ট্রাভেলগ I আমার পায়ের তলায় সর্ষে
বাংলাদেশের মেয়ে। বিলাতে পাড়ি দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। থিতু হয়েছেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের দেশ সুইডেনে। আর ঘুরে ফিরেছেন পৃথিবীর নানা দেশে। শতক পূর্ণ করেছেন এরই মধ্যে। সর্বশেষ পরিব্রাজন ছিল আফ্রিকায়। সেই গল্পই আমাদের শোনাচ্ছেন নাজমুন নাহার
সুচিন্তা আর ইচ্ছাশক্তিই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে। আমার ক্ষেত্রেও বোধ হয় এটা সত্য। কারণ, আমি কখনো কোনো বাধা মেনে নিইনি। বরং তাকে টপকানোর চেষ্টা করেছি। কারণ, পাছে লোকে কিছু বলে ভেবে বসে থাকলে আমার পক্ষে অভীষ্ট অর্জন সম্ভব হবে না। তাই কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে পথে নেমেছি। জানতাম একদিন স্বীকৃতি মিলবে।
এ জন্যই তো আমি পিছপা হইনি কোচ সার্ফিংয়ের ছেলেদের সঙ্গে রাত কাটাতে। আমি দেবদূত দেখিনি। কিন্তু ওদেরকে আমার সাক্ষাৎ দেবদূতই মনে হয়েছে। আমি ঘানাতে ছিলাম ব্যাচেলরস অ্যাপার্টমেন্টে; এরপর টোগোতেও ছিলাম। সেখানে একটি ছেলে আমাকে তার ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজে বারান্দায় ঘুমিয়েছে। একটু বলে নিতে চাই, বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের আতিথ্য দেওয়া হয় কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে। আমার আগে আর্জেন্টিনার এক ছেলে ছিল ওখানে।
আমাদের এত দিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, বিদেশে লিঙ্গবৈষম্য সেই অর্থে নেই। মেয়েদের বেলায় ধর্ষণের ভয়টাই মূল। কিন্তু আমার মনে হয় না ভয়ের কিছু আছে। বরং আমি আফ্রিকাতে দেখেছি ছেলেমেয়ে সবাই সমান। আমাকে সম্মান দিয়ে ছেলেরা আমার পাশে বসেছে। একই বাসায় থেকেছি। কোনোভাবেই তাদের এলিয়েন মনে হয়নি। বরং নিজের দেশকেই অতিথির কাছে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। আসলে এসব বলার কারণ আর কিছুই নয়, বরং আমাদের মেয়েদের ভয় ভাঙানো। যাতে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জগৎ দেখার চেষ্টা করে।
একটু বলে রাখতে চাই। আমি পরিব্রাজক। লেখক নই। তবে চেষ্টা করব আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা হয়তো খাপছাড়া হয়ে যেতে পারে।
আমি আফ্রিকার অনেক দেশেই গিয়েছি। বলা যেতে পারে আমার শেষ পরিব্রাজন ছিল আদতে আফ্রিকা এক্সপেডিশন। আফ্রিকায় মেয়েরা ব্যবসা করে; এমনকি কোনো কোনো দেশের মন্ত্রীর স্ত্রীরও সেটা দেখেছি। আর তাদের একটা বড় শখ হলো চুলের ফ্যাশন করা। টোগোতে আমিও তাদের মতো করে চুল বেঁধেছি। চারজন মিলে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আমার পুরো চুলে বেণি করে দেয়। এই বেণি ৪ থেকে ৬ মাস রাখা যায়।
আমার বাবা ২০১০ সালে প্রয়াত হন। পরের বছর আমি মাকে সুইডেনে নিয়ে আসি। পড়াশোনা শেষে আমি সেখানে চাকরি করছিলাম। সেই সময়ে ছুটি নিয়ে টানা দুই মাস মাকে নিয়ে ইউরোপের দেশ ঘুরেছি। এই সফরের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি হলো মায়ের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা জয় করা। আমাদের দুজনের জমানো টাকা দিয়ে আমরা মাল্টা, ফিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, ইতালি, জার্মানিসহ অনেক দেশ ভ্রমণ করি। আমরা ট্রেনে করেই বলতে গেলে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়েছি। আর এই অবকাশে শোনা হয়েছে মায়ের ছেলেবেলার গল্প; যা আগে কখনোই শোনা হয়নি। এরই মাঝে দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখে বিমোহিত হয়েছেন মা। কখনো কখনো গুনগুন করে গেয়েও উঠেছেন।
