skip to Main Content

ফিচার I বাংলায় স্মার্টহোম

উন্নত বিশ্বে স্মার্টহোম প্রযুক্তি হিসেবে বেশ জনপ্রিয় গুগল হোম বা আমাজনের অ্যালেক্সা। ঘরের ফ্যান, বাতি, টিভি বা যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই প্রযুক্তি। মৌখিক আদেশেই। তবে বলতে হবে ইংরেজিতে। একই প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ‘জিনি’। বাংলাতেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। দেশের চার তরুণের উদ্ভাবিত এই স্মার্টহোম প্রযুক্তি নিয়ে লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম তুষার

দেশীয় স্মার্টহোম প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে জিনি আইওটি। আপনার ঘরের ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো হতে হবে না স্মার্ট। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট কিংবা অ্যালেক্সার মতো ‘জিনি’ও মৌখিক আদেশে কাজ করে। এর মাধ্যমে যেকোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালু বা বন্ধ করতে পারবেন।
সারা দিনের নানা রকম ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করে ঘরে ঢুকলেন। উঠে গিয়ে যে লাইট, ফ্যান চালু করবেন সে শক্তিও নেই। বাংলায় আদেশ করলেন, ‘ড্রইংরুমের লাইট আর ফ্যানটা চালাও তো জিনি।’ সঙ্গে সঙ্গে ঘরে জ্বলে উঠল বাতি আর ঘুরতে থাকল পাখা। জাদু মনে হলেও এমন এক ডিভাইস নিয়ে কাজ করছে ‘জিনি আইওটি’। আর এটার পেছনে আছেন চার তরুণ— সাদমান শাহেদ চৌধুরী, আতিয়ার তালুকদার, নূর আল দীন আহমেদ ও হাফিজুর রহমান হিমেল।
ভাবনা এলো যেভাবে
ছোটবেলা থেকে বাবার বকা শুনতেন সাদমান শাহেদ চৌধুরী। নিজের কামরার লাইট, ফ্যান চালু করে চলে যেতেন অন্য কামরায়। বিদ্যুৎ অপচয়ের কারণে বাবার বকা তার যৌক্তিক মনে হয়েছিল। প্রায় সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে লাইট, ফ্যানের সুইচ নিভিয়ে আসতেন। তখন থেকে তার মনে হতো, ইশ্, রুমে না গিয়ে যদি লাইট-ফ্যান অফ করা যেত! নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চতুর্থ বছরে এসে শিক্ষাবিদের আট মাসের একটা প্রজেক্ট করতে হয়। এ সময় প্রজেক্টের বিষয় হিসেবে সাদমান বেছে নেন এমন একটি অ্যাপ, যা দিয়ে বাংলায় আদেশ করে ফেসবুক বা ইউটিউব অন কিংবা অফ করা যাবে। এতে সঙ্গী হিসেবে পান একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আতিয়ার তালুকদারকে। দুজনে মিলে প্রজেক্টটি করেন। সেটি উপস্থাপনের সময় এই দুজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎ পান। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের শিক্ষার্থী নূর আল দীন আহমেদ। তার প্রজেক্ট ছিল স্মার্টফোনের সাহায্যে বাসার লাইট ও ফ্যান অন-অফ করা। প্রজেক্ট শেষে উপস্থিত এক শিক্ষক বলেছিলেন, দুটো প্রজেক্টকে একসঙ্গে করতে পারলে চমৎকার কিছু একটা করতে পারবে তোমরা। তখন তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। কাজটি ভালোভাবে শেষ করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ মিলবে— এমন ভাবনাই ছিল তাদের। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তাদের প্রজেক্ট শেষ হয়। এর কয়েক দিন পর হঠাৎ করে আতিয়ারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় নূরের। আলাপের এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ (আইওটি) নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তারা প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান হিমেল।
আইওটি কী
আইওটির পূর্ণ নাম ‘ইন্টারনেট অব থিংস’। ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করার নেটওয়ার্ককে ‘আইওটি’ বলা হয়ে থাকে। একইভাবে ইলেকট্রনিক সামগ্রী যেমন লাইট, ফ্যান, এসি, গিজার, ফ্রিজ, হটার, পানির ট্যাংক প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ জন্য স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী উভয়কেই ইন্টারনেট সংযোগের আওতাভুক্ত থাকতে হয়। এতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অবস্থান করে নিজের স্মার্টফোনের সঙ্গে যুক্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্র সচল আছে কি না দেখা যায়, পাশাপাশি চালু ও বন্ধ করা যায়। ফ্যান বা এসিকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
