বিশেষ ফিচার I ফিলাটেলিক শহীদ মিনার
অহংকারের একুশ নানাভাবে স্মৃত। ফিলাটেলিক ব্যুরো অব বাংলাদেশও ডাকটিকিট, বিশেষ খাম আর সিলমোহরে ধরে রেখেছে বিশেষ এই দিনটিকে। ডাক বিভাগের এই উদ্যোগ নিয়ে ইতিহাসের সরণি ধরে হেঁটেছেন উদয় শংকর বিশ্বাস
চিঠি পাঠাতে ডাকমাশুল হিসেবে খামের গায়ে মূল্য লেখা কাগজের যে লেবেল থাকে, সাধারণত তা-ই ডাকটিকিট। ব্যবহারের পর সাধারণের কাছে এর বিশেষ কোনো মূল্য থাকে না। তবে, যারা ডাকটিকিট সংগ্রহ করেন তাদের কথা ভিন্ন। সংগ্রাহকদের কাছে এটি শুধু কাগজের লেবেল নয়, তার থেকে বেশি কিছু। বিশ্বব্যাপী ডাকটিকিট সংগ্রহ মজার শখ হিসেবে বিবেচিত। অনেকেই একে ‘শখের রাজা’ও বলেন। ব্রিটিশ শিক্ষক ও সমাজসংস্কারক স্যার রোল্যান্ড হিল (১৭৯৫-১৮৭৯) কে ডাকটিকিটের জনক বলে মনে করা হয়। ব্রিটেনের ডাক বিভাগ ১৮৪০ সালের ৬ মে বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিট অর্থাৎ ‘পেনিব্ল্যাক’ প্রকাশের মাধ্যমে ডাকব্যবস্থায় যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দেয়। ভারতবর্ষে সিন্ধুপ্রদেশের ব্রিটিশ কমিশনার বার্টল ফ্রেয়ার ১৮৫২ সালে ‘সিন্ডে ডাক’ নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিলেন। যার মাধ্যমে এই অঞ্চলে ডাকব্যবস্থায় নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। শুধু ভারতবর্ষের নয়, এশিয়ারও প্রথম ডাকটিকিট হিসেবে একে মনে করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই। লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি শিল্পী বিমান মল্লিকের নকশা করা ৮টি টিকিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের ডাক বিভাগ তার পথচলা শুরু করে। সেই থেকে এ দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহেরও শুরু। বিচিত্র বিষয়ে পাঁচ শতাধিক ডাকটিকিট বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বিভিন্ন সময় বের করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিট উদ্বোধনী খাম, সিলসহ বিভিন্ন পোস্টাল স্টেশনারি। এসব প্রকাশের মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে শহীদ মিনার নতুনভাবে পরিচিত হয়েছে।
ডাকটিকিটে প্রথম শহীদ মিনার
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বিষয় ছিল শহীদ মিনার। ৩৯.১ মিমি বাই ২৯ মিমি আকারের টিকিটটিতে লাল প্যানেলের মধ্যে বাংলায় ‘শহীদ স্মরণে’ কথাটি লেখা হয়। শহীদ মিনারের চারপাশ গাঢ় সবুজে আচ্ছাদিত টিকিটের বাম দিকে ‘২১শে ফেব্রুয়ারী’ এবং ডান দিকে ‘ভাষা আন্দোলন’ কথাটি সাদা হরফে লেখা রয়েছে। আর নিচের দিকে আছে বাংলাদেশ; উভয় পাশে টিকিটটির মূল্যমান ২০ পয়সা ইংরেজি ও বাংলায় মুদ্রিত। দেশের নাম বাংলায় আর কখনো লেখা হয়নি, এটি ব্যতিক্রম ঘটনা। ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিক সিকিউরিটি প্রিটিং প্রেস থেকে মোট ১০ লাখ ডাকটিকিট ছাপিয়ে আনা হয়। শুধু ডাকটিকিট নয়, মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি বিশেষ সিলমোহর, উদ্বোধনী খাম ও অমর একুশের তাৎপর্য নিয়ে একটি ডেটা কার্ডও প্রকাশ করে। প্রকাশিত সিলমোহরে ‘ডাক টিকিট সংগ্রহ সংস্থা’ কথাটি লেখা রয়েছে।
ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ
বাংলাদেশের ডাকটিকিটে শহীদ মিনার আবারও দেখা যায় ১৯৮৭ সালে। ভাষা আন্দোলনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। যার প্রতিটির মূল্য ছিল ৩ টাকা। এর একটিতে দেখা যায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিলরত যুবাদের, যাদের একজন মিছিলের সামনে গুলিবিদ্ধ। আর অপর টিকিটে আছে পুষ্পশোভিত শহীদ মিনার। নকশাকার বাকিরুদ্দিন সরকার অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনকে ফুটিয়ে তুলেছেন টিকিট দুটির নকশায়। রাশিয়ার মেজদোনারোধ নায়া নিগা প্রিন্টার থেকে তা ছাপানো হয়। এ উপলক্ষে একটি উদ্বোধনী খাম, সিলমোহর ও ফোল্ডার প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে ফোল্ডার প্রকাশের ঘটনা সেটাই প্রথম।
