ট্রাভেলগ I ইয়াকসমের ইতিহাস মঞ্চে
তুষারশুভ্র পাহাড়শীর্ষের হাতছানি। পাইন বন আর উঁচু-নিচু পথের রোমান্স। সেখানে প্রশান্তিকর নির্জনতার গল্প শুনিয়েছেন শৌনক গুপ্ত
পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে ছুটে আসা গাড়ি দেখতে দেখতে চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ তন্দ্রা কাটতেই দেখি আমাদের জিপটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটানা অনেকক্ষণ চলার ঘড়ঘড়ানিতে শ্রবণেন্দ্রিয় অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর তা থেমে গেলেও যেন একটা শব্দ পাওয়া যায়। ঘোর কাটতে কিছু সময় লাগল। জিপ থেকে নেমে দেখলাম চারদিক কুয়াশার ফিনফিনে ওড়নায় মোড়া। মে মাসের শেষেও বেশ আরামদায়ক চোরা শীত। জায়গাটা নির্জন। আমরা পাহাড়ঘেরা এক মনোরম সবুজ উপত্যকায় এসে পড়েছি। একটু এগিয়ে রাস্তাটা একটা বাঁক ঘুরেই শেষ হয়ে গেছে। কাছাকাছির মধ্যে শুধু কিছু ইতস্তত ঘর আর দুটো দোকান। একটা অফিসঘরের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলছে ‘ইয়াকসম-ডুবদি গ্রাম পঞ্চায়েত’। বুঝলাম, অবশেষে পৌঁছে গেছি পশ্চিম সিকিমের ইতিহাস প্রসিদ্ধ গ্রাম ইয়াকসমে।
পেলিং থেকেই ড্রাইভার বিনোদ আমাদের গাইড। এই চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তায় আমরা তাকে কম জ্বালাতন করিনি। এখানে এসেও ‘ইয়াকসম’ মানে কী, ‘ডুবদি’ কী, জায়গাটা কত উঁচুতে— আমাদের একের পর এক প্রশ্নবাণে সে প্রায় দিশেহারা। সব উত্তর যথাসময়ে মেলার আশ্বাস দিয়ে হাসিমুখে সে আমাদের প্রথমেই একটা টিকিটঘরের সামনে নিয়ে এলো। ঘরের মাথায় লেখা ‘কাথক পোখরি’। টিকিট কেটে পাথর-বাঁধানো রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। দীর্ঘকায় পাইন বনের মধ্যে পথ। একসময় গাছের ফাঁক দিয়েই চোখে পড়ল নিটোল স্বচ্ছ জলের পুকুরটা। সাধারণ এক জলাশয়, কিন্তু তাকে ঘিরে প্রেয়ার ফ্লাগের আধিক্যই বলে দিচ্ছে সেটি কত পবিত্র। স্থির জলে বনের প্রতিচ্ছবি। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাক। বিনোদ জানাল, এই কাথক পোখরির গল্পের জন্য আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতেই হবে।
বাইরে এসে বড় রাস্তাটা পেরিয়ে এবার আমাদের পথ পঞ্চায়েত অফিসের পাশ দিয়ে। হালকা চড়াই, পাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে ভুট্টার ক্ষেত। মিনিট পাঁচেক হেঁটে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের একটা বোর্ডের সামনে এসে সেই পথ শেষ হলো। তাতে বড় করে লেখা ‘করোনেশন থ্রোন নরবুগাং’। এর নিচে সংক্ষেপে ইয়াকসমের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বর্ণনা। আরেকটা ছোট বোর্ড বলছে আমরা এখন সমুদ্রতল থেকে প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচুতে। বড় পাঁচিল ঘেরা এলাকাটায় ঢুকে পড়লাম। বড় বড় গাছ খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। সেগুলোর গায়ে নানা ধরনের অর্কিড। ডালপালার জট বাইরের আলো প্রায় ঢুকতে দেয় না বলেই হয়তো চারপাশ একটু স্যাঁতসেঁতে। স্থানে স্থানে সুন্দর ফুলের বাগান। প্রেয়ার-ফ্লাগ আর তিব্বতি স্কার্ফ বা ‘খাদা’য় সাজিয়ে রাখা হয়েছে গোটা এলাকা। জায়গাটা যেন বড়ই নিঃসঙ্গ। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই তখন। ছোট একটা মনাস্টরি পেরিয়ে আমরা এসে পড়লাম পাঁচিলঘেরা চত্বরের ঠিক মাঝ বরাবর। এখানে একটা প্রশস্ত চাতাল। এটাই সিকিম রাজতন্ত্রের ‘আঁতুড়ঘর’।
