ট্রাভেলগ I শিয়ানের সেই দিন
চীনের শিয়ান শহরের প্রাচীন মসজিদ আর ফুড স্ট্রিট যেন এক টুকরো মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু তাতে স্থানীয় সংস্কৃতির মিশেল সেখানকার মুসলমানদের স্বতন্ত্র করে তোলে। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
চায়নিজ খাবার সুস্বাদু শুধু আমাদের দেশেই। চীনে দেড় মাস ভ্রমণ করে, অথেনটিক চায়নিজ খাবার খেয়ে পেটে মরিচা পড়ে গিয়েছিল। শিয়ান শহরে আসার পর প্রথম কাজ এখানকার মুসলিম কোয়ার্টার ঘুরে দেখা। দেশে বসে কত গল্পই না শুনেছি চায়নিজ মুসলমানদের। স্বচক্ষে দেখার দিন এলো বুঝি। হোটেল থেকে বাসে চেপে সোজা