ভিন্নভাবে উপস্থাপিত শহীদ মিনার
ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনারকে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ প্রকাশিত ডাকটিকিটে এরপর দেখা যায় ১৯৯৩ সালে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বা চতুর্দশ শতাব্দী পূর্তিতে ১৯৯৩ সালের ১৪ এপ্রিল ২ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক টিকিট প্রকাশিত হয়। সেখানে বাংলার শৌর্য-বীর্যের প্রতীক বেঙ্গল টাইগার, একতারা হাতে বাউল, ধান কেটে বাড়ি ফেরা কৃষক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক লেখাসংবলিত নূর হোসেন, জাতীয় স্মৃতিসৌধের ইমেজের সঙ্গে শহীদ মিনারকেও দেখা যায়। নান্দনিক এই টিকিটটির ডিজাইন করেন নকশাকার মো. শামসুজ্জোহা। বহু রঙবিশিষ্ট অফসেট কাগজে মুদ্রিত টিকিটটি ছাপানো হয় বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। একই সঙ্গে উদ্বোধনী খাম ও বিশেষ সিলমোহর প্রকাশিত হয়। তবে শহীদ মিনারের উপস্থিতি তাতে নেই।
ভাষাশহীদ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাঁদেরকে নিয়ে তেমন কোনো ডাকটিকিট হয়নি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় ভাষাশহীদদের নিয়ে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষাশহীদ শফিউর রহমান (১৯১৭-১৯৫২), আবদুর জব্বার (১৯১৯-১৯৫২), রফিক উদ্দিন আহমদ (১৯২৬-১৯৫২) ও আবুল বরকত (১৯২৭-১৯৫২) এই চারজনকে নিয়ে চারটি টিকিট প্রকাশ করা হয়। প্রতিটি টিকিটের আকার এক অর্থাৎ ৪৪ মিমি বাই ৩২ মিমি। আনোয়ার হোসেন, মো. মতিউর রহমান ও মুছলিম মিয়া টিকিটগুলোর নকশা করেন। উদ্বোধনী খামেও দেখা মেলে শহীদ মিনারের। দুহাতের মধ্যে বিশ্বমানচিত্র অর্থাৎ গ্লোব ধরে রাখা আছে; এর উপরে শহীদ মিনার এবং সবার উপরে শান্তির প্রতীক সাদা রঙের পাখির ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ কথাটি বিশেষ সিলমোহরে ব্যবহৃত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর
২০০২ সালে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপিত হয়। দিনটি স্মরণে ১০ টাকা মূল্যমানের তিনটি স্মারক ডাকটিকিট এবং ৫০ টাকা মূল্যমানের একটি স্যুভেনির শিট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। এর মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথভাবে পালন করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ৯ পৌষ ১৪০৮ বঙ্গাব্দ বা ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০২ খ্রিস্টাব্দ। প্রকাশিত টিকিট তিনটির মাঝেরটিতে রয়েছে শহীদ মিনার। চিরচেনা শহীদ বেদিতে ‘অমর একুশে’ কথাটি লেখা রয়েছে। অন্য টিকিট দুটির একটিতে বাংলা হরফ এবং অন্যটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অক্ষর আছে; এর নকশাকার আনোয়ার হোসেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য বোঝাতে বাংলা ও অন্যান্য ভাষার হরফ ব্যবহার করেছেন। বহু রঙবিশিষ্ট টিকিট তিনটির আকার অভিন্ন; ৩২ মিমি বাই ৪৪ মিমি। অন্যদিকে স্যুভেনির শিটের নকশা করেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২-২০১৪)। ৫০ সংখ্যার শূন্যের মধ্যে তিনি শহীদ মিনারের রেখা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। উদ্বোধনী খামও তাঁরই করা। সেই সঙ্গে খামটিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ অথবা ‘মোদের গরব মোদের আশা’, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’- এমন সব স্লোগান রয়েছে। সবই ঢাকার তেজগাঁওয়ের পোস্টাল প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত।
ভিন্নরূপে শহীদ মিনার
সাত বছর পর আবারও শহীদ মিনার বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রকাশনায় এসেছে। তবে, একটু ভিন্নভাবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০০৯ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনির শিটে (আকার ১৮০ মিমি বাই ১২০ মিমি) ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের সাতটি আলোকচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ আন্দোলনকারীদের থামিয়ে দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের সামনে সারিবদ্ধ দন্ডায়মান পুলিশ বাহিনী, একই তারিখে সচিবালয়মুখী ছাত্র-জনতার দাবি আদায়ের মিছিলে বাধা দেওয়ার জন্য কার্জন হলের সম্মুখে পুলিশ বাহিনীর ব্যারিকেড, ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সংগ্রামী ছাত্রীদের শোভাযাত্রা, ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিনের কপালে গুলি লেগে মাথার খুলিসহ প্রায় সম্পূর্ণ মগজ ছড়িয়ে পড়ার ছবি, ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মোনাজাত ও শোভাযাত্রা এবং সবশেষ ছবিতে দেখা যায় একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরাতন কলাভবনের প্রাঙ্গণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। স্যুভেনির শিটটিতে ছিদ্রযুক্ত একটি টিকিট আছে। যা ১৯৭২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটের প্রতিলিপি। টিকিটটির আকার ৪২ মিমি বাই ৩২ মিমি। এ উপলক্ষে একটি বিশেষ ফোল্ডার প্রকাশ করা হয়। ফোল্ডারটিতে ফুলে-ফুলে ছাওয়া শহীদ মিনারকে দেখা যায়। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০০৯’ কথাটি এর উপরে মুদ্রিত। প্রকাশিত সিলমোহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সরাসরি এসেছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৫ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকিট, ৫ টাকা মূল্যমানের একটি উদ্বোধনী খাম ও ডেটা কার্ড এবং বিশেষ সিলমোহর প্রকাশ করে। প্রকাশিত ডাকটিকিটে এক পাশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ছবি রয়েছে এবং অপর পাশে ম্যুরালের মধ্যে শহীদ মিনারের ইমেজ আছে। টিকিটটির আকার ৮০ মিমি বাই ৩০ মিমি এবং ছিদ্রে দূরত্ব ১২.৫। নকশাবিদ হলেন জসিম উদ্দিন। সবকিছু গাজীপুরের দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাং) লি. থেকে মুদ্রিত। এ প্রকাশনায় শহীদ মিনারকে ভিন্নভাবে দেখা যায়।
বেশি মূল্যের ডাকটিকিট
২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ আবারও স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনের উপরে প্রকাশিত টিকিটের মধ্যে এটির দাম সর্বোচ্চ, ২১ টাকা। সম্ভবত ২১ ফেব্রুয়ারিকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে এমন মূল্যমানের টিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। এ রকম মূল্যমানের আর কোনো টিকিট পরেও প্রকাশিত হয়নি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ টিকিটের মূল্য ১০ টাকার মধ্যে। ডাক বিভাগ ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি টিকিটটি অবমুক্ত করে। এ উপলক্ষে একটি উদ্বোধনী খাম, ডেটা কার্ড ও সিলমোহর প্রকাশ করে বরাবরের মতো। নকশা করেন বিশিষ্ট নকশাকার আনোয়ার হোসাইন। বহু বর্ণবিশিষ্ট টিকিটটিতে তিনি ভাষা আন্দোলনের গর্বের স্মারক শহীদ মিনারকে ব্যবহার করেছেন ডান পাশে আর বাঁ পাশে গ্লোবের ইমেজে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের পতাকাকে। উদ্বোধনী খামে বাংলা একাডেমিতে স্থাপিত রফিক-শফিউর-বরকত-জব্বার-সালামের আবক্ষ মূর্তির সঙ্গে শহীদ মিনারের ছবিকে দেখিয়েছেন। সিলমোহরে শহীদ মিনারের সঙ্গে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ কথাটি এত সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন যে, একঝলকে যে কেউ বুঝে নিতে পারবে ভাষা আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য। গাজীপুরের বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিটিং প্রেস থেকে এর সবকিছু ছাপানো হয়।