সুইজারল্যান্ডের ইন্টারলাকেন থেকে আমরা রিভার ক্রুজে লুজান গেছি। আম্মাকে দেখে অনেকেই এসে আলাপ করেছেন। বোটে এক ভদ্রলোক এসে কথা বলেছেন। আফসোস করেছেন এভাবে তিনি তাঁর মাকে নিয়ে ঘুরতে না পারায়। আমাদের মা-মেয়ের সফর শেষ হয় আমেরিকা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। শিকাগো থেকে আমরা কানসাস গেছি এমট্রাক ট্রেনে করে। মাটির অনেক নিচে গিয়ে লবণের খনি দেখেছি। ওয়াশিংটনে মহাকাশ মিউজিয়ামে গিয়ে আমি আর মা চাঁদের মাটি ছুঁয়ে দেখেছি। ফেরার পরে মা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছেন, কেউ আমাকে সোনার টুকরো দিলেও এত খুশি হতাম না। তুমি আমাকে পৃথিবীর কিছু অপূর্ব সৌন্দর্য দেখিয়েছ।
এই ভ্রমণের পোকাটা আমাদের পারিবারিক। আমার দাদা আরবের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। বাবা সব সময় বলতেন, কারও ক্ষতি করবে না আর অসৎ হবে না। অন্যথায় তার ফল তুমি পৃথিবীতেই ভোগ করবে।
বাসে করে বুরকিনা ফাসো থেকে আইভরি কোস্টে যাওয়ার পথে আমি সারা রাত কোরআনের আয়াত শুনেছি। আমার সেই বাসজার্নি ছিল টানা ২৪ ঘণ্টার। একসময় মধ্যরাতে বাসের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আর কানে আসছে কোরআনের আয়াত। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। আর নিজে হয়ে উঠেছি আত্মবিশ্বাসী। একবার আমি জঙ্গলের মধ্যে ২৬ ঘণ্টা আটকে ছিলাম; সবাই ভয় পেয়েছিল। কারণ, আশপাশে কোনো আলো ছিল না; মোবাইলেও চার্জ ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ইতিবাচক চিন্তাই হয় আমার শক্তি। আর তা দিয়ে বিপৎসংকুল পরিস্থিতি আমি মোকাবিলা করি।
আমি আসলে একজন সাধারণ পর্যটক। একেবারে সাটামাটাভাবেই ঘুরে বেড়াই। তাতে করে মানুষ দেখা হয়। দেখা হয় জীবন, যাপন আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। ফলে নানা কিছুর মুখোমুখিও হতে হয়েছে বৈকি। কখনো নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে পৌঁছে হোটেলে ঘর পাইনি। আবার বর্ডার পার হতে না পেরে ইমিগ্রেশন অফিসের কোনো টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি। তবে হ্যাঁ, মানুষের অকুণ্ঠ সহায়তা পেয়েছি সর্বত্র।
চেষ্টা করেছি নিজেকে সুস্থ রাখার। পানি ছাড়া অন্য পানীয় পান করিনি। আর আমার মস্তিষ্ককে সব সময় সজাগ রেখেছি; যাতে আমার ক্ষতি কেউ করতে না পারে। আফ্রিকায় অনেক খাবার। কিন্তু নির্দিষ্ট করে ভালো খাবার বলতে যেটা বোঝায় তা ছিল না। তিন মাসের বেশি সময় ইয়াম (মেটেআলু) খেয়ে কাটিয়েছি। তবে রাস্তার খোলা খাবার খেতাম না।
ধুলাবালির জন্য একসময় আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। কাশি, পেট ব্যথা শুরু হয়। মরুভূমি ভ্রমণের সময়ও শরীর বেশ খারাপ হয়েছে। ওই সময়েই পথে এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমার অবস্থা দেখে সে আমাকে কোকো ফল খেতে দেয়। সে পরামর্শ দেয় এটা সঙ্গে রাখার। কারণ, এটা সামান্য খেলে শরীরের ব্যথা কমে। চাঙা ভাব অনুভূত হয়। আমি ফল পেয়েছি হাতেনাতে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আমার ব্যথা উপশম হয়েছে। ছেলেটি আমায় আরও জানিয়েছিল, তারা যেকোনো অসুখ-বিসুখে এটা খায়। এরপর থেকে ফলটি আমি আমার সঙ্গে রাখতাম। খারাপ লাগলেই একটু সামান্য খেয়ে নিতাম।
আফ্রিকানদের জীবন বেশ কষ্টকর। এক বেলা খেয়ে কাটাতে হয়। তা সত্ত্বেও তাদের বিপুল কর্মশক্তি। তারা আসলে রুটজাতীয় খাবার খায়। ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আমার শরীর বেশ খারাপ হয়। ৭ কেজি ওজন কমে যায়। সাহারা মরুভূমির নিচে যে দেশগুলো, সেখানে সাহারার ধুলা আর বালি সব সময় চলে আসে। এই বালি ভীষণই ধারালো। আমার এই সফল ছিল মূলত আফ্রিকায়। সেই গল্পই আপনাদের শোনানোর চেষ্টা করব ধারাবাহিকভাবে।
ছবি: লেখক