বিশেষ ফিচার I শাটিকাপ্রাণিত
১২ হাত বা ১৮ ফুট দীর্ঘ একটি বস্ত্রখন্ড। তাতেই একটি আউটফিট। বিস্ময়কর এক পোশাক। নানাভাবে পরা যায় সেলাই ছাড়াই। পাশ্চাত্যে এ নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই। গত শতকের গোড়া থেকে এই গেল বছর পর্যন্ত শাড়িকে প্রেরণা করে অসাধারণ সব ডিজাইনের আউটফিট তৈরি করেছেন ডিজাইনাররা। কিংবদন্তি থেকে নবাগত- সেই তালিকা কম দীর্ঘ নয়। শাড়িপ্রেরণার পোশাকের আঁতিপাঁতি খুঁজেছেন শেখ সাইফুর রহমান
আচ্ছা, কারও কি মনে আছে ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ ছায়াছবিটির কথা? ১৯৬১ সালে মুক্তি পেয়েছিল। আর এই ছবিতে প্রিয় বন্ধু অড্রে হেপবার্নের জন্য কস্টিউম ডিজাইন করেছিলেন জিভাঁশি। হলি গোলিথ্লি চরিত্রে অড্রের জন্য তৈরি লিটল ব্ল্যাক ড্রেসের কথা এখানে আলোচ্য নয়। বরং শাড়িপ্রাণিত পোশাকটার কথাই ধরা যাক। একটা পার্টির দৃশ্যে অনেকের মাঝে অড্রে তথা হলি। নাচের ভঙ্গিমায়। হঠাৎ দেখলে মনে হবে শাড়ি পরে আছে। কিন্তু না। ওটা শাড়ি নয়। শাড়ির মতো ড্রেপ করে পরা গাউন। মজার ব্যাপার হলো, এটা ছিল বেডশিট, শাড়ি নয়। সেটাকেই এভাবে পরানো হয়। অড্রেকে সিগারেট ধরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যে পোশাকটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হলে এই গাউনকে শাড়ি বলে ভ্রম হতেই পারে। যেন কাঁধে আঁচল ফেলা। বলা হয়ে থাকে, এভাবেই হলিউডে শাড়িকে প্রথম পরিচিত করান হিউবার্ট ডি জিভাঁশি। কিংবদন্তি ফরাসি ডিজাইনার। যাঁকে আমরা হারিয়েছি গত বছর।
শুরুটা দেখে এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু নিয়ে কৌতূহলের উদ্রেক স্বাভাবিক। পৃথিবীতে সভ্যতার উন্মেষকালে কাপড় বুনতে শেখার পর তা পেঁচিয়ে পরা হয়েছে। যেটাকে এখন ফ্যাশনের পরিভাষায় ড্রেপিং বলা হয়। সুই-সুতার ব্যবহার শেখার আগ পর্যন্ত সেলাইবিহীন পোশাকই তো মানুষ একসময় পরেছে। গ্রিক-রোমানদের ড্রেপিংয়ের কথাই ভাবুন। তাদের প্রাচীন ভাস্কর্যগুলোতে, ছবিতে এটা স্পষ্ট যে, সেলাইহীন কাপড় পেঁচিয়ে পরাই ছিল প্রাচীন গ্রেকো-রোমানদের পোশাকসংস্কৃতি। ড্রেপিং ফ্যাশনের প্রেরণা হয়েছে; হচ্ছেও। এই ভূখন্ডের মানুষের মূল পোশাক বলতে ছিল সেলাইবিহীন বস্ত্রখন্ড। নারী-পুরুষনির্বিশেষে। অর্থাৎ শাড়ি ও ধুতিই আমাদের মূল পোশাক। বিষয়টি আমরা আকসার বিস্মৃত হই। আর অতি উৎসাহী হয়ে এই পোশাকের গায়ে আবার ধর্মের ছাপ লাগিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হই না। যা হোক, আজও বিশ্বের বিস্ময় এই শাড়ি। সেলাই ছাড়া ১২ হাত কাপড় পরার কৌশল এবং নানা স্টাইলও বিস্মিত করে বিশ্ববাসীকে। মোহিত যে করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমরা বাঙালিরা এই অনিন্দ্যসুন্দর পোশাককে নানাভাবে উপেক্ষা করে চলেছি, নানা দোহাই দিয়ে।