চাতালের উপর সবাই গোল হয়ে বসেছি। আমাদের এক পাশে বিশাল এক পাইনগাছের তলায় একটা চওড়া পাথরের সিংহাসন। সেখানে পাশাপাশি চারটি বসার জায়গা। তার ঠিক মুখোমুখি, চাতালের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে উঁচু সাদা এক চোরতেন। সিংহাসনের সামনে একটা লন্ঠন রাখা। বোর্ডে লেখা ইতিহাস গুনগুন করতে শুরু করেছে মনের মধ্যে। কানে যেন দূর থেকে ভেসে আসছে বিনোদের কথা। লন্ঠনের শিখা হিপনোটাইজ করতে করতে আমাদের নিয়ে এলো ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে। এসে পড়লাম প্রাচীন তিব্বতের একেবারে দক্ষিণ অংশে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে চাতালের এক পাশজুড়ে। প্রত্যেকের হাতে পাথরের পাত্রে কিছুটা করে মাটি আর জল। এই মাটি ও জল এসেছে প্রস্তাবিত সিকিম রাজ্যের সমস্ত গ্রাম থেকে। সেগুলো একত্র করে রাখা হলো এক বেদির উপর। এখানেই তৈরি হবে সুবিশাল নরবুগাং চোরতেন। একসময় বেজে উঠল শিঙা। সন্ন্যাসীরা সবাই এসে দাঁড়ালেন চাতালের ওপর। তিন বৌদ্ধ লামা উঠে আসছেন পাহাড় বেয়ে। তাদের পরনে লালচে গেরুয়া পোশাক। গায়ে হলুদ উত্তরীয়, মাথায় একই রঙের উঁচু টুপি। সর্বাগ্রে আসছেন উত্তর দিক থেকে আগত নিংমাপা গোষ্ঠীর লামা লাতসুন চেম্বো। উপস্থিত অভ্যাগতদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ। তাঁর হাতের একটা ধাতুর পাত্রে স্বচ্ছ জল। এই পবিত্র জল তিনি নিজে হাতে তুলে এনেছেন নিচের কাথক পোখরি থেকে। তাঁকে অনুসরণ করছেন যথাক্রমে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে আগত কার্তকপা লামা শেম্পা চেম্বো এবং রিগজিং চেম্বো। তিন লামার পেছনে করজোড়ে চলেছেন এক যুবক, পরনে রাজবেশ। তিনি ফুন্টসোগ নামগিয়াল, এসেছেন পূর্ব দিক থেকে।
পাথরের সিংহাসনটি সাজানো হয়েছে তিব্বতি মন্ত্র লেখা নানা রঙের কাপড়ে। খাদায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে পাইনগাছের শরীর। সিংহাসনের মধ্যে সবচেয়ে বড় আসনের সামনে এসে দাঁড়ালেন লাতসুন চেম্বো। ফুন্টসোগকে বসালেন নিজের ডান পাশে, প্রান্তিক আসনে। তাঁর বাম পাশের আসন দুটোর সামনে দাঁড়ালেন বাকি দুজন লামা। উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে আকাশের গায়ে বিরাজ করছে সেই সুদীর্ঘ তুষার-শৃঙ্গরাজি। শ্বেতবস্ত্রে সুশোভিত ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং যেন অনন্ত শয়ানে নিদ্রামগ্ন। মহান লামা সেই দিকে জলের পাত্র তুলে ধরে উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন বৌদ্ধ মন্ত্র। বাকিরা যোগ দিলেন তাতে। তারপর তিন লামা একত্রে সেই পবিত্র জল অল্প অল্প করে সেঁচে দিতে লাগলেন ফুন্টসোগের মাথায়। অভিষেক হলো সিকিম রাজ্যের প্রথম চোগিয়াল বা রাজার। সন্ন্যাসীরা জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। বিভোর হয়ে দেখছিলাম সেই দৃশ্য। শিঙার নিনাদ আর হর্ষধ্বনি ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছিল। তেল শেষ হয়ে লন্ঠনের আলো নিভতেই ফিরে এলাম একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবে। আমরা কটা মানুষ ছাড়া কেউ নেই। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পড়ে রয়েছে শুধু পাইনগাছ, করোনেশন সিংহাসন আর নরবুগাং চোরতেন। আর রয়েছে ‘ইয়াকসম’ নামটা, যার অর্থ ‘তিন লামার মিলনস্থল’। রাজ্যাভিষেকের পর ফুন্টসোগ চোগিয়াল এই ইয়াকসমেই স্থাপন করেন রাজকীয় সিকিমের প্রথম রাজধানী ‘তাসি থেঙ্কা’। জনশ্রুতি অনুসারে এখানেই ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে সিকিমের প্রাচীনতম বৌদ্ধ গুম্ফা ডুবদি মনাস্টারির পত্তন করা হয়।
বেলা পড়ে আসছে। পেলিং ফিরতে সন্ধ্যা নামছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফিরে চলেছি গাড়ির দিকে। জনমানবশূন্য পথে সঙ্গী শুধু আমাদেরই জুতার শব্দ। শুনেছি এই ইয়াকসম থেকেই হাঁটা পথে জোংরিতে চলে যাওয়া যায়, একেবারে কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছাকাছি। আমরা যখন গাড়ির রাস্তায় প্রায় পৌঁছে গেছি, দেখি এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধীরপায়ে উঠে আসছেন। তিনি দীর্ঘদেহী, শান্ত সমাহিত মুখ। আমার মনে হলো, তিনি যেন বহুদূর থেকে আসছেন। সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার পায়ের কাছ থেকে। নিঃশব্দে পার হয়ে গেলেন আমাদের। হয়তো এখন একাকী তিনি নীরবে গিয়ে বসবেন সিংহাসনের পাশটায়। দিনের আলো নিভে এলে নিজে হাতে জ্বেলে দেবেন সেই লন্ঠন। আবারও বাঙ্ময় হয়ে উঠবে সিকিমরাজের গৌরবগাথা।
shounakgupta007@gmail.com
ছবি: লেখক