সেলুলয়েড I বিসর্জন
কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
প্রযোজনা: অপেরা
অভিনয়ে: জয়া আহসান, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায়, লামা, কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ
সিনেমাটোগ্রাফি: সৌভিক বসু
সম্পাদনা: শুভজিত সিংহ
সংগীত: কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত
দৈর্ঘ্য: ১২৯ মিনিট
মুক্তি: ২০১৭
মুক্তির পরেই ছবিটি কলকাতার চলচ্চিত্র মহল থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকের মধ্যে আলোড়ন তোলে। বহুদিন পর কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা চলচ্চিত্রজগৎ এমন একটি ছবিকে হাতের নাগালে পেয়েছিল, যাতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বঙ্গদেশের পূর্ব-পশ্চিমের সীমানা ভুলে একাত্ম হয়েছিল বহমান ইতিহাসচেতনার সঙ্গে। আমরা ঢাকায় বসে বড় পর্দায় এই ছবি যখন দেখি, তখন তা কলকাতার ছবি মনে হয় না। মনে হয়, পূর্ব বাংলার মানুষের মায়া, প্রেম ও যৌথযাপনের যে অন্তর্চেতনা, তার নিগূঢ়ে বসেই ছবিটি বানানো হয়েছে। তবে এর ন্যারেটিভ খুব সাধারণ।
বাংলাদেশেই ইছামতীর পাড়ে শ্বশুরের গৃহে বাস করে বাঙালি হিন্দু বিধবা পদ্মা। দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীর দিন কোনোভাবে বাংলাদেশে ইছামতী নদীর পাড়ে আটকে পড়ে দুর্ঘটনায় আহত পশ্চিমবঙ্গের ছেলে নাসির আলি। তাকে আহতাবস্থায় কাদায় পড়ে থাকতে দেখে নিজের বাসায় নিয়ে আসে পদ্মা। অতিথি হিসেবে ঠাঁই দেয়। তার সেবা-শুশ্রূষা শুরু করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেলেঙ্কারির অবস্থা হবে- এটা আঁচ করে নাসিরকে নিজের জ্যাঠাতো ভাই বানানো হয়। তার নাম হয় সুভাষ। এদিকে পদ্মাদের গ্রামেই থাকে মৎস্য ব্যবসায়ী গণেশ মন্ডল। পদ্মার প্রেমে সে পাগল। তার দেখভাল করে সে। যদিও তাকে বিশেষ পছন্দ নয় পদ্মার। কারণ, তার বাসায় ঠাঁই নেওয়া যুবকের ওপর তার মায়া পড়ে গেছে। কখন যেন সে তাকে নিজের মন দিয়ে ফেলেছে। এভাবে গল্প এগোয়। একদিন পদ্মার শ্বশুর মারা যায়। পদ্মাকে ছেড়ে নদীর ওপারে চলে যেতে হয় নাসির আলিকে। পদ্মাকেও আত্মসমর্পণ করতে হয় গণেশ মন্ডলের কাছে। বিয়ের শর্ত হিসেবে নাসির আলিকে ওপারে তার নিজের বাড়িতে নিরাপদে পাঠানোর ব্যাপারে গণেশ মন্ডলের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি সে আদায় করে নেয়। ওপারে নাসির আলিকে ফিরে যেতে হয়। তার আগে সেও পদ্মার মায়া ও প্রেমের কাছে ধরা দেয়।
ছবির এই সাধারণ ন্যারেটিভের মধ্যেই বাংলাদেশের গ্রামীণ ও মফস্বলের জনজীবনের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি এবং একাত্মতা- এসবকে ডিটেইলে তুলে ধরতে পেরেছেন কৌশিক গাঙ্গুলী। বিত্তশালী গণেশ মন্ডলের সঙ্গেও পড়শি মুসলমানদের যেমন সুসম্পর্ক, নিম্নমধ্যবিত্ত পদ্মা ও তার শ্বশুরের সঙ্গেও তেমনটাই। আবার একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু নাসির আলি সংখ্যালঘু হলেও সেখানকার সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, তা-ও বোঝা যায়। এই ছবির তিনটি