অথচ ভেবে দেখুন তো, ‘শাড়ির মতো সর্বংসহা পোশাক আর হয়? রোগাত্ব-মোটাত্ব ঢাকাঢুকি দিতে শাড়িই শ্রেষ্ঠ। শাড়ির আঁচল তো একাই এক শ। রোদ্দুরে ওড়না, বিষ্টিতে ছাতি, শীতে আলোয়ান, কাশিতে মাফলার, হাত মুছতে তোয়ালে, চোখ মুছতে রুমাল। বেকায়দায় পড়লে বাচ্চার নাক মুছতেও লাইফ সেভার। কোনো জিনস, টি-শার্টের সাধ্যি নেই শাড়ির সঙ্গে পাল্লা দেয়।’- কথাগুলো নবনীতা দেবসেন গেল বছরের ১২ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক পত্রিকা সংবাদ প্রতিদিনের সাময়িকপত্র রোববারে লিখেছিলেন।
যা হোক, আমাদের বিষয় আসলে সরাসরি শাড়ি নয়, বরং শাড়ির প্রেরণায় তৈরি পোশাক। শুরু করেছিলাম জিভাঁশির প্রসঙ্গ এবং সৃজন দিয়ে। এরপরও তিনি নানা সময়ে শাড়িকে তাঁর সৃজনপ্রেরণা করেছেন। ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’জ মুক্তির পরের বছরই। ১৯৬২ সালে লাইফ ম্যাগাজিনের মে ইস্যু এডিটরিয়ালের জন্য। এখানেও সেই গাউন পরেছেন তাঁর বন্ধু অড্রে। এবার হলুদ ড্রেস। একাধিক পরতে তৈরি মনোহর এমব্রয়ডারির এই অফশোল্ডার গাউনের নিচের দিকে অনেকটা কাপড় ছড়ানো। যেন মাটিতে লুটানো আঁচল। এই গাউন স্রষ্টার বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে: পোশাকের আকার কোনোভাবেই নয়, বরং পোশাক অবশ্যই নারীর শরীরকে অনুসরণ করবে না।
এই হলুদ ড্রেসটি বেজায় মনে ধরেছিল তখনকার ফার্স্ট লেডি জ্যাকি কেনেডির। এমনকি আমেরিকান ডিজাইনার ওলেগ কাসিনিকে ওই পোশাক তিনি পুনঃসৃজন করিয়ে নেন। আর তা পরে উপস্থিত হন সেই সময়ের ভারতের রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে।
হামিশ বাওয়েলসের লেখা জ্যাকি কেনেডিতে আরও মেলে শাড়ি নিয়ে তাঁর একান্ত অনুরাগের কথা।
এখন কি সত্যিই শাড়ি নিয়ে তেমন নিরীক্ষা হয়? উত্তর উভয়বিধ। হয়, আবার হয় না। কেউ করেন, কেউ করেন না। তবে ভাবুন তো সেই ১৯৩০ সালের কথা। ঘোমটাকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেলেন জোসেফিন বেকার। তৈরি করলেন গাউন। সঙ্গে অবশ্যই সেই ঘোমটা। স্টাইল আইকন ও কণ্ঠশিল্পী বেকারের সেই নিরীক্ষা ইতিহাস হয়ে থাকল। আজও যা স্মরণ করে থাকেন ফ্যাশন-অনুরাগীরা।
সে বছরই প্যারিসে পা রাখেন চতুর্দশবর্ষীয়া এক ভারতীয় রাজকুমারী। এর পাঁচ বছর পর কাপুথালার সেই প্রিন্সেস কারাম বিখ্যাত ফ্যাশন মাগাজিন ভোগ-এর প্রচ্ছদ আলো করেন। এই পাঞ্জাব দুহিতার প্রেরণায় বিখ্যাত ইতালিয়ান ডিজাইনার এলসা শিয়াপারেল্লি তৈরি করলেন গাউন। সেটা পরেই তিনি ভোগ-এর কভার গার্ল হলেন। এই গাউনকে অনেকে অবশ্য গ্রেসিয়ান টোগা আর শাড়ির সংকর বলে থাকেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাতে ছিল শিয়াপারেল্লি স্টেটমেন্ট।
এরপর আরও দুই দশক পর আরেক বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার পিয়ের বালমাঁ শাড়িকে সৃষ্টির প্রেরণা করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি বিশেষ এক পোশাক তৈরি করেন নারীসুলভ কমনীয়তার সঙ্গে সাহসী লুকের মিশেল ঘটিয়ে। তাঁর আইকনিক ‘জোলি মাদাম’ ফ্যাশনে উচ্চ কোটির আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।
