বিশেষ ফিচার I ঈদসংখ্যার হারানো জৌলুশ
রোজার শুরুতেই অপেক্ষা—কোন সকালে হকার দিয়ে যাবে ঈদের বিশেষ সংখ্যাটি। এ এক প্রত্যাশিত বিনোদন। সেই দিন আর নেই। লিখেছেন জাহেদ সরওয়ার
আজকের বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের ঈদসংখ্যার যে ধারণা, তা এসেছে কলকাতার দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও সিনে সাময়িকীর পূজাসংখ্যা থেকে। এর শুরু সম্ভবত নূরজাহান বেগম সম্পাদিত ‘বেগম’ পত্রিকার ঈদ নিয়ে বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় সম্পাদকের অবস্থানকালে ঈদ নিয়ে এই পত্রিকায় একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন (সেখানকার) কিছু পত্রিকার পূজাসংখ্যা দেখে। এরপর ঢাকায় ১৯৫১-৫২ থেকে আবার বেগম-এর বিশেষ ঈদসংখ্যা বের হয়। পত্রিকাটি বরাবরই লেখিকাদের ছবি দিয়ে ঈদসংখ্যা প্রকাশ করত। এতে লেখিকারা পরস্পরকে চিনতে ও জানতে পারতেন। সেকালে চিত্রশোভিত এ রকম ঈদসংখ্যার স্মৃতি নিয়ে এখনো অনেকে বেঁচে আছেন। তবে সেটিকে ‘ঈদসংখ্যা’ বলা হতো না, ‘ঈদ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন’ ধরনের কিছু বলা হতো। আজকের যে ঈদসংখ্যার স্ফীতি, সেটি ছিল বেগম পত্রিকার ঈদ উপহার। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দেশ’ এবং অন্য কিছু ম্যাগাজিনের পূজাসংখ্যা তখন বাংলাদেশে পাওয়া যেত। অনেক পরিবারেই সেগুলো রাখা হতো। এই পূজাসংখ্যাগুলোই পরে এখানকার ঈদসংখ্যাগুলো প্রকাশে প্রেরণা জুগিয়েছে।
সেই ধারাবাহিকতা থেকে বর্তমানে জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক, পাক্ষিক, অনলাইন, ছোটকাগজ, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য সংগঠন ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে আসছে। ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, বিচিত্র বিষয়ের সমন্বয়ে প্রতিবছর পাঠকের সামনে হাজির হতে থাকে একেকটি সংখ্যা। এতে স্থান পায় গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, ফিচার, সাক্ষাৎকার, আত্মজীবনী, গবেষণা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, খেলাধুলা, সংস্কৃতি, বিনোদন, রান্নাবান্না, সাজগোজ প্রভৃতি। এত বড় আয়োজনের কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে এক মাসের বেশি সময় ধরে।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত পূজাসংখ্যাগুলোর মতোই, এসবে প্রাধান্য পেত সাহিত্য। নবীন থেকে বিখ্যাত ও বিশিষ্ট—সব লেখকের রচনাই স্থান পেত ঈদসংখ্যায়। কারা লিখতেন? শামসুদ্দিন আবুল কালাম, রশীদ করীম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার, মঈনুল আহসান সাবেরসহ অসংখ্য লেখকের উপস্থিতি ছিল সেসব ঈদসংখ্যার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো ভিন্ন ধারার লেখকেরাও ঈদসংখ্যায় হাজির হতেন। তবে সেই সময়ের ঈদসংখ্যাগুলো মানের দিক থেকে নানা মাত্রায় সমৃদ্ধ ছিল। কেননা, ভালো এবং সমৃদ্ধ লেখা ছাপানোর পাশাপাশি সেগুলো আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের ব্যাপারে সে সময়ের সম্পাদকেরা আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু কিছুটা পরে দেখা গেল ঈদসংখ্যাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপন আর পত্রিকার নিজস্ব লেখকদের যা-তা দিয়ে পেট ভরানোর প্রতিযোগিতা। ‘একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস’ শিরোনামটি ঈদসংখ্যা থেকে এসেছে। প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ উপন্যাসই ছাপানো হতো তখন। আজকের মতো সংক্ষিপ্তাকার কিংবা উপন্যাসের বদলে বড় গল্প চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ছিল না।
ঈদসংখ্যাগুলোর বেশির ভাগ পাঠকই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। হিসাব করেই তাদের চলতে হয়। ১৯৯১-৯৪ সালে একটি ঢাউস সাইজের ঈদসংখ্যা ‘বিচিত্রা’র দাম ছিল ৩০ টাকা। ১৯৯৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ টাকা। একই বছর বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘২০০০’ নামে মানসম্মত আরও একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বের হয়; এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন গোলাম মোর্তজা। ২০০০ সালে এর ম্যাগাজিনের দাম হয় ১০০ টাকা। ২০০৭ সালে ১২০ টাকা। ‘অন্যদিন’ নামে আরও একটি ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয় এরই মধ্যে। ১৯৯৮ সালে ৪০০ পৃষ্ঠার এই ম্যাগাজিনের ঈদসংখ্যার দাম ছিল ৬০ টাকা। ২০০৫ সালে ১৫০ টাকা। আর এখন প্রায় ৩০০ টাকা। কিন্তু মান কি আছে আগের মতো? পত্রিকার অর্ধেই ভরা থাকে বিজ্ঞাপনে। ফলে একদিকে ঈদসংখ্যাগুলো মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে নি¤œগামী মানের কারণে আকর্ষণ হারাচ্ছে। পাঠকপ্রিয় ম্যাগাজিন এখন আর নেই বললেই চলে। সেই জায়গা দখলের চেষ্টায় দৈনিক পত্রিকাগুলো। মুদ্রণসৌকর্য, চাকচিক্য বাড়লেও ঈদসংখ্যার সেই আবেদন কি আছে?
বিচিত্রা ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদগুলো প্রথিতযশা আলোকচিত্রীদের ছবি দিয়ে করা হতো। তাদের মধ্যে আমানুল হক, আনোয়ার হোসেন, নওয়াজেশ আহমদ উল্লেখযোগ্য। ‘রোববার’ও সেই ধারাতেই প্রচ্ছদ করত। সাপ্তাহিক ২০০০ও সেই ধারা অব্যাহত রাখে। ‘সচিত্র সন্ধানী’ প্রচ্ছদগুলো করত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা দিয়ে। ‘তারকালোক’ যেহেতু সিনে ম্যাগাজিন, তাই চলচ্চিত্রশিল্পীদের দৃষ্টিনন্দন ছবি দিয়ে এর প্রচ্ছদ হতো। ‘নিপুণ’ নামের ম্যাগাজিনটিও কিছুটা সিনে ম্যাগাজিনের আদলে হওয়ায় এর প্রচ্ছদ চলচ্চিত্রশিল্পীদের নিয়ে হতো। ঈদসংখ্যার ভেতরকার অঙ্গসজ্জা ছিল সাদাকালো। শিল্পীর রেখায় উপন্যাস, গল্প ও কবিতার অলংকরণ হতো। এসব ম্যাগাজিনের জৌলুশ ছিল সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
এখনো ঈদসংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে একধরনের মন্দ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। যে যাকে ব্যবহার করতে পারে, সে-ই তাকে তারকালেখক বানাচ্ছে, তাদের নিয়ে ক্রমশ ভরে উঠছে ঈদসংখ্যার এক একটি পৃষ্ঠা। বাংলাদেশে লেখক মানেই এখন ফরমায়েশি লেখক। এদের বছরে দুইটা মৌসুম। একটা ঈদসংখ্যার, অন্যটা ফেব্রুয়ারি বইমেলার। সারা বছর নিজের তাগিদে লেখে, সে রকম লেখক এখন এই দেশে নেই বললেই চলে। ঈদসংখ্যার জন্য উপন্যাসের মতো কিছু একটা বানিয়ে দিলেই হলো। সেদিন স্বনামধন্য এক লেখক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, তিনটা ঈদসংখ্যার জন্য তিনটা গল্প লিখলেন, একটার জন্য লিখলেন প্রবন্ধ, একটার জন্য উপন্যাস ধরেছেন, তা এখনো শেষ করতে পারেননি। এই অবস্থাতেই আরেকটা পত্রিকা থেকে তাকে নিরন্তর তাড়া দেওয়া হচ্ছে প্রবন্ধ লেখার জন্য। তিনি বলছেন, তাড়া খাওয়া হরিণের মতো লিখছেন। তিনি জানেন না, কী লিখছেন। তো এই যদি হয় একজন লেখকের অবস্থা! তাহলে?
বাংলাদেশে কেবল দৈনিক পত্রিকাগুলোই ঈদসংখ্যা করে না, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও করছে। এমনকি সাহিত্যের ওয়েব ম্যাগগুলোও এই আয়োজনে পিছিয়ে নেই। কোনো কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকেও ঈদ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করতে দেখা যায়। তবে ভার্চ্যুয়াল ঈদসংখ্যায় প্রবীণদের চেয়ে নবীনেরাই বেশি প্রকাশিত। অনেক প্রবীণ লেখক প্রিন্টেড সংখ্যা ছাড়া লেখা দিতে চান না। অনলাইনে যেহেতু জায়গা নিয়ে ভাবতে হয় না, সেহেতু মানসম্মত লেখা হলেই অনায়াসে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ থাকে। এমনকি ই-পেপার আকারেও সেটি পাওয়া যায়।
প্রকাশনার প্রযুক্তি এগিয়েছে অনেক, তবু ঈদসংখ্যার যে জৌলুশ ছিল ৩০-৪০ বছর আগে, তা প্রায় বিলীন। মধ্যবিত্তের লাইফস্টাইল পাল্টে গেছে, রুচি বদলেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎসবকেন্দ্রিক এই আয়োজন এগোতে পেরেছে কি? জগতের সবকিছুই তো সময়মাফিক চলে।
ছবি: ক্যানভাস