রসনাবিলাস I দ্বিদেশীয় স্বাদের টেবিল
দুই ভিনদেশি খাবারের সমাহার সেখানে। ফিউশনের রোমাঞ্চ। সুখকর অন্দরব্যবস্থায় উষ্ণ আতিথ্যের অভিজ্ঞতা। লিখেছেন সামীউর রহমান
খরাজ মুখার্জির দরাজ গলায় একটা গান শুনেছিলাম, ‘চিতল মাছের মুইঠ্যা, গরম ভাতে দুইটা/ ভুইল্যা বাঙালি খায় চীনা জাপানি লুইট্যা পুইট্যা’। গুলশানের ‘ম্যান মো’ রেস্টুরেন্টে এসে সেই গানটার কথাই মনে পড়ল। চীন ও জাপানের মানচিত্রের মধ্যে পূর্ব চীন সাগরের বিস্তৃত জলরাশি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটা দেশ থাকলেও ম্যান মো রেস্টুরেন্টের মেনুতে চীন ও জাপান এক সুরে বাঁধা! একই টেবিলে চীনা ডাম্পলিংয়ের সঙ্গে জাপানি সুশি খেতে চাইলে নিশ্চিন্তে ঢুঁ মারতে পারেন ম্যান মোতে।
মসলাদার চর্বিযুক্ত মাংসের বিরিয়ানি, বিফ স্টেক, মেয়নেজে ঠাসা বার্গার- এসব কি আর হরদম খাওয়া যায়? অন্যদিকে যানজটের এই শহরে বিনোদনের যে বড়ই অভাব। ফলে দুদন্ড অবকাশের আকাঙ্ক্ষায় নতুন নতুন স্বাদের খোঁজে নানান রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারতেই হয়। সেটা অফিসের পর সহকর্মীদের নিয়েই হোক, কিংবা ছুটির রাতে বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। ম্যান মো রেস্টুরেন্টের অংশীদারদের একজন জাফর ইকবাল জানালেন, সুস্বাদু অথচ স্বাস্থ্যকর খাবারের খোঁজ যারা চাইছেন, তাদের জন্যই ম্যান মো।
জাফর ইকবালের ডাকনাম ক্যাপ্টেন! একটু অবাকই লাগল। সামরিক কায়দায় চুল ছাঁটা হলেও ক্যাপ্টেন হবার বয়সটা যে বেশ আগেই ছাড়িয়ে এসেছেন! বিস্ময়ের মাত্রাটা আরও বাড়ল যখন জানা গেল তার দুই বড় ভাইয়ের নাম কর্নেল ও মেজর। বাবা ফিল্ড মার্শাল ছিলেন কি না, জানার আগেই চলে এলো ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক। জাপানি কায়দায় পরিবেশিত নানান ভেষজের নির্যাস ভরা রঙ চা। সঙ্গে মেনু। ক্যাপ্টেনই জানালেন, জানুয়ারির গোড়ার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে ম্যান মো। তাদের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান আছে গুলশান-বনানী অঞ্চলেই। মিরাজ ও মিলাঞ্জ- দুটোই লাউঞ্জ ঘরানার। তাই চাইছিলেন একেবারে নির্ভেজাল রেস্টুরেন্ট খুলতে। গুলশানের ১১৩ নম্বর রোডের ৬/এ-র যে ভবনটার টপফ্লোরে এখন ম্যান মো, সেখানে একসময় ছিল ‘দ্য গ্লাসহাউজ ব্রেসারি’নামের অন্য এক রেস্টুরেন্ট। আসবাব, ঝাড়বাতি, তৈজস- সবকিছু চীন থেকে এনে নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ম্যান মো আলোর মুখ কিছুটা দেরিতে দেখলেও হেঁশেল চালুর পর থেকে ইতিবাচক সাড়াই পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন। অন্তর্জাল কিংবা করপোরেট জগতে এখনো এর বিপণন শুরু হয়নি। কাজের দিনে মধ্যাহ্নভোজের সময়টায় গ্রাহক উপস্থিতি খানিকটা কম। তবে কর্মীরা জানালেন, সন্ধ্যার পর লোকসমাগম বাড়ে। আয়তনে বড় নয় ম্যান মো, ভেতর-বাহির মিলিয়ে ৮৬ জন অতিথির বসার ব্যবস্থা। ঢাকার অভিজাত পাড়ার একেবারে হৃৎপিন্ডে এর অবস্থান। তাই করপোরেট, ভিনদেশি, স্থানীয় মিলিয়ে ভোজনরসিকদের ভিড় চোখে পড়ার মতোই।
সুশি আর ডাম্পলিং খেতেই এখানে বেশি আসেন ভোজনরসিকেরা। দুটোরই বৈচিত্র্যে অর্ধেকটা মেনু ঠাসা! হরেক রকমের পুরের ডাম্পলিং মিলবে ম্যান মোতে। মুরগির মাংসের কিমার সঙ্গে লেমন গ্রাসের মিশ্রণে বানানো পুরে ভরা ডাম্পলিং, ব্রকলি আর চিজের পুরে ঠাসা ডাম্পলিং, বাটি শাক বা বোক চোয়ের সঙ্গে মাশরুমে ঠাসা ডাম্পলিং থেকে শুরু করে চিংড়ি আর বেবি কর্নের পুর ভরা ডাম্পলিংও আছে। পরিবেশন করা হয় স্টিম পটে। তাই ডাম্পলিংগুলো থাকে ধোঁয়া ওঠা গরম ও টাটকা। সঙ্গে দেওয়া হয় সয়া সস আর ওয়াসাবি সস।
আরও আছে নানান রকম সুশি। স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু। স্যামন মাকি রোল, টুনা মাকি রোল, ক্যালিফোর্নিয়া রোল, ড্রাগন রোল, রেইনবো রোল- বিচিত্র স্বাদের সুশিই ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে। কোনোটায় স্যামন মাছের ফালির সঙ্গে আঠালো ভাত আর সামুদ্রিক শেওলায় মুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে স্কুইড, মাছের ডিম আর পনির। কখনো স্কুইডের জায়গা নিচ্ছে কাঁকড়ার মাংস।
চীনা ও জাপানি ফিউশন ফুডের এই রেস্তোরাঁয় অবশ্য সাবেকি ঘরানার অর্থাৎ প্রথাগত ইন্দোচীনা মেনুর কিছু কিছু খাবারও আছে। অথেন্টিক বা ফিউশন চীনা খাবারের মাঝেও স্মৃতি উসকে দেওয়া সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন, স্টির ফ্রায়েড মিক্সড ভেজিটেবল, মিক্সড ফ্রায়েড রাইসও আছে। তাই পুরোনো দিনের চীনা খাবারের নস্টালজিয়ার সঙ্গে অথেন্টিকের ফিউশন করতেও এখানে ঢোকা যায়। গাঢ় থাই স্যুপের বদলে জাপানি রামেন স্যুপ বা মিসো স্যুপের সঙ্গে পছন্দের ডাম্পলিং দিয়েই হতে পারে শুরুটা। তারপর ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে ক্রিসপি চিকেন উইথ ক্যাশু নাট আর সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন জমিয়ে দেবে রসনা। মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা অবশ্য নেই, তবে উষ্ণ ও শীতল সব রকমের পানীয় ও তাজা ফলের রসের বন্দোবস্ত আছে ম্যান মোতে।
শীতের সন্ধ্যায় ঝাড়বাতির আলোয়, সোনালি চেয়ারে বসে ধূমায়িত স্যুপ মুখে তুলতে কিংবা কাঠি দিয়ে ডাম্পলিং তোলার কসরত করতে চাইলে যেতে পারেন ম্যান মোতে। স্বাদ, অন্দরসজ্জা, আতিথেয়তা- ভালো লাগবে সবই। দুজনে মিলে খেতে খরচ হবে হাজার দুয়েক টাকা, কর আলাদা।
লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: জেটো ডিজিটাল