ট্রাভেলগ ২ I ভাষা নিয়ে ভাসা-ভাসা স্মৃতি
ভাষার সঙ্গে রয়েছে জীবনধারার সম্পর্ক। যাপনচিত্রের ভিন্নতার কারণেই জাতিতে-জাতিতে ভাষার পার্থক্য। লিখেছেন সৌভিক দাস
ভাসমান জীবনের অংশ হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দেশ মোজাম্বিকে যেদিন পৌঁছলাম, সেদিনই বন্ধুত্ব হয়ে গেল সেই দেশের যুবক পিভির সঙ্গে। শুরু হলো আফ্রিকার সংস্কৃতির সঙ্গে সত্যিকারের পরিচয়।
দূরের কোনো দেশে মিটিং থাকলে আমি সাধারণত দু-তিন দিন আগেই সেখানে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করি। মিটিং শেষ করার পরেও নিজের খরচে থেকে যাই কয়েক দিন। মোজাম্বিকের মাপুতো শহরের সমুদ্রের পাড়ে যে হোটেলে উঠলাম, সেটা সেখানকার অভিজাতদের বেশ পছন্দের বলে মনে হলো। স্নান-টান সেরে নিচে এসে দেখি, সমুদ্রের পাড়ে ঘাস বিছানো সৈকতে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে যুবক-যুবতী পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি বলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো আফ্রিকান বাজনা আর নৃত্য। ভেন্যুর এক কোণে দুজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক মহা উল্লাসে মোজাম্বিকের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ‘টিম্বিলা’ বাজিয়ে চলেছে। যন্ত্রটি বেশ অদ্ভুত। অনেকগুলো কাঠের পাটাতন ছোট থেকে বড় আকার অনুসারে বসানো। তাতে একটা কাঠি দিয়ে টোকা দিলে অদ্ভুত বন্য একটা সুর বেরিয়ে আসে। একই যন্ত্রে তাল ও সুর- দুটোই বাজানো যায়। রাত গড়িয়ে যখন সুরাপাত্রের তলানিতে গিয়ে ঠেকল, সবার তখন নাচের নেশায় ঘোর লেগেছে। আমিও কখন সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বাঁশিটি বের করে দুই যুবকের টিম্বিলার সঙ্গে যোগ দিয়েছি মনে নেই। সাঁওতালি বাঁশির মহুয়া মাখানো সুর টিম্বিলার উদ্দাম তালের সঙ্গে মিশে গেছে অনায়াসে!
নাচ থামলে পিভি তাকায় আমার দিকে। ধ্যান থেকে জেগে ওঠার পরে যোগীরা যেভাবে তাকান। আমার বাঁশিটা দেখিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইল, এটা কোথাকার সুর? হাত জোড় করে সম্ভাষণ জানিয়ে বলি, আমি বাংলাদেশের ছেলে। এই সুর শিখেছি আমার দেশের এক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কাছে। ওর কৌতূহল বাড়ে। জানতে চায় এমন সুর আরও আছে তোমার কাছে?
বলি, এক পৃথিবী।
এই পুরো কথোপকথনের ভাষার নাম আমার জানা নেই। কারণ, আমরা পরস্পরের ভাষা জানি না। হাত-টাত নেড়ে কীভাবে যেন আলাপ শুরু হয়ে গেল।
মোজাম্বিক একসময় পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল। মোজাম্বিকের অনেকেই তাই তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীর ভাষার পাশাপাশি পর্তুগিজ ভাষাটাও জানে। আমাদেরকে যেমন ইংরেজি শিখতে হয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে পড়ে। কিন্তু আমি তো পর্তুগিজের প-ও জানি না। তারপরেও কীভাবে জানি যোগাযোগ হয়ে গেল। এর আগেও দেখেছি, মিউজিশিয়ানদের মধ্যে কীভাবে যেন একটা যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। সেই হিসাবে সংগীত মহাজাগতিক ভাষার স্বীকৃতি পেতেই পারে। অন্য গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বৈজ্ঞানিকেরা গণিতের সঙ্গে সংগীতকেও একটি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভেবে দেখতে পারেন।
যা হোক, সে তার টিম্বিলা গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করে,
– যাবে নাকি আমাদের গ্রামে? নাচ হবে!
