বিনোদনমুখীদের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। তবে ক্যালেন্ডারের ডিজিটাল মাধ্যমে এই বৈচিত্র্য কার্যকর নয়। সেখানে কেবল গ্রেগরীয় রীতির কালচেতনার কাটখোট্টা প্রকাশ চোখে পড়ে। রূপ-রঙ-রসের অনুপস্থিতি সেখানে পরিলক্ষিত।
অতনু সিংহ
ছবি: সংগ্রহ