এডিটরস কলাম I চিত্ত হোক উদ্বেগহীন
প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষের মহত্ত্ব নষ্ট করে। অধিকন্তু, কোনো কোনো কাজের স্বীকৃতি কিংবা ফল সঙ্গে সঙ্গে আসে না। শান্ত চিত্তে এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই যে আমাদের জীবনে বিচিত্র অস্থিরতা, তার প্রধান একটি কারণ অপেক্ষা করতে না পারা
প্রাত্যহিক জীবনে আমরা কত কাজই না করি। তারপরও কিছু বাকি থেকে যায়। যারা আফসোস করে বলেন, এ জীবনে কিছুই করা হলো নাÑ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, তাদের কৃতিত্বও উপেক্ষণীয় নয় মোটেই। হয়তো যা বাকি রয়ে গেছে, তা-ই বড় হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অসীম, তাই অতৃপ্তিরও সীমা নেই। এর দরকার আছে, নইলে মানবজাতি এত দূর এগোতে পারতো না। কিন্তু প্রাত্যহিক ও জরুরি কাজগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে টেনশন দেখা যায়। ঠিকমতো হচ্ছে বা হবে কি না- এমন দুশ্চিন্তা রয়ে যায়। একে জয় করতে না পারলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কীভাবে এই উদ্বেগ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব? একটা খুব জুতসই উত্তর হলো, মন শান্ত রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়া। কাজের ধ্যানই আসল কথা। এটা আমাদের জীবনকে কেবল সহজ, সফল ও সুখী করে না, রক্ষা করে জগতের নানা পঙ্কিলতা, তুচ্ছতা আর যন্ত্রণা থেকে। যে ব্যক্তি তার কর্মধ্যানে অবিচল, কোনো অপ্রাপ্তি বা শূন্যতা তাকে গ্রাস করে না। তবে কেউ যদি প্রতিদানের আশায় কাজ করেন, তার মধ্যে একটা উদ্বেগ বা চাপ তৈরি হবেই। এটা এড়াতে পারা জরুরি। ভালো কাজের সুফল আসবেই। কিন্তু প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা মানুষের মহত্ত্ব নষ্ট করে। অধিকন্তু, কোনো কোনো কাজের স্বীকৃতি কিংবা ফল সঙ্গে সঙ্গে আসে না। শান্ত চিত্তে এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই যে আমাদের জীবনে বিচিত্র অস্থিরতা, তার প্রধান একটি কারণ অপেক্ষা করতে না পারা। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে জার্মান সাহিত্যিক হেরমান হেসের উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’র কথা। গুরুর আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে সিদ্ধার্থ ‘অরূপের সন্ধানে’ বেরিয়ে পড়লেন, দিনের পর দিন নৌকায় যাপনের পর এক ঘাটে এসে দেখলেন এক রূপসীকে। তাকে অনুসরণের এক পর্যায়ে সেই নারী (নাম: কমলা) সিদ্ধার্থকে প্রশ্ন করেন, ‘কী পারো তুমি?’ তিনি জবাব দিলেন- ‘আমি ধ্যান করতে পারি, উপবাস আর অপেক্ষা করতে পারি।’
সিদ্ধার্থের এই কথা খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় আমার কাছে। ধ্যানের অর্থ এখানে নিবিষ্ট সাধনা, উপবাস শব্দটিকে অভিধানের প্রচলিত অর্থে না নিয়ে বলা যায়, এর মধ্যে রয়েছে লোভহীনতা ও সংযম। আর অপেক্ষায় নিহিত ধৈর্য ও আত্মপরীক্ষার মর্ম। এসবই জরুরি জীবন-চলার পথে, সবার জন্য। অস্থিরতা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা দরকার সবারই- ধ্যানী, শান্ত, সংযত মন নিয়ে। জীবন সুন্দর, যদি এতে প্রশান্তি বজায় রাখা যায় আর তা সম্ভব হলেই পৃথিবী নামের এই গ্রহটিকেও আমরা নতুন করে সাজিয়ে তুলতে পারি। অশান্ত মন নিয়ে পৃথিবী কেন, আপনজন এমনকি নিজের জন্যও কিছু করা সম্ভব নয়। চিত্ত উদ্বেগমুক্ত হলে এর প্রভাব জীবনের সব ক্ষেত্রে পড়ে। বেঁচে থাকার সৌন্দর্য তখন চেষ্টাহীনভাবে উপভোগ করা যায়।