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মুক্তধারা প্রকাশনার মাধ্যমে যে বইমেলার শুরু, তা-ই ১৯৮৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে পরিচিতি পায়। এটি বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৫ ও ১০ টাকা মূল্যমানের দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়, যার একটিতে আছে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ এবং অপরটিতে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র (১৮৮৫-১৯৬৯) প্রতিকৃতি। গাডারে আছে ভাষাসৈনিক সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-শফিউরের ভাস্কর্য। বইমেলা নিয়ে এটিই প্রথম প্রকাশিত ডাকটিকিট। ৫০ টাকা মূল্যমানের স্যুভেনির শিটেও একই ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্বোধনী খামে ফুল দিয়ে লেখা ২১ এবং শহীদ মিনারের ছবি আছে। এ উপলক্ষে দুটি পোস্ট মার্ক বা বিশেষ সিল প্রকাশ করা হয়। যার একটি ক্যাম্প পোস্টমার্ক যা বইমেলার দিনগুলোতে বাংলা একাডেমিতে ব্যবহার করা হয় এবং অপরটি আয়তনে খানিকটা বড়। এটি ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম জিপিও থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়। ডেটাকার্ডে ডাকটিকিট প্রকাশের প্রেক্ষাপট বর্ণিত। স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খামের নকশা করেন আনোয়ার হোসেন এবং বিশেষ সিলমোহরের নকশায় ছিলেন সন্জীব কান্তি দাস।
বিশেষ খাম
উদ্বোধনী খাম ছাড়াও ১৯৭৭ সালে ভাষা আন্দোলনের রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ প্রকাশ করে একটি বিশেষ খাম। এটি বাংলাদেশের প্রথম বিশেষ খাম। এর আগে ১৯৭৩ সালে বিশ্ব ডাক সংস্থার সদস্যপদ লাভ এবং ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় জাতীয় স্কাউট সমাবেশে দুটি বিশেষ খাম প্রকাশিত হয়; কিন্তু ভুলবশত তাতে ‘উদ্বোধনী খাম’ কথাটি লেখা হয়। এর ফলে তা আর বিশেষ খাম হয়ে ওঠেনি। ভাষা আন্দোলনের ২৫তম বর্ষে প্রকাশিত খামটিই প্রথম বিশেষ খামের মর্যাদা লাভ করে। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘এসো বই পড়ি’ শিরোনামে আর একটি বিশেষ খাম প্রকাশিত হয়। এটিকে সরাসরি একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সম্পর্কিত বলা যায়। প্রকাশিত বিশেষ সিলমোহরে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭’ কথাটি আছে। তারিখ ও স্থানের উল্লেখ নেই। এ রকম অদ্ভুত সিলমোহর আর কখনো ব্যবহৃত হয়নি।
পোস্টকার্ডে প্রথম শহীদ মিনার
পোস্টকার্ডে শহীদ মিনারকে প্রথম দেখা যায় ১৯৯১ সালে। এক টাকা মূল্যমানের পোস্টকার্ডটিতে শহীদ মিনারের চিরচেনা ইমেজকে ব্যবহার করা হয়েছে। ডাক বিভাগ শহীদ মিনারকে লাল রঙে প্রকাশ করেছে। এরপর আরও বেশ কয়েকবার পোস্টকার্ডে শহীদ মিনারের উপস্থিতি দেখা গেছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ অমর একুশে তথা শহীদ মিনারকে ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম, বিশেষ খাম, সিলমোহর, স্যুভেনির শিট ইত্যাদির মাধ্যমে যথাযথভাবে স্মরণ করে চলেছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাকটিকিট সংগ্রাহক
ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে