সাইডস্টোরি I বিজ্ঞাপন ও সাইবার-দুনিয়া
বিজ্ঞাপনের ভাষা নতুন এক রূপ নিয়েছে ডিজিটাল গণমাধ্যমে। বিচিত্রমুখী চ্যালেঞ্জ এর সঙ্গী
মূলত নব্বই দশকের সূচনা থেকেই বদলে গেছে বিশ্ব-অর্থনীতির হালহকিকত। এখন অর্থনীতি সাইবার-দুনিয়ানির্ভর। আর তাই কমিউনিকেশন বা জ্ঞাপনের চরিত্রেও বদল এসেছে। বিশেষত গণজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। নোয়াম চমস্কি জানাচ্ছেন, এই মাস কমিউনিকেশন বা গণজ্ঞাপনের মূল স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতির রূপায়ণে ঘটনাক্রম তথা তথ্যের রূপদান ও তার অভিমুখ নির্ধারণ করে। তো এই গণজ্ঞাপনেরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বিজ্ঞাপন। এটি পণ্য ও পরিষেবার সঙ্গে ক্রেতা ও ভোক্তার সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার কলা বা আর্ট ও কৌশল। তাতে বিশেষভাবে জ্ঞাপিত হয় পণ্য ও পরিষেবা সম্পর্কিত তথ্যরাশি। যেহেতু অর্থনীতি ও তার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণী কৌশল গণমাধ্যম সাইবারকেন্দ্রিক, তাই অবধারিতভাবে বিজ্ঞাপনের অন্তর্জগৎ ও তার ভাষা প্রকরণেও ঢুকে পড়েছে সাইবার ল্যাঙ্গুয়েজ।
সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, হোর্ডিং, বিলবোর্ড, ইভেন্ট স্পনসরের মতো বাহ্যত ও সম্প্রচারযোগ্য গণমাধ্যমভিত্তিক বিজ্ঞাপন তো বটেই, ওয়েবসাইট, ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি ডিজিটাল মাধ্যমে পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপন সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এবং এই ডিজিটাল মাধ্যমে বিজ্ঞাপন পরিবেশিত হওয়ার ফলে তার ভাষার মধ্যে এসেছে নতুনত্ব। ওয়েব দুনিয়ার ভাষার সঙ্গে বিজ্ঞাপনী যোগাযোগের ভাষা সম্পৃক্ত হয়েছে।
বিজ্ঞাপনের ভাষার উপাদান বলতে বোঝায় পণ্য ও পরিষেবার তথ্য, তা উপস্থাপনের কলাকৌশল ও আঙ্গিক। হোর্ডিং, বিলবোর্ড কিংবা সংবাদপত্রে একটি ফ্রেম এবং পণ্য বা পরিষেবার কনটেন্ট, ইমেজ, কম্পোজিশন, ক্যাপশন, ট্যাগলাইনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ভাষা নির্ণীত হয়। টেলিভিশন ও ফিল্মের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে জরুরি বিষয় হয়ে পড়ে পণ্য বা পরিষেবা-সংক্রান্ত তথ্যের নন-ফিকশনাল অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রতিবেদন। কিংবা ফিকশন তৈরির পণ্য বা পরিষেবার তথ্যসমৃদ্ধ স্ক্রিপ্টসহ অডিও, ভিজ্যুয়াল, মিউজিক, ক্যাপশন ও ট্যাগলাইন বা ক্যাচলাইন। বিজ্ঞাপনের অডিও-ভিজ্যুয়ালের ল্যাঙ্গুয়েজকে পূর্ণতা দেয় এই উপাদানগুলো। রেডিওর বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ভিজ্যুয়াল বাদ দিয়ে বাকি বিষয়গুলো প্রয়োজন। ইমেজ ও একটিমাত্র ভিজ্যুয়াল ফ্রেমকে সামনে রেখে প্রিন্ট মিডিয়ার বিজ্ঞাপনী ভাষা তৈরি হলেও, রেডিওতে শব্দ ও ধ্বনিপ্রবাহ এবং টেলিভিশন ও ফিল্মে দৃশ্য-শ্রাব্যের মেলবন্ধনে বিজ্ঞাপনের ভাষার নিজস্বতা পরিবর্তিত হয়। সাইবার-দুনিয়ার বিজ্ঞাপনের ভাষা আরও বহুমাত্রিক। কেননা, এখানে সময়ের উপযোগিতার ব্যাপারটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে পণ্য বা পরিষেবার বার্তা ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে। এ ছাড়া ওয়েব মাধ্যমে স্থির ইমেজ, চলমান দৃশ্য-শ্রাব্যমালা এবং শব্দ ও ধ্বনিব্যঞ্জনা কখনো আলাদা করে, কখনো একই সঙ্গে উপস্থাপিত হয়ে বহুমাত্রিক ও জটিলভাবে বিজ্ঞাপনের ভাষা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ওয়েবসাইট ও ব্লগের বিজ্ঞাপনের থেকেও সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের চ্যালেঞ্জ আরও জটিল। কেননা, এই মাধ্যমে ক্রেতা বা ভোক্তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওয়েবপেজ বা ব্লগের চেয়ে অনেক দ্রুত হারে একটি স্পেস থেকে আরেকটি স্পেসে নিজের দৃষ্টি-অবস্থান পরিবর্তন করেন। ফলত তার কাছে দ্রুত পণ্য বা পরিষেবার তথ্যপ্রদানের পাশাপাশি সেই ব্যাপারে দ্রুত হারে তার আকর্ষণ তৈরি করার চ্যালেঞ্জ থাকে সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনে। ফেসবুকের কথাই ধরা যাক, এর হোমপেজ স্ক্রল করার সময় চোখের সামনে অজস্র পপ-আপ হাজির হয়। অজস্র বিজ্ঞাপনও। কিন্তু বিজ্ঞাপনটি সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সেখানে সামান্য সময় স্ক্রলিংয়ে বিরতি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে ভিডিও আকারে যে বিজ্ঞাপনগুলো ফেসবুকে হাজির হয়, সেগুলোতে ভিউয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পুরো ভিডিওর অটো-প্লে চালু করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। অবশ্য মিউট আকারে ওই ভিডিওগুলো অটো-প্লে হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভিউয়ার যদি কোনো ভিডিওর প্রতি আকর্ষিত হন, তিনি ওই ভিডিওর সাউন্ড অন করতে পারেন। ইউটিউবেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে আকর্ষণ তৈরির প্রয়াস থাকে। কেননা, অনেক ক্ষেত্রেই ইউটিউব বিজ্ঞাপনে ভিউয়ার সেটি দেখবেন কি না, সেই অপশন থাকে ভিউয়ারের হাতে। তার আগে বাধ্যতামূলকভাবে তাকে নির্দিষ্ট কয়েক সেকেন্ড বিজ্ঞাপনটি দেখতে হয়, তারপর তিনি ওইটা স্কিপ করে যেতে পারেন। এ কারণে স্কিপ করার আগেই ওই বিজ্ঞাপন যাতে ভিউয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, সেই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হয়। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘টাইম’-এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবহার ও সর্বোচ্চ উপযোগিতাকে বিজ্ঞাপনে নিয়ে আসার বিষয়টি বিজ্ঞাপন নির্মাতার একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, ফিল্ম- সব ক্ষেত্রের বিজ্ঞাপনেই সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সময়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবহার ডিজিটাল মিডিয়ায় সর্বাধিক, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে। তা ফেসবুক হোক, অথবা ইনস্টাগ্রাম কিংবা ইউটিউব।
আগেই বলা হয়েছে, আজকের সাইবারনেটিক্সের যুগে সাইবার-অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই সাইবারস্পেস বা ওয়েবস্পেসে বিজ্ঞাপন তার নিজের ভাষাকে আরও ব্যাপ্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, ওয়েব মিডিয়াকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনের অর্থনীতিও অন্যান্য গণমাধ্যমের অর্থনীতির থেকে অনেকটাই বিকেন্দ্রিক। কারণ, এখানে স্বাধীন উদ্যোগে মাস কমিউনিকেশনের আয়োজন করে তা থেকে ভালোমতো অর্থ উপার্জন করা যায় (ইউটিউব চ্যানেলগুলোর কথাই ধরা যাক), আর এই বিকেন্দ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এখানকার বিজ্ঞাপনগুলো। সে কারণেই ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় চ্যানেল তৈরির মধ্য দিয়ে বিকল্প ও বিকেন্দ্রিক গণমাধ্যম ব্যবস্থার স্থাপনা হয়েছে বৈপ্লবিকভাবে। এর পেছনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে বিজ্ঞাপন।
অতনু সিংহ
মডেল: অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া মাজহার
মেকওভার: পারসোনা
কৃতজ্ঞতা: মিথিলা
ছবি: সৈয়দ অয়ন