ফুড বেনিফিট I চালের পুষ্টিচলন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যে খাদ্য হিসেবে চাল তথা ভাতের কদর ব্যাপক। কারণ এর অশেষ পুষ্টিগুণ। রোগবালাই দূর করতে তো বটেই, ত্বকচর্চায় এটি বেশ কার্যকর
নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু হয়েছিল চাল উৎপাদনের ইতিহাস। মানুষের স্থায়ী বাসস্থান তৈরি ও কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে এর সম্পর্ক।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিএনএএসের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভাত হিসেবে গ্রহণযোগ্য চাল উৎপাদনকারী ধানের বয়স ৮ হাজার থেকে ১৩ হাজার বছর। কথিত আছে, বুনো প্রজাতির ধানকে প্রথম চাষের আওতায় আনা হয়েছিল চীনে। বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অনুযায়ী, প্রথম ভাত খাওয়ার প্রচলন ঘটেছিল চীনের পার্ল উপত্যকায়। তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, নেপাল কিংবা বাংলাদেশে ধান চাষ শুরু হয়েছিল ৩ থেকে ৫ হাজার বছর আগে। এর প্রমাণ মিলেছে ভারতের অনেক প্রত্নস্থান থেকে পাওয়া ধানের তুষ, পুড়ে যাওয়া ধান ও চালের নিদর্শন থেকে। অনেক স্থানে মৃৎপাত্রের গায়ে ধান-চালের পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা খাদ্যদ্রব্য হিসেবে চালের উপস্থিতি নির্দেশ করে।
ইতিহাস যা-ই হোক, চাল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। গবেষকেরা বলছেন, গমের চেয়ে চাল ভালো। বিশেষ করে সুগার এড়াতে। লাল চালে আছে ফাইটিক অ্যাসিড, ফাইবার এবং এসেনশিয়াল পলিফেনলস। লাল চাল এমন একটি কাবোর্হাইড্রেট, যা আমাদের শরীরে সুগার নিঃসরণ কমায় এবং ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত রাখে।
লাল চাল ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। ফলে এটি আমাদের হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এ ছাড়া শিরা-উপশিরায় কোনো ধরনের ব্লক হতে দেয় না। সেলেনিয়াম নামের একধরনের উপাদান থাকায় এটি হার্টের জন্য ভালো। হাইপারটেনশন এবং অন্যান্য হৃদ্্রোগের ঝুঁকি কমায় লাল চাল। উচ্চ মাত্রায় আঁশ থাকায় হজমে সহায়ক। পাশাপাশি গ্যাস শোষণ প্রতিরোধ করে। ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফরাস থাকায় শরীরের স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করে। লাল চালে বিদ্যমান তেল শরীর থেকে এলডিএল কোলেস্টেরল ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনে।
চালের তালিকায় লাল চালের পর সবচেয়ে পুষ্টিকর বাদামি চাল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক আবিষ্কার করেছেন, সপ্তাহে দুই কাপ বাদামি চাল খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। এটি দৈনিক ৫০ গ্রাম খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। শরীরের প্রয়োজনীয় ফাইবারের প্রায় ১৪ শতাংশের জোগান দেয় বাদামি চাল। এ ছাড়া কোলন ক্যানসার এবং ব্রেস্ট ক্যানসার থেকে সুরক্ষা দেয় এ ফাইবার। হৃদ্রোগের উপশমেও সাহায্য করে। শরীরে দৈনিক ম্যাঙ্গানিজের চাহিদার ৮৮ শতাংশই পূরণ করে বাদামি চাল। এ উপাদান ফ্রি র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এ ছাড়া শরীরের প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট থেকে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে ম্যাঙ্গানিজ। বাদামি চালে থাকা সেলেনিয়াম ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে এবং ডিএনএ মেরামত করে। তা ছাড়া এই সেলেনিয়াম থাইরয়েড হরমোনের বিপাক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং ইমিউন সিস্টেমের কাজে সহায়তা করে। দৈনিক চাহিদার ২৭ শতাংশ সেলেনিয়ামের জোগান দিতে সক্ষম বাদামি চাল।
এতে প্রদাহরোধী গুণসম্পন্ন ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট বিদ্যমান, যা মেটাবলিক সিনড্রোম এবং শিশু অবস্থায় অ্যাজমা হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
স্বাস্থ্যগুণে সাদা চালও কম যায় না। যদিও সাদা চালের চেয়ে লাল বা বাদামি চালই ভালো। সাদা চালের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে এটি শরীরে শক্তির জোগান দেয়। এ ছাড়া এটি পেটের নানাবিধ সমস্যা দূর করে। যেমন ডায়রিয়া, আমাশয়, কোলাইটিস, এমনকি মর্নিং সিকনেস।
অভ্যন্তরীণ ছাড়াও শরীরের বাহ্যিক অংশের বেশ কিছু উপকারে আসে চাল। বিশেষ করে চাল ধোয়া পানি। এ পানি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। চাল ধোয়া পানিতে প্রোটিন, ভিটামিন, শর্করা, খনিজ পদার্থসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। প্রথম ও দ্বিতীয়বার ধোয়ার সময় চাল থেকে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম বের হয়। পটাশিয়াম সমৃদ্ধ পানি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। চাল ধোয়া পানি গরম করে পান করলে হজমের সমস্যা দূর হয়। প্রাচীন চীনা চিকিৎসায় এই পানি পাকস্থলীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো।
চাল ধোয়া পানি গরম করে তা দিয়ে হাত-মুখ ধুলে ত্বকের লোমকূপ পরিষ্কার হয়। দ্বিতীয়বার যে পানি পাওয়া যাবে, তা আলাদা পাত্রে জমিয়ে রাখলে কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে পাত্রের তলায় কিছুটা অবশেষ জমা হবে। তখন উপরের পানি আলাদা করে তাতে মুখ ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দুই বা তিনবার এই কাজটি করলে আপনার ত্বক আগের চেয়ে বেশি মসৃণ হবে। অ্যালার্জি থেকে সুরক্ষা মিলবে।
চাল প্রথম ও দ্বিতীয়বার ধোয়ার পর যে পানি পাওয়া যায়, তাতে পিএইচ-এর মান থাকে ৫.৫। তৃতীয়বার কিংবা চতুর্থবার ধোয়ার পর পানির পিএইচ দাঁড়ায় ৭.২। যা সাবান-পানির ভূমিকা পালন করতে পারে। কখনো কখনো তা সাবান-পানির চেয়েও বেশি কার্যকর।
এসব ছাড়াও চটচটে চালে কপার থাকে। এ উপাদান শরীরের সংযোজক টিস্যুগুলোকে শক্ত করে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের সঠিক সঞ্চালনে সাহায্য করে। জেসমিন রাইস বা জুঁই চাল শরীরের পেশির যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট