ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I প্রকৃতির প্রেরণায় ফ্যাশন
সম্প্রতি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রকৃতির প্রেরণায় ফ্যাশনকে উপজীব্য করে আয়োজিত প্রদর্শনী দেখার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন আফসানা ফেরদৌসী
ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট (ভি অ্যান্ড এ) মিউজিয়াম লন্ডনের তো বটেই, সারা পৃথিবীর অনুসন্ধিৎসু পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। অনেক বছর আগে এই মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। গেল ডিসেম্বরে লন্ডন সফরে গিয়ে লোভ সামলাতে না পেরে দ্বিতীয়বারের মতো পা রাখি অতীত ও বর্তমানের মিলনস্থল ভি অ্যান্ড এ মিউজিয়ামে। এবার ভাগ্য আরও প্রসন্ন। কেননা দেখার সুযোগ হলো ‘ফ্যাশন ফ্রম নেচার’ প্রদর্শনীর। এ ধরনের প্রদর্শনী দেখা মানে অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন; যেটা আমাদের দেশে মেলে না। প্রদর্শনীর মূল বিষয়টাও দারুণ: ইতিহাসের সরণি বেয়ে প্রকৃতির অসামান্য সৌন্দর্য আর শক্তির প্রেরণায় তৈরি পোশাক আর অনুষঙ্গ নেড়েচেড়ে দেখা। পাশাপাশি প্রাকৃতিক জগতে ফ্যাশনের প্রভাব কতখানি, সেটাও অনুসন্ধান করা। চাক্ষুষ করা আমাদের ভূপ্রকৃতি কী ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পকারখানার দ্বারা। এই প্রদর্শনীতে আরও উপস্থাপিত হয়েছে ষোড়শ শতক থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন জনপ্রিয় স্টাইল।
প্রদর্শনীটি সাজানো হয় প্রায় ৩০০ উপকরণে। আর অসাধারণ এই প্রদর্শনী দেখার জন্য সম্মানী গুনতে হলো ১২ পাউন্ড। ঢুকতেই শ্রবণেন্দ্রিয় উতরোল হয় পাখির কিচিরমিচিরে। চিরচেনা শব্দ। এই শব্দ ছাপিয়ে কখনো প্রকট হয় ভারী যন্ত্রের আওয়াজ কিংবা গাছ কাটার হৃদয়বিদারক শব্দ।
দুটি ফ্লোর নিয়ে সাজানো পুরো এক্সিবিশন। প্রথম ফ্লোরে রয়েছে ফ্যাশনের ইতিহাস। যেখানে তিমির হাড়ের বক্ষবন্ধনী, সংকোচনযোগ্য শিরস্ত্রাণ, পাখি বসানো টুপি, পালকের টুপি, গয়না ইত্যাদি। এর মধ্যে ছিল ১৭৮০ সালের একটি ওয়েস্টকোট। এটা তৈরিতে প্রকৃতি কীভাবে এবং কতখানি ডিজাইনারের প্রেরণা হয়েছে, তা এই কোটটি চাক্ষুষ করলেই স্পষ্ট হয়। সিল্ক ও লিনেনে তৈরি এই ওয়েস্টকোটের জমিনে সূক্ষ্ম সূচিকর্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বানরের খাদ্য বিনিময় প্রথা। তা ছাড়া এতে বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতিজ ছাপা ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭৯০ সালে ব্রিটেনে তৈরি উইলিয়াম কিলবমের একটি ব্লকপ্রিন্ট করা গাউনও স্থান পায় প্রদর্শনীতে। তবে চোখ আটকে যায় একটি ছাপা পোশাকে। এতে সূক্ষ্মভাবে সম্পূর্ণ এবটি বাগানকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ১৮৯৫ সালে ফ্রান্স কিংবা লন্ডনে তৈরি একটি স্কার্ট মুগ্ধ করে আমাকে। সিল্কের এই স্কার্ট দেখতে অবিকল একটি ফুলের মতো। এতে আবার হাতের কাজ করা।
১৮৬৮ সালে ব্রিটেনে তৈরি একটি ড্রেসও দৃষ্টিগোচর হয়। সোনার জরি আর ভারতীয় গুবরে পোকার ডানা জমিন অলংকৃত। এতে ৫০০০ ডানা ব্যবহার করা হয়েছে। সিল্ক, উল, ঘোড়ার পশম, স্টিল ও রাবারে তৈরি ওয়াকিং ড্রেসটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৮৮৫ সালে ফ্রান্সে তৈরি করা হয় ড্রেসটি। পালকের তৈরি অনেক ধরনের পোশাক, টুপি আর গয়না প্রদর্শনীতে স্থান পায়। এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত পোশাকের ভ্যালু অ্যাডিশনে দেখা গেছে হাতির দাঁত, মাদার অব পার্ল, কচ্ছপের খোলের ব্যবহার।
ইউরোপের ফ্যাশনেবল পোশাকের জন্য দামি কাপড় এবং অনুষঙ্গ সে সময় যেত আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে। এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মসলিনের কথা উল্লেখ করতেই পারি। গোটা ইউরোপের অভিজাত নারীদের প্রতীক্ষা থাকত এই কাপড়ের জন্য। আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে করে হাতির দাঁত যেত ব্রিটেনে। পাশাপাশি আফ্রিকা থেকে আরও যেত কৃতদাস। চীনের ক্যান্টনে হতো হাতির দাঁত আর মাদার অব পার্লের কাজ। এগুলো যেত সেখান থেকে। আবার বলিভিয়ার পেটোসি খনির আহরিত থেকে রুপার লেস ট্রিমিং আমদানি করা হতো। সেই সময়ে প্রাকৃতিক রঙের উৎস ছিল পোকা আর গাছ। এসব কাঁচামাল যেত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে। প্রদর্শনীর প্রথম তলার পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রকৃতিজ ফ্যাশনের ইতিহাস।
উপরের তলার মূল ফোকাস ছিল আধুনিক জমানা। ফ্যাশনকে টেকসই করে তোলার জন্য ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে নতুন নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে, তা-ও উপস্থাপিত হয়েছে এই ফ্লোরে। শুরুতেই এমা ওয়াটসনের পোশাক রাখা ছিল। এটা তিনি ২০১৬ সালের মেট গালায় পরেছিলেন। আর এই এমা কে জানেন তো? ওই যে হ্যারি পটার সিরিজের সেই কিউট মেয়েটা। কেলভিন ক্লেইন এই পোশাক প্লাস্টিকের বোতল পুনর্ব্যবহার করে তৈরি করে। এই পোশাক কেবল দৃষ্টিনন্দনই নয় বরং সবুজ গালিচায় গ্ল্যামারকে উপস্থাপনার বিষয় মাথায় রেখেই এটি তৈরি। এখানে চটক আর টেকসই ফ্যাশন উভয়ই সমানভাবেই দৃশ্যমান হয়েছে।
নানা ধরনের সৃষ্টিশীল আর নতুন উদ্ভাবিত কাপড়ে তৈরি সব পোশাক স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। ওয়াইন উপজাত থেকে চামড়ার বিকল্প তৈরি করেছে ইতালীয় কোম্পানি ভেগা। কমলা সুতা তৈরি করা হচ্ছে ইতালিয়ান পাতিলেবুর বর্জ্য থেকে। এ ছাড়া সাগরপাড়ের প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারে তৈরি কাপড় দিয়ে এইচ অ্যান্ড এম তৈরি করেছে পোশাক। ১৯৯৭ সালে জাঁ পল গতিয়েরের চিতাছাপ গাউন। ২০১৬ সালের জাইলস ডিকনের ওত কতুর ড্রেসের প্যাটার্ন দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এটা করা হয় পাখির ডিমের আদলে। আবার প্রদর্শিত অনেক পোশাক ছিল পুনর্ব্যবহৃত। উদাহরণ হিসেবে ১৯৪২ সালের একটি সিল্ক ব্লাউজের উল্লেখ করাই যায়। এখানে বেশ কিছু ম্যাটেরিয়াল প্রদর্শিত হয়েছে, যেগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক কম ক্ষতিকর। নরম কাঠ অর্থাৎ ট্যানসেল দিয়ে তৈরি টেকসই কাপড় ১৯৯২ সালে তৈরি করে কোর্টলড।
আশির দশক থেকে ক্যাথরিন হ্যামনেট আর ভিভিয়েন ওয়েস্টউডসহ অনেক ডিজাইনার ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে সোচ্চার পেটা, গ্রিনপিস এবং ফ্যাশন রেভল্যুশন। তাদের কারণেই এখন ডিজাইনাররা ফার বর্জন করছেন। গত নিউ ইয়র্ক আর লল্ডন ফ্যাশন উইকে একাধিক ডিজাইনার ও ব্র্যান্ড ফার নিয়ে কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখানে এমন কিছু ডিজাইনারের কিছু প্রডাক্ট ছাড়াও ছিল আমদানি-রপ্তানির একটি মানচিত্র।
বাংলাদেশ থেকে ছেড়ে আসা জাহাজ আমেরিকা যাচ্ছে। মানচিত্রে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। আর এভাবে উল্লিখিত নিজের দেশের নাম দেখে ভালো অবশ্যই লেগেছে। তবে মন খারাপের কারণ হয়েছে ফাস্ট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। পরিবেশের ক্ষতিসাধন এর মাধ্যমে কীভাবে হচ্ছে তা রীতিমতো জেনে শিউরে উঠতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, ফ্যাশন বিপ্লব নিয়ে একটি ইনস্টলেশনও ছিল এই প্রদর্শনীতে।
এই তলার একটি দেয়ালজুড়ে ছিল ২০৩০ সালে ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণার উপাত্ত। এতে তুলে ধরা হয়েছে একাধারে সিনথেটিক কাপড়ের ক্ষতিকর দিক আর তুলা চাষের জন্য পরিমাণে জল ও কীটনাশক ব্যবহারে প্রকৃতির সংকট।
পুরো প্রদর্শনী দেখে দুটো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে: এক. কীভাবে আরও টেকসই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি আমরা গড়ে তুলতে পারি। দুই. অতীত থেকে কী শিক্ষা আমরা নিতে পারি।
এই প্রদর্শনী চাক্ষুষ করে অবগত হওয়া যায়, সময়ের সঙ্গে বস্ত্রশিল্পের পরিবর্তন আমাদের কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে সময় এসেছে সচেতনতা গড়ে তোলার। কারণ, পোশাক ক্রয়ে আমাদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কারণ, পোশাক কেবল কিনলেই হবে না, তার সত্যিকারের মূল্য দিতে হবে। এ জন্য পোশাক কেনার আগে আমাদের উচিত সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে পছন্দ ও বাছাই করা, পরিধানে যত্নবান হওয়া আর অবশ্যই পুনর্ব্যবহারে সচেষ্ট থাকা।
লেখক: ফ্যাশন ডিজাইনার এবং এসডিসির বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সমন্বয়ক
ছবি: লেখক