– আমি তো ভাবলাম, নাচ শেষ হয়ে গেল।
– আরে, এ তো শুধু শহুরে আনুষ্ঠানিকতাটুকু শেষ হলো। বর এখন কনেকে তাদের গ্রামে নিয়ে যাবে, সেখানেই তো হবে আসল নাচ।
– আমি কিন্তু কিচ্ছু চিনি না। নাচ শেষে হোটেলে ফিরবো কী করে?
– সে তুমি ভেবো না! আমি থাকতে তোমার কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি এই গ্রামের প্রধান পুলিশ! গুন্ডাদেরও গুন্ডা!
এই বলে সহাস্যে হাতের মাসল ফুলিয়ে দেখালো। আমরা তিন যুবক একসঙ্গে হা হা করে হেসে উঠলাম।
একটা জিপে অনেকজন মিলে ঠাসাঠাসি করে ঘণ্টা দুয়েকের মেঠো পথ আর আকাশভরা তারা পেরিয়ে ওদের গ্রামে যখন পৌঁছালাম, মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। গ্রামে ঢোকার অনেক আগে থেকেই দূর থেকে আগুন ঘিরে অনেক মানুষের ভিড় আবছাভাবে বোঝা যাচ্ছিল। জিপটা যত এগোতে থাকলো, আফ্রিকান ড্রামের ডিডিম ডিডিম তালটা স্পষ্ট হতে থাকলো। বর-কনের গাড়ি কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছে গেছে নিশ্চয়ই; আর সেই সঙ্গেই শুরু হয়েছে নাচ। এবার বাজনার সঙ্গে ওদের নিজস্ব ভাষা আর আদিম সুরে গানও যুক্ত হয়েছে। সেই ভাষার এক বর্ণও আমার জানা নেই। কিন্তু বরের দুষ্টুমি ভরা অধর আর কনের লাজুক আনত নয়ন দেখে বেশ বোঝা যায়, সেই গানে নতুন কনের প্রতি নিবেদিত হচ্ছে বরের প্রেম। বর-কনের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় এসে নাচ দেখিয়ে যাচ্ছে আশপাশের গ্রাম থেকে আসা অতিথিরা। শিশু কিশোর যুবক যুবতী প্রৌঢ়- সবাই সেই নাচে এসে যোগ দিতে থাকলো। একসঙ্গে প্রায় একডজন ড্রাম আর আর টিম্বিলার সমবেত সংগীত যখন তুঙ্গে, তখন গ্রামের সকল মানুষ এক ছন্দে, এক লয়ে নেচে চলেছে। হঠাৎ করে এই দৃশ্যের সঙ্গে অনেকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ধ্যান করার দৃশ্যের যেন একটা মিল খুঁজে পেলাম। আপাতদৃষ্টিতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পর্বতসম মৌন মহান স্নিগ্ধতার সঙ্গে আফ্রিকান এই সমবেত উদ্দাম নৃত্যের কোনো সংগতি নেই। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই দুটো চর্চাই তো মেডিটেশনের দুটো ভিন্ন রূপ মাত্র। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে কখন ঘুম নেমে এলো। সব উদ্বেগ মুছে নিয়ে গেল ভিনদেশি জোনাকিরা।
ঘুম যখন ভাঙলো, ভোরের ঠান্ডা হাওয়া তখন সবাইকে একে একে ডেকে তুলছে। দেখলাম, আমার মতো আরও অনেকেই নাচ শেষে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বর-কনের আসন খালি। স্বাভাবিক। তারা নিশ্চয়ই মাঠে ঘুমোনোর জন্য বিয়ে করেনি। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে দেখি ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও কাছাকাছি এলে বুঝতে পারলাম, তিনি আমার বন্ধু পিভি। গতকালের মিউজিশিয়ান পিভির এ এক অন্য রূপ। কাছাকাছি এসে আমাকে মাটি থেকে উঠে বসতে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। পাঞ্জাবির ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বেশ চনমনে একটা খিদে পেয়েছে। গত বিকেল থেকে সলিড কিছু তো প্রায় খাইনি। মাথাটা যদিও এখনো বেশ ভারী হয়ে আছে। চোখে-মুখে জল দিয়ে গাছের নিচে একটা বেঞ্চিতে বসে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা ব্রেকফাস্ট কয়টায় করো? ও ঠিক বুঝতে পারলো না। আমি ভাবলাম, ব্রেকফাস্ট ইংরেজি শব্দ বলে হয়তো ওর বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। তাই ভেঙে ভেঙে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। ‘সকালবেলায় ঘুম থেকে প্রথম যে খাবারটা খাওয়া হয় সেটা ব্রেকফাস্ট; দুপুরের খাবার যেমন লাঞ্চ, রাতের খাবার ডিনার।’
শুনে পিভি বললো, হুম্, ইন্টারেস্টিং। আমার ট্রাইবের ভাষায় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের কোনো সমার্থক শব্দ নেই। আমার দেশের বেশির ভাগ গ্রামে এ রকম প্রতিবেলা খাওয়ার বিলাসিতা ছিল না। তাই আমাদের ভাষাতেও বিভিন্ন বেলার খাবারের নাম নেই। এখনো প্রতিদিন কোনো নির্দিষ্ট সময়ে আমরা খাই না। তোমার খিদে পেয়ে থাকলে চলো, ওদিকটায় কিছু আমগাছ আছে।
ওর কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে থাকলাম। এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, সব ভাষায় সব শব্দ যে থাকতেই হবে এমনটি ধরে নেওয়া ভুল। মানুষ তো মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কিছু ধ্বনি পরপর সাজিয়ে একটা শব্দ তৈরি করে, তার ওপর একটা অর্থ আরোপ করে দেয়। অন্য কোনো ভাষা দিয়ে সেটাকে অনুবাদ করে কাজ চালানোর চেষ্টা করা যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু সত্যিকারের মনের ভাবটা প্রকাশ হয় না। আমাদের ভাষার অনেক শব্দ বা ধারণা যেমন আফ্রিকার ভাষায় নেই, ঠিক তেমনি ওদের ভাষাতেও এমন অনেক শব্দ রয়েছে, যা আমাদের ভাষাতে নেই। যেমন আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ দিকটাতে ‘উবন্তু’ বলে একটা শব্দ রয়েছে, যার সমার্থক শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। তিন সিলেবলের এই ছোট্ট শব্দের অর্থ অনেক গভীর। এটা দিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর মানবিক গুণাবলির সমন্বয়কে বোঝায়। এই শব্দটির অর্থ হলো, ‘আর সবার অস্তিত্ব আছে বলেই আমার অস্তিত্ব আছে।’
আফ্রিকার ভাষাবিষয়ক এই অভিজ্ঞতা হওয়ার পর থেকে আমি যে দেশেই গিয়েছি, মনের অজান্তেই সেই দেশের ভাষার সঙ্গে আমার দেশের ভাষা মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি। নইলে নিজের ভাষার ঐশ্বর্য উপলব্ধি করবো কী করে? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষালাভের জন্য গিয়েছিলাম, তখন লেখাপড়ার চেয়ে গানবাজনা হতো বেশি। প্রায় দিনই বিকেলবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা টেমস নদীতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বন্ধুদের কয়েকজন। ওই ছোট্ট নৌকাতেও কোনোমতে ঠাঁই পেয়ে যেত একটা গিটার। একদিন বব ডিলানের গাওয়া
‘Don’t think twice; it’s alright !’
গানটা গাইছি নৌকায় বসে। গানটার মাঝামাঝি আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা আছে যেখানে ডিলান গাইছেন,
‘I ain’t saying you treated me unkind.
You could have done better; but I don’t mind.
You just wasted my precious time;
But don’t think twice, it’s alright.’