জিনি আইওটি
চেরাগে থাকা দৈত্যকে আলাদিন যা হুকুম করত, তা-ই সে করত। তারা ভাবলেন, এমন একটি ডিভাইস বানাবেন, তাদের কথামতো আদেশ পালন করবে। সেই ভাবনা থেকে তারা প্রতিষ্ঠানটির নাম দিলেন জিনি আইওটি। কারওয়ান বাজারের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের বাংলালিংক আইটি ইনকিউবেটর ২.০ ব্যাচের একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এটি। জিনি আইওটি পরিচালিত হচ্ছে স্ব-অর্থায়নে। অর্থাৎ গবেষণা ও পণ্য তৈরির যাবতীয় খরচ নিজেরাই বহন করছে ‘জিনি আইওটি’। তবে বাংলালিংক ইনকিউবেটর ২.০ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ায় সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে বিনা ভাড়ায় অফিস পেয়েছেন তারা।
যেভাবে কাজ করে
বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ডের পাশে আলাদা করে জিনি বক্স বসানো হয়। একটি জিনি বক্স দিয়ে সংশ্লিষ্ট সুইচ বোর্ডের একটি ফ্যান ও তিনটি লাইট নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রথমে সুইচ বোর্ডের সঙ্গে জিনি বক্সের সংযোগ ঘটাতে হয়। তারপর জিনি বক্সে অ্যানড্রয়েড অ্যাপের সংযোগ করতে হয়। ওয়াই-ফাই সংযোগেও এটি কাজ করে। অ্যানড্রয়েড অ্যাপ ও জিনি বক্স উভয়কেই একই ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকতে হয়। অ্যানড্রয়েড অ্যাপ চালু করে সেখানে বাংলায় আদেশ করলে তা ওয়াই-ফাই সংযোগের মাধ্যমে প্রথমে জিনি বক্সে যায়। এরপর সেই আদেশ অনুসারে কাজ করে জিনি বক্স। বাংলা ভাষা ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে জিনি আইওটির চিফ অপারেশন অফিসার সাদমান শাহেদ চৌধুরী জানান, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট অথবা অ্যাপলের সিরি ইংরেজি ভাষায় আদেশ শুনে সে কাজ করে। আমরা চেয়েছি, আমাদের প্রযুক্তির সক্ষমতা নিজেদের ভাষায় ব্যবহার করে একটি আইওটি ডিভাইস তৈরি হোক। সে অনুসারে আমরা বাংলা ভাষায় আদেশ করে এমন একটি ডিভাইস তৈরি করেছি। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট কিংবা অ্যালেক্সার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে জিনি অন্যান্য ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো প্রত্যুত্তর দিতে পারে না। তবে আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে পারে। গত এক বছরে জিনি বক্সকে একটি সুদৃশ্য আকারে রূপান্তর করা হয়েছে। পণ্যটির প্রারম্ভিক মূল্য ধরা হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। জিনি বক্সের সুবিধা পাওয়ার জন্য আলাদা কোনো স্মার্ট লাইট, ফ্যান ব্যবহার করতে হবে না। www.genie-iot.com এই ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করে এটি সংগ্রহ করা যাবে। এখন আপাতত জিনি বক্স দিয়ে লাইট ও ফ্যান নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভবিষ্যতে এসি, গিজার ও পানির মোটরও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পাশাপাশি টাইমার সেট বা চালু কিংবা বন্ধের জন্য সময়ও বেঁধে দেওয়া যাবে। এটি ইন্টারনেট ছাড়াও ঘরের বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু ওয়াই-ফাই থাকতে হবে। আর ওয়াই-ফাই রাউটারের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে এটি কতটা দূরত্ব থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জিনি আইওটির সিইও আতিয়ার তালুকদার বলেন, বর্তমানে আমাদের অ্যাপ এবং জিনি বক্সকে একই ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মধ্যে থেকে কাজ করছে। ভবিষ্যতে ভিন্ন ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক ও মোবাইল ডেটার সাহায্যে কাজ করবে এ জিনি বক্স। সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এটি একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের একটি মাধ্যম হওয়ায় আমাদের প্রকল্পটি সুধীসমাজে প্রশংসিত হয়েছে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top