ফিচার I বই-কফির মিলনস্থলে
ইট-কাঠ-পাথরের এই অরণ্যে নিজের মতো করে সময় কাটানোর জায়গার বড্ড অভাব। কিন্তু কেমন হয় যদি অফিসফেরত সন্ধ্যায় বা নিতান্তই অলস বিকেলে আপনার সঙ্গী হয় প্রিয় কোনো বই আর কফির উষ্ণতা? কফি আর বই— এক চিরন্তন যুগলবন্দি; বইপ্রেমীদের কাছে এর আবেদন পুরোনো হয় না কখনোই। আবহমান এই আনন্দের কথা ভেবেই গত দুই বছরে শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য বুক ক্যাফে। সেগুলোর কথা শোনাচ্ছেন তাবাসসুম ইসলাম সুষমী
বেঙ্গল বই
‘বইয়ের মাঝে ডুব’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০১৭ সালে লালমাটিয়ায় যাত্রা শুরু করে বেঙ্গল বই। চারতলা দুটি ভবন আর বাইরে এক চিলতে উঠোন— এ নিয়ে বেঙ্গল বইয়ের আয়োজন। ঠিক গতানুগতিক বইয়ের দোকান নয়; আবার শুধু খাবারে ঠাসা রেস্তোরাঁর আবহও নয়, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এ জায়গা সাজানো হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। প্রতিটি তলার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। একতলা হলো ‘বৈঠকখানা’। এখানে রয়েছে বসবার দারুণ আয়োজন; চাইলেই চা-কফি-শিঙাড়া-সমুচা সহযোগে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবেন কিছুটা সময়। আবার পুরোনো বইয়ের শেলফ থেকে বেছে নিতে পারেন কোনো বইও, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে করে নিতে পারেন বিকেলের নাশতাও। পছন্দ হলে এখান থেকে বই নিয়ে যাওয়া যাবে; তবে এর একটা বিনিময়মূল্য রয়েছে। অবশ্য অর্থে নয়, বরং নিজের সংগ্রহ থেকে দুটি বই এখানে দিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া এখানে প্রায়ই আয়োজিত হয় নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান, সাহিত্য সভা, কবিতাপাঠের আসর। ছুটির দিনে সকালে থাকে নাশতার আয়োজন, বসে বহু প্রাণের মিলনমেলা। একতলায় আরও নজর কাড়ে লোহার পাত দিয়ে করা বইয়ের পাতার আদলে তৈরি দেয়ালসজ্জা। দেয়াল বেয়ে ওঠা সবুজ লতা আর আলোর খেলাও বেশ মন কেড়ে নেয়। পুরো ভবনেই রয়েছে বড় বড় কাচের জানালা যা সবুজের প্রশান্তি দেয় দৃষ্টিজুড়ে। বই পড়বার সুবিধার পাশাপাশি নাগরিক স্থাপত্যে সবুজের ছোঁয়ার এমন সুন্দর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বেঙ্গল বইয়ের নকশা করেছেন স্থপতি তাহমিদা আফরোজ। এবার ঘুরে আসা যাক ওপর তলার আয়োজন। নিচের তলায় ব্যাগ জমা দিয়ে উঠতে হয় উপরে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে দেখা মেলে চমৎকার কিছু পেইন্টিংয়ের, তবে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য লিফটের ব্যবস্থাও রয়েছে। দোতলায় ফিকশন, মুক্তিযুদ্ধ, কবিতা, ইতিহাস, স্থাপত্য, রন্ধনশৈলীসহ নানা বিষয়ে ভাগ করে সাজানো আছে বই। রয়েছে বসবার দারুণ আয়োজন। কেউ কেউ বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে আছেন চেয়ার-টেবিলে বসে, কেউবা বই নিয়ে বসে গেছেন মেঝেতেই। মগ্ন হয়ে বই পড়বার দারুণ এ দৃশ্য দেখবার মধ্যেও যেন আছে এক অদ্ভুত প্রশান্তি! ‘বইয়ের হাট’ নামটি পূর্ণতা পেয়েছে এখানে। সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সপ্তাহের প্রতিদিনই বই পড়া যায়। এখানে বসে বই পড়তে চাইলে কাউন্টারে গিয়ে নাম ও ফোন নাম্বার বলে টোকেন নিতে হয় আর পড়া শেষে বই ফেরত দিতে হয় কাউন্টারেই। এ ছাড়া বই কিনতে পারবেন এখান থেকে। দোতলার এক পাশে রয়েছে কফিশপ, চাইলে বারান্দায় বসে কফি খেতে পারবেন। কফির সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিতে পারেন স্যান্ডউইচ কিংবা কাপকেক। এবার তিনতলায় উঠবার পালা। সিঁড়ি থেকেই শুরু হয় মুগ্ধতা। খোপ খোপ দেয়ালে আলোর খেলা আর তাতে সাজিয়ে রাখা মাটির হাতি-ঘোড়া-বাহারি দোয়েল— আরও কত কী! সিঁড়ি শেষ হতেই ‘আকাশকুসুম’ নামে এক অসাধারণ কল্পরাজ্য। ঠাকুমার ঝুলি থেকে শুরু করে হ্যারি পটার— কী নেই। মহানন্দে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট্ট রাজকুমার আর রাজকন্যারা। কেউ আবার রঙিন চেয়ার-টেবিলে বসে গম্ভীর মুখে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। তিনতলার এক পাশে রয়েছে স্টেশনারি শপ। বাহারি কলম-পেনসিল-নোটবুকের জগতে ছোট-বড় সবাই ভিড় জমায়। সম্প্রতি বেঙ্গল বইতে যুক্ত হয়েছে নতুন সংযোজন, চিলেকোঠা। খোলা ছাদের ওপর বিকেল চারটার পর থেকে পাওয়া যায় কাবাব-পরোটা-নান। এ ছাড়া কমিক বুক কর্নারও রয়েছে চারতলায়। পড়তে চাইলে অবশ্য এক বছরের জন্য সদস্য হতে হবে আপনাকে। সদস্য ফি এক হাজার টাকা এবং বছর শেষে এ টাকা ফেরত দেওয়া হবে। বেঙ্গল বইয়ের নানা আয়োজন ক্রমেই পাচ্ছে জনপ্রিয়তা, প্রতিদিন এখানে ভিড় জমে। শিশু, তরুণ, বয়স্ক, কর্মজীবী, ছাত্র, গৃহিণী— সবার জন্যই প্রশান্তির অপর নাম হয়ে উঠছে বেঙ্গল বই।
বাতিঘর
চট্টগ্রামের বাতিঘর বহুদিন ধরে দেশের বইপ্রেমীদের কাছে এক প্রিয় নাম। ২০১৭ সালের শেষ দিকে রাজধানীতে বাতিঘরের আগমন ঢাকার বইপ্রেমীদের মধ্যে সাড়া জাগায়। না, নিরাশ হননি কেউ। বরং অনেকেই বলেন অন্য যেকোনো বুক ক্যাফের তুলনায় বাতিঘরের সংগ্রহ বেশি। পরিসংখ্যানও তাই বলে। এক লাখ বই নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অষ্টম তলায় উপস্থিতি বাতিঘরের। ক্যাটাগরি অনুযায়ী এখানে সাজানো হয়েছে বই। ফিকশন, ইতিহাস, নন-ফিকশন তো বটেই, বাদ যায়নি নাট্যকলা, সিনেমা, স্থাপত্যশিল্পবিষয়ক বইও। রয়েছে শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার; কাচ ও খোদাই করা কাঠ দিয়ে সাজানো এই অংশ আলাদা প্রশংসার দাবিদার। অবশ্য বাতিঘরের পুরো সজ্জাশৈলীই অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। লাল ইটের দেয়াল এবং মোগল সাম্রাজ্যের বিখ্যাত স্থাপত্য লালবাগ কেল্লার আদলে সাজানো প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের পুরো ফ্লোর। ভেতরে রয়েছে ছোট্ট একটি মঞ্চ, যেখানে প্রায়ই আয়োজিত হয় সাহিত্য আলোচনা। মঞ্চটির অভ্যন্তরীণ সজ্জায় রয়েছে পরীবিবির মাজারের আদল। এখানে থাকা চেয়ারগুলোও তৈরি মোগল রীতি অনুসারে। সেলস কর্নারটি মনে করিয়ে দেয় ফতেহপুর সিক্রির কথা, যেখানে বসে গান করতেন সংগীতজ্ঞ তানসেন। বাতিঘরের বারান্দায় বসে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত যেকোনো বই পড়তে পারবেন আপনি। সঙ্গে রয়েছে চা-কফি পানের সুযোগ। চাইলে এখান থেকে কিনতেও পারবেন বই।
দীপনপুর
ঝাঁ-চকচকে স্থাপত্যের বাড়াবাড়ি মিলবে না এখানে; নেই ভীষণ ফ্যান্সি চা-কফির বাহারও। তবে শহুরে কোলাহলের মধ্যে বই-অনুসারীদের জন্য এক টুকরো মুক্ত আকাশের ঠিকানা হয়ে উঠেছে ‘দীপনপুর’। অসংখ্য বইয়ের সমাহার এখানে, সাজিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাটাগরি মেনে। লেখকের নাম অনুযায়ীও ভাগ করা হয়েছে বইয়ের তাক। পছন্দমতো বই কেনার সঙ্গে রয়েছে বসে পড়বার সুযোগ। পর্যাপ্ত আসন ছড়িয়ে রাখা হয়েছে দীপনপুরজুড়ে। সেই সঙ্গে আছে ক্যাফে, যেখানে স্বল্পমূল্যেই মিলবে নানা রকম খাবার, চা-কফি কিংবা হালকা স্ন্যাকস। এ ছাড়া আছে ‘দীপনতলা’ নামের একটি মঞ্চ, যেখানে প্রায়ই বসে গান কিংবা কবিতার আড্ডা। নয়তো কোনো সাহিত্য-সেমিনার। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা একটি অংশ ‘দীপান্তর’, যেখানে খেলতে খেলতে বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। দীপনপুর শুধু একটি বুক ক্যাফে নয়, এর উদ্যোক্তার স্বপ্ন একে এমন করে গড়ে তোলা, স্থানটি যেন লেখক-পাঠকের মিলনস্থল হয়ে ওঠে; দেশ ও সমাজ বদলে দেওয়ার ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করবার জায়গা হয়ে ওঠে। দীপনের নানা স্মৃতিসামগ্রী সাজিয়ে রাখার মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে এখানে।
নার্ডি বিন কফি হাউজ
ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডের আহমেদ অ্যান্ড কাজী টাওয়ারের নিচতলার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মনে হয় টাইমমেশিনে করে চলে এসেছি বহুকাল আগে। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের চেয়ার-টেবিল-সোফা দেখে অমন মনে হয়, নাকি বেসমেন্টের দেয়ালের আলো-আঁধারি এর কারণ— কে জানে! তবে বইপ্রেমীদের চোখে নিশ্চয়ই প্রথমে পড়বে চারদিক ঘিরে থাকা বইয়ের শেলফগুলো। দেশি-বিদেশি প্রায় ৯০০ বই রয়েছে এ কফিশপে। চাইলেই এখানে বসে স্কাউটের সঙ্গে ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’-এর পাতায় ডুব দিতে পারেন, কিংবা যদি ফিরে যেতে চান কৈশোরের মুগ্ধতায়, তবে নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নিন শঙ্কু সমগ্র। পুরো কফিশপে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে বই পড়া নিয়ে নানা উৎসাহব্যঞ্জক উক্তি। এমনকি ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ড জানতে চাইলে পূর্ণ আন্তরিকতায় ওয়েটার আপনাকে বলবেন ‘রিড আ বুক ইন্সটেড’ কিংবা ‘লেটস রিড আ বুক নাউ’। পাসওয়ার্ডের শব্দবিন্যাস দিয়েও কফিশপটি যেন বলছে আজ বই পড়বার দিন। ২০১৭ সালে মাসরু হাসান কমল ও ফারিয়া মেহজাবিনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ‘নার্ডি বিন কফি হাউজ’। মাসরু হাসান কমল এমবিএ করেছেন যুক্তরাজ্যে। সেখান থেকেই ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের সাজসজ্জার প্রতি তার ভালো লাগার শুরু। তাই নিজের একটি কফিশপের স্বপ্ন মাথায় এলে তাতে আনতে চেয়েছেন ভিক্টোরিয়ান আবহ। আত্মীয় ও বন্ধু ইন্টেরিয়র ডিজাইনার বাপন আহমেদকে আড্ডাচ্ছলে এই চাওয়ার কথা বলেন তিনি। বাপন ইন্টেরিয়র ডিজাইনিংকে পেশা হিসেবে না নিলেও নিজের বন্ধু বা আত্মীয়দের পাশে থাকেন সব সময়। তাই খুঁটিনাটি সবকিছুর দিকে খেয়াল রেখে, প্রাচীন লন্ডনের চিরায়ত এক আবহে সাজিয়েছেন ‘নার্ডি বিন কফি হাউজ’। এবার আসা যাক কফির কড়চায়। অ্যামেরিকানো-ক্যাপুচিনো-ল্যাটে-মোকা সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ রকম কফি তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে আছে হট চকলেট ও নানা স্বাদের স্মুদি। কফির অনুষঙ্গ হিসেবে স্যান্ডউইচ, নানা পুরে ভরপুর পাফ ও বিভিন্ন ফ্লেভারের ব্রাউনির দেখাও মিলবে নার্ডি বিনের মেনুতে। এ ছাড়া সকালে রয়েছে ইংলিশ ব্রেকফাস্টের আয়োজন, যা ব্যস্ততার কিংবা ছুটির দিনের আলস্যে খানিকটা বৈচিত্র্য এনে দেবে নিশ্চিত।
গত দুই বছরে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বুক ক্যাফে। অর্থাৎ বাড়ছে প্রতিযোগিতা। তবু রোজ বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় মুখর হয়ে ওঠে নার্ডি বিন। কেউ একাই বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতা ওল্টান, কেউ মেতে ওঠেন প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায়। কিছু কিছু টেবিলে প্রয়োজনীয় বই থেকে নোট নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। বইপ্রেমীদের সুবিধার্থে সম্প্রতি নার্ডি বিনে চালু হয়েছে বই ধার নেবার সুবিধাও। এখান থেকে বই নিয়ে সর্বোচ্চ সাত দিন নিজের কাছে রাখা যায়। অবশ্য এ জন্য কোনো দর্শনী লাগবে না।
বিশ্বের প্রথম বুক ক্যাফের যাত্রা শুরু হয় কোথায়, এ নিয়ে রয়েছে বহু তর্ক-বিতর্ক। অন্তর্জালে ফ্রান্সের এক সাজানো-গোছানো রাস্তায় মার্সি ইউজড বুক ক্যাফে দেখে বহুদিন ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাচ্ছেন যে বইপ্রেমীর দল, তারা কিন্তু একবার ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন রাজধানীর এই বুক ক্যাফেগুলোর যেকোনো একটিতে।
ছবি: অংকুর রায়