এটা শুনে আমার সঙ্গে পড়তে আসা একজন মেম সাহেব বললেন, বব ডিলান কেমন কপট ছিলেন দেখেছ? তিনি যে পুরো ব্যাপারটায় বেশ ক্রোধান্বিত, তা তাঁর গানের কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু আবার পরের লাইনে গাইছেন, ‘চিন্তা কোরো না, আমি কিছু মনে করিনি।‘ হিপোক্রেট কোথাকার! আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, ক্রোধ কোথায়? এটা তো স্পষ্ট অভিমান! তারপর ইংরেজিতে বোঝাতে গিয়ে উপলব্ধি হলো, এই অভিমানের ব্যাপারটা আমি সেই ভাষায় বোঝাতে পারবো না। কারণ, অভিমানের কোনো ইংরেজি অনুবাদ হয় না। ইংরেজরা হয় রাগ করে নয়তো দুঃখ পায়। কিন্তু কেউ এসে রাগ ভাঙাবে সে আশা নিয়ে রাগ করা এবং সেই আশা পূরণ না হলে দুঃখ পাওয়া কিন্তু সেই দুঃখকে স্বীকার না করার যে অনুভূতি, যাকে আমরা এককথায় অভিমান বলি, সেই ধারণাটাই ওদের ভাষায় অনুপস্থিত। অথচ বাংলায় শ্রী রাধিকার মানভঞ্জন নিয়ে তো গীতিকারের একটা বিশাল অংশ রচনা করে ফেললেন বৈষ্ণব কবিরা।
প্রশ্ন হলো, ইংরেজিতে অভিমানের সমার্থক শব্দ নেই বলে কি অভিমানের অনুভূতিটাও তাদের নেই? না-ই যদি থাকে, তাহলে বব ডিলান এই গানটা লিখলেন কী করে? বব ডিলান অবশ্য ইংরেজ নন। আমেরিকার ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া অসামান্য প্রতিভাবান একজন কবি ও গায়ক, যাকে ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর ভাষার যথাযথ শব্দ থাকুক বা না থাকুক, অভিমানসহ আর সকল মানবিক অনুভূতি যে তাঁর ভেতরে প্রবাহিত হয়েছে, তাতে আর আশ্চর্য কী।
ভাষাবিষয়ক আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল ফ্রান্সের এক গ্রামে।
একটু লক্ষ করলে দেখবেন, আমাদের বাংলা ভাষায় যেমন, মুরগির মাংসকে আমরা মুরগির মাংস, গরুর মাংসকে গরুর মাংস কিংবা পাঁঠার মাংসকে পাঁঠার মাংসই বলি; ইংরেজিতে কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম নয়। ওরা গরুর মাংসকে বলে বিফ, পাঁঠার মাংসকে বলে মাটন আর শূকরের মাংসকে বলে পোর্ক। অর্থাৎ, খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত কোনো প্রাণীর মাংসের জন্য আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়। এই পার্থক্যের কারণটা আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম ফ্রান্সের এক বৃদ্ধ দম্পতির খামারে গিয়ে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তিনি তাঁর ভেড়াগুলোর কথা বলার সময় ‘মোওটন’ বলে একটা শব্দ উচ্চারণ করছেন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ফরাসি ভাষায় ভেড়া ও শূকরের সমার্থক শব্দ যথাক্রমে ‘মোওটন’ ও ‘পোর্ক’।
প্রশ্নটা হলো, ফরাসি ভাষার শব্দগুলো ইংরেজি ভাষার অংশ হয়ে উঠলো কী করে? এর উত্তর পাওয়া গেল এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা ঘেঁটে। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে, একাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বংশোদ্ভূত নরম্যান সাম্রাজ্য তৎকালীন অ্যাংলো-স্যাক্সনদের পরাজিত করে ব্রিটেনের জনপদ দখল করে এবং পরাজিত জনগোষ্ঠীর ওপর শোষণ-নিপীড়ন চালায়। বহু বছরের শাসনে-শোষণে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সঙ্গে ফরাসি বংশোদ্ভূত নরম্যান শাসকদের একটা বিশাল সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি হয়। সেই ব্যবধানের প্রতিফলন তাদের ভাষাতেও চলে আসে। ব্রিটিশ পূর্বপুরুষদের খামারে পালিত ‘শিপ’ বা ভেড়া ফ্রেঞ্চ পূর্বপুরুষের ডিনার টেবিলে এসে হয়ে যায় মাটন। ফরাসি রন্ধনশিল্পের প্রভাবেই হোক অথবা রাজচর্চার প্রভাবেই হোক, বিভিন্ন প্রাণীর মাংসের পরিচয়জ্ঞাপক এই শব্দগুলো ইংরেজি ভাষায় স্থান করে নেয়।
পৃথিবী নামক এই গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে এই একটা উপলব্ধি হয়েছে। আজকে আমরা মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষাকে যে অবস্থায় দেখছি, তা সব সময় একরকম ছিল না। প্রতিটি সংস্কৃতি ও ভাষাই পরস্পরকে পুষ্টি জুগিয়ে চলেছে অবিরাম, সেই সঙ্গে বিবর্তিত আর বিকশিত হয়েছে নিজেরাও; মাটির গভীরে বৃক্ষ যেমন তাদের শিকড় দিয়ে যোগাযোগ রাখে অরণ্যের অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে।
লেখক: জাতিসংঘের কর্মকর্তা; নেশা পরিব্রাজন।
Email: showvikbd@gmail.com
ছবি: লেখক