মূল চরিত্রের মধ্যে পদ্মা (জয়া আহসান) ও নাসির আলি (আবির চট্টোপাধ্যায়) দুই বাংলার দুই সংখ্যালঘু। উভয়ের আচরণের মধ্য দিয়ে প্রেম, মানবিকতা, শিকড়ের প্রতি মমত্ব- সবই এ ছবিতে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এই ছবির সম্পদ জয়া আহসান আর পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলীর অভিনয়। জীবনসংগ্রাম, প্রেম, কামের অবদমন ও প্রকাশ, মানবিকতা- এসব উপাদানে পদ্মা নদীর মতোই গভীর এবং ব্যাপ্ত। যদিও ভারতের রাজনৈতিক পাকেচক্রে পদ্মা নদী তার গভীরতা হারাচ্ছে, যেভাবে বিধবা হতে হয়েছে পদ্মাকে। ছবিতে সে প্রসঙ্গও আছে। চরিত্রের সেই অর্থ ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন জয়া। অন্যদিকে বিত্তবান গণেশ মন্ডলের চরিত্রটি আপাত-ধূর্ত হলেও ভেতরে ভেতরে অগাধ প্রেমের বাহন হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গেও তার সদ্ভাব। কিন্তু কখনো কখনো টাকার জোর আর স্থানীয় ক্ষমতাকে সে কাজে লাগায় তার প্রেমের বাস্তবায়নের জন্য। এত কিছুর পরেও সে পদ্মার জন্য ঝুঁকি নিয়ে নাসির আলিকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাতে সাহায্য করে। গণেশ মন্ডল চরিত্রটি যেমন রঙিন, তেমনই তার ভূমিকায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় দুর্দান্ত। নাসির আলি চরিত্রটি কম আকর্ষণীয় হলেও শেষ দৃশ্যে এসে জয়ার অভিনয়ের সঙ্গে কিছুটা ভারসাম্য তাতে আনতে পেরেছেন আবির।
এই ছবির আরেকটি সম্পদ প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সংগীত আয়োজন। তিনি নিজেও গেয়েছেন। গাইয়েছেন নচিকেতাকে দিয়েও। বাংলার লোকঐতিহ্য, নদীর পাড়ের গল্প- এই ছবিতে কালিকাপ্রসাদের গানের বদৌলতে অম্লান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ, মফস্বল জীবন, গ্রামীণ নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের ঘরদুয়ার, পাড়াগাঁ, দোকান- এ সবকিছুকে জীবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে শিল্পনির্দেশক গৌতম বসুর অবদান অনস্বীকার্য। সাদা কাপড়ের বিধবা জয়া থেকে শুরু করে ছবির শেষ দৃশ্যে রঙিন ছাপা শাড়িতে লাস্যময়ী পদ্মা এবং গণেশ মন্ডলের ব্যাচেলর ও প্রাক্-বিবাহ মুহূর্তে পোশাকের বদল, বসিরহাটের ছেলে নাসির আলির শরীরে পদ্মার মৃত স্বামীর শার্ট- সব মিলিয়ে পোশাক পরিকল্পনা যথার্থ। সঙ্গে রূপসজ্জা। আর ইছামতী নদী, খুলনার গ্রাম, বাজার, পদ্মার বাসার ইনডোরে আলো-আঁধারি আবহে সিনেমাটোগ্রাফি বাস্তব ও বিশ্বস্ত।
অতনু সিংহ
কুইজ
১। এই ছবির সংগীত আয়োজন কোন প্রয়াত শিল্পীর?
ক। আইয়ুব বাচ্চু খ। কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য গ। মান্না দে
২। ছবিতে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কোন চরিত্রে অভিনয় করেছেন?
ক। পদ্মার স্বামী খ। নাসির আলি গ। গণেশ মন্ডল
৩। কলকাতায় ছবিটি কত সালে মুক্তি পেয়েছিল?
ক। ২০১৭ খ। ২০১৮ গ। ২০১৬
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. ফারিয়া খান, বাড্ডা, ঢাকা।
২. সুলতানা পারভীন, ধানমন্ডি, ঢাকা।
৩. অর্পিতা সেন, কুমারপাড়া, সিলেট।