এর চার বছর পর শাড়িকে হলিউডে নিয়ে যান হিউবার্ট ডি জিভাঁশি, তাঁর স্ট্র্যাপলেস শাড়ি গাউনের মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গ দিয়ে নিবন্ধটির সূচনা করেছিলাম। আরও দুই বছর পর ক্রিস্তোবাল বালাঁসিয়াগা তাঁর সোনালি শাড়ি ড্রেস দিয়ে মাত করে দেন। পোশাকটি এখনো স্বীকৃত মাস্টার অব ওত্ কতুর অভিধায়। এই ড্রেস পরে কিংবদন্তি অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর উপস্থিত হয়েছিলেন পারিতে ছবির প্রিমিয়ারে।
স্মৃতির সরণি ছেড়ে এবার না হয় একটু বর্তমানের পথে পায়চারি করা যাক। গেল সেপ্টেম্বরের অটাম-উইন্টার ফ্যাশন উইকের নিউইয়র্ক পর্বে ভারতের প্রবাল গুরুং উপস্থাপন করলেন তাঁর সংগ্রহ। তাতে ছিল ফুশিয়া টোনের র্যাপ স্কার্ট। সঙ্গে বুননে নকশা করা স্কার্ফ। এর একাংশ ডান কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত কোনাকুনিভাবে নামানো। অন্য অংশ গলায় পেঁচিয়ে ডান কাঁধেই ফেলে রাখা। এভাবে আমরা ওড়না, উত্তরীয় বা চাদর পরে থাকি। স্টাইলটি চমৎকার এবং দৃষ্টিনন্দন। বলে দিতে হয় না পোশাক ও স্টাইলিং শাড়িপ্রাণিত। তবে ইন্টারন্যাশনাল রানওয়ে ডিজাইনারদের এটাই প্রথম শাটিকাপ্রেমের প্রদর্শন নয়। বরং ২০১২ সালে শ্যানেলের জন্য করা কার্ল লেগারফেল্ডের হোমেজ টু ইন্ডিয়া কালেকশনে তিনি শাড়িকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন। এই কালেকশনের শিরোনাম ছিল বোম্বে প্যারিস কালেকশন। কিংবা আরও পিছিয়ে ২০০৩ সালে জন গ্যালিয়ানোর বসন্ত সংগ্রহেও সেটা দেখেছে আবিশ্ব। ২০১৩ সালের স্প্রিং-সামারে মারশেসার কালেকশনটা দেখার মতো। সেখানে অনুপ্রেরণা যুগপৎ শাড়ি ও বলিউড।
পরের বছর মিলানের অটাম-উইন্টার উইকে ভারতের রাহুল মিশ্র শাড়ির প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ভারতীয় ডিজাইনারদের মধ্যে সব্যসাচী মুখার্জির কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর শাড়ি-অনুরাগ অবিসংবাদিত। কে না জানে পেপসির (সব্যসাচীর ডাকনাম) লেহেঙ্গা-শাড়ির কথা। এ ছাড়া হালে অনেক ডিজাইনারই শাড়ি নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। ট্রাউজারের সঙ্গে শাড়ি পরানো মায় শাড়িকে পোশাকের প্রেরণা করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে।
নতুন শতকে বেশ ভালোভাবে পশ্চিমা ডিজাইনারদের প্রেরণা হয়েছে ভারত। এর মধ্যে অনেকেই শাড়ি নিয়ে নিরীক্ষায় ব্রতী হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বলতেই হয় জাঁ পল গতিয়েরের কথা। তিনি ২০১৭ সালের ফল কতুরে ভারতীয় মহারাজা থিমে কাজ করেন। সেখানে নারীর পোশাককে পুরুষের পোশাকে রূপান্তর করে উপস্থাপিত হয়। এই কালেকশনের একটা অংশ ছিল নারীর পোশাক। যেখানে তিনি শাড়িকেই উপস্থাপন করেছেন অনবদ্য ভঙ্গিমায়। এমনকি তাঁর পুরুষ পোশাকেও ছিল শাড়ি পরার স্টাইল। তবে তাঁর শাড়ির ড্রেপিং স্টাইলে তৈরি গাউনগুলোর একটির বর্ড়ার জুড়ে ছিল ছোট ছোট বিড বসানো। কালো এই গাউন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ১৯৩০-এর দশকে। মনে করিয়ে দেয় শিয়াপারেল্লির ডিজাইন, যেটা তিনি করেছিলেন শাড়ি আর গ্রেসিয়ান টোগার মিশ্র প্রেরণায়।
২০০৮ সালে হারমিসের স্প্রিং-সামার কালেকশনে ছিল শাড়ির দৃষ্টিনন্দন প্রকাশ। সে বছরই ক্রিস্তিয়ঁ দিওর হাউজের হয়ে জন গ্যালিয়ানো শাড়িকে অন্য মাত্রায় উপস্থাপন করেন। সেবারের ফলে বাদ যাননি আলেকজান্ডার ম্যাককুইনও; শাড়িকে নিয়ে খেলেছেন দারুণ মুনশিয়ানায়। পরের স্প্রিং-সামারে অবশ্য জর্জিও আরমানির প্রেরণা ঠিক শাড়ি নয়, ছিল ধুতি। ২০১০ সালের দীপাবলিতে লুই ভুইতোঁ বিশেষ কালেকশন লঞ্চ করে। ভিনটেজ শাড়ি ছিল কেন্দ্রীয় প্রেরণা। আর ডিজাইন করেছিলেন বিখ্যাত ডিজাইনার মার্ক জেকবস।
শাড়ি, কোনো সন্দেহ নেই এক বিস্ময়পোশাক। ভারতীয় নারীরা ৫০০০ বছর ধরে এই পোশাক পরে আসছে। পশ্চিম তা কেবল চোখ কপালে তুলে দেখছে তা নয়, বরং বিশ্ববিখ্যাত ডিজাইনাররা এই পোশাকের পরিধান রীতি, এর শিলুয়েটকে প্রেরণা করেছে। সেই তিরিশের শিয়াপারেল্লি থেকে হালের ডিজাইনাররা- কে নেই এই তালিকায়! ইভ সাঁ লোর থেকে বালাঁসিয়াগা, ক্রিস্তিয়ঁ দিওর থেকে আলেকজান্ডার ম্যাককুইন, দ্রিস ভন নতেঁ (স্প্রিং-সামার ২০১০) হয়ে এলি সাব (২০১৬), ইসাবেলা মারান্ট (২০১৬) মায় মারশেসা।
একটা কথা না বললেই নয়, এই নান্দনিক আউটফিটটি হাল প্রজন্মের কাছে ততটা আদৃত নয়। এর কারণ যত, অজুহাত তার চেয়ে বেশি। ফলে ডিজাইনাররা শাড়িকে ভিন্ন আঙ্গিকে, নতুন ভাবনার জারণে উপস্থাপন করছেন। বলা যেতে পারে সময়ের দাবি, প্রজন্মের দাবিকেই তারা মেনে নিচ্ছেন। ফলে নতুন নতুন শিলুয়েটের অবতারণা হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কথাই-বা বাদ দিই কীভাবে। নতুন ফ্যাশন হাউজ ক্লাবহাউজ শাড়িকে প্রেরণা করেছে। এই প্রয়াসকে পুনরাবৃত্তির সুরে বলাই যেতে পারে হাল প্রজন্মের চাহিদা। বিভিন্ন ধরনের ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে শাড়ির শিলুয়েটকে ড্রেসে রূপান্তর করেছেন ক্লাবহাউজের ডিজাইনাররা। সিকুইন ফ্যাব্রিক, প্রিন্টেড জর্জেট, সিল্ক ইত্যাদি। এ ধরনের ফ্যাব্রিক ব্যবহারে পোশাকের ফল হয়েছে চমৎকার। প্রতিটি ড্রেসেই আঁচলের মতো করে ফ্যাব্রিককে আড়াআড়িভাবে টপের উপর থেকে ফেলা হয়েছে। তাতে করে স্টাইলিং হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এবং আকর্ষক। আর বটমগুলো কোনোটা পালাজো, কোনোটা স্কার্টের আদল পেয়েছে। কিন্তু পরার পর এর প্যাটার্নের জন্য প্রতিটি ড্রেসকে শাড়ি বলে ভ্রম হতে পারে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ক্লাবহাউজের এই নিরীক্ষা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।
sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: ক্যানভাস, ক্লাবহাউজ ও সংগ্রহ