ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I মস্কোর ফ্যাশন উইকে
বাংলাদেশের তো বটেই, এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এবার রাশিয়ার মার্সিডিজ-বেঞ্জ ফ্যাশন উইকে অংশ নিয়েছেন তরুণ ডিজাইনার রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা। উপস্থাপন করেছেন নিজের সৃষ্টিসম্ভার। সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন আমাদের সঙ্গে
পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন উইক মার্সিডিজ-বেঞ্জ ফ্যাশন উইক রাশিয়া। এ বছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয়েছে এর ষোড়শ আসর। এবারের আয়োজন অন্য রকম। এই প্রথম আয়োজকেরা ইন্টারন্যাশনাল ইয়াং ফ্যাশন ডিজাইনারদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন। তারা এমন সব ডিজাইনারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বা মনোনীত করেছে, যারা ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ফ্যাশনে ভূমিকা রাখতে পারবেন। এ জন্য মোট ছয়জন ডিজাইনারকে এবারের আসরে তাদের সংগ্রহ উপস্থাপনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এরা এসেছিলেন ইতালি, জর্জিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, পেরু ও বাংলাদেশ থেকে। পুরো এশিয়ার মধ্যে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই ছয়জনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলাম আমি। বিশাল এই মঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। প্রদর্শিত তিনটি কালেকশনেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি বাংলাদেশি ফ্যাশনের নতুন ধারাকে। বাণিজ্যিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজ দেশের ফ্যাশন ট্রেন্ডকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। সামাজিক এবং টেকসই দিকও তাতে সমন্বিত করার তাগিদ ছিল।
তিনটি কালেকশনের বিষয় ছিল ‘গাজির পট’, ‘রিমেম্বার মিনা’, ‘জুট মাত্রিউজ’। আশির দশকের পটুয়াদের কাজ আমি তুলে ধরেছি পোশাক-ক্যানভাসে। মীনা-রাজু-মিঠু ত্রয়ীর কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলবেন না। নব্বই দশকের শিশুদের কাছে এই তিন চরিত্র ছিল স্বপ্নের মতোই। সেই শিশুরা এখন তরুণ। কিন্তু ভুলে যায়নি তাদের ছেলেবেলা। মীনা ফিকশনাল চরিত্র হয়েও এই উপমহাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সুস্থতার বার্তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। চরিত্রটির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। সঙ্গে ছিল ইউনিসেফ। আর্ট ডিরেকশনের দিকে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, গোলাপি টপস আর লাল স্কার্টে খুবই সাধারণ থেকে মীনা হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসী মেয়ের প্রতিকৃতি। মীনা আমাদের শিখিয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতা। একই সঙ্গে সে বাঙালি নারীর প্রতীক। তার পোশাকে গোলাপি রঙে প্রতীয়মান কোমলতা, স্নেহ, দায়িত্বশীলতা ও মমতাপূর্ণ আবেগ। আর রঙটি বাচ্চাদের খুবই পছন্দ। লাল রঙ সাহসী মনোভাবের দ্যোতক। মীনা একই সঙ্গে কোমল ও সাহসী নারীর পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে আজীবন। ফ্যাশনে যুক্ত হয়ে নতুন মাত্রার জন্ম দিয়েছে সে। মীনা থিমের প্রবেশ তাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে, সেটাই স্বাভাবিক। যদিও কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে কাজটা খুব সহজ ছিল না। মীনার সারল্য ও সাদামাটা ভাবটাকে একালের রঙের সঙ্গে মেলানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। মীনা থিমে আমার উপজীব্য ছিল চরিত্র ছাপিয়ে একক নারীর প্রতীক ফুটিয়ে তোলা, বিভিন্ন রঙের কম্বিনেশনের মাধ্যমে। সে জন্য ব্যবহার করেছি কালো বেজ এবং বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের সুষম বণ্টন, যেকোনো অনুষ্ঠানের সঙ্গে দারুণভাবে যাকে খাপ খাওয়ানো যায়। গ্রামীণ ধারা অপরিবর্তিত রেখে ফ্যাশন ডিজাইন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং বটে। আমার ডিজাইনে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী কাঁথা সেলাইয়ের বুনন ব্যবহার নজর কেড়েছে। আধুনিকতার সঙ্গে সামান্য সেলাইয়ের উপস্থিতি নিয়ে যাবে মধুর রোমান্টিক অতীতে। প্রকৃতিপ্রেমিক রোমান্টিক সত্তাকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। মীনা থিম শুধু ভিজ্যুয়াল শান্তি বা নতুন কিছু করার প্রণোদনা থেকে আসেনি। এসেছে বাংলাদেশের বুননপ্রক্রিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার তাগিদ থেকে। আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, ফ্যাশন আরাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি তুলে ধরে একটি দেশের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে। কাল্পনিক চরিত্র হলেও মীনা এ দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করেছে। সেই রোল মডেল মীনাকে মেইনস্ট্রিম ফ্যাশনের ধারায় তুলে এনে বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে এই থিম নিয়ে কাজ করা হয়েছে।
জুট মাত্রিউজে বাংলাদেশি কাঠের পুতুল এবং রাশিয়ান মাত্রস্কা পুতুল নিয়ে কাজ করা হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। এই ড্রেসগুলোর প্রেরণা ছিল ফেমিনিজম। নারী আজ অনেক এগিয়েছে, আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, পরনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসেছে—এসবই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কালেকশনে।
সম্পূর্ণ কালেকশন তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের টেকসই কাপড় বা সাসটেইনেবল ফেব্রিক সিল্ক ও খাদিতে। বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি সচেতনভাবে মাথায় রাখা হয়েছে। এই কালেকশন উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কাপড় এবং বয়ন-ঐতিহ্যকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা আমি করেছি।
রাশিয়া ফ্যাশন উইকের অভিজ্ঞতা ছিল অনন্য। মিউজিক, মেকআপ থেকে ব্যাকস্টেজ—সবকিছুতেই ছিল সৃজনশীলতার ছোঁয়া। আমার কালেকশন উপস্থাপনার পর অনেকের নানা কৌতূহল আর প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। তাদের জানাই ছিল না, বাংলাদেশেও এমন কাজ সম্ভব! কাপড়, রঙ, মোটিফ, কালেকশনের থিম তাদের বিস্মিত করেছে। দেশকে এইভাবে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে পারার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বাকি পাঁচজন অংশগ্রহণকারীর কাজও ছিল দারুণ। কেউবা কাজ করেছেন রিসাইকেল ডেনিম বা ফিমেল বডি শেপের ওপর ট্রান্সপারেন্ট ড্রেস নিয়ে, কেউ কেউ তার পুরো কাজে ফিমেল ফ্যাশন ও ট্রেন্ডকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কেউ আবার গার্মেন্ট ম্যানুপুলেশন নিয়েও কাজ করেছেন। এই অনুষ্ঠান শুধু ফ্যাশন শো নিয়েই ছিল না, আমরা সবাই রাশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। একে অন্যের ট্র্যাডিশনকে জানার পাশাপাশি নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগও পেয়েছি।
আমি বিশ্বাস করি, নিজের শিকড়কে বাদ দিয়ে জীবনে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। তাই সব সময় চেষ্টা করি আমার কাজের মাধ্যমে নিজ দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে তুলে ধরতে।
এবারের মার্সিডিজ-বেঞ্জ ফ্যাশন উইক অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩০ এপ্রিল থেকে ৩ মে। অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অন্তত ২০০ ফ্যাশন ডিজাইনার। রাশিয়ার ডিজাইনারদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডিজাইনাররা এই আসরে তাদের সৃষ্টিসম্ভার উপস্থাপন করেছেন। পুরো উইক অনুষ্ঠিত হয়েছে মস্কোর মানেঝ-এর মানেঝনায়া স্কয়ারে। এর পাশেই বিখ্যাত ক্রেমলিন। আমি ছাড়া গ্লোবাল ট্যালেন্টে অংশ নেওয়া বাকিরা ছিলেন ইতালির চারলোত্তা রবি ডি অরেঞ্জো, পেরুর আনাইস ইউক্রা মানসিলা, ব্রিটেনের হ্যারিয়েট একলেস্টন ও ক্রিসমা সাব্বারওয়াল।
আমার কালেকশন পরেন ২৬ জন মডেল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্টাইলিশ ইগর আন্দ্রিভের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। এ ছাড়া আমার কালেকশনের ফটোশুটও করা হয়। তা করেন আরেকজন বিশ্বখ্যাত ফটোগ্রাফার ইয়ান ইউগে। আমাকে একটা প্রেজেন্টেশনও দিতে হয়। এরপরেই ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেখানে আমাদের সহায়তা করেন একজন দোভাষী।
এর আগে আমি অকল্যান্ড ফ্যাশন উইকে অংশ নিয়েছি। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, রাশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের কেবল সমৃদ্ধ করেনি, আমার ভবিষ্যতের কাজের দিকনির্দেশনাও দিয়েছে।
ছবি: পূর্ণা ও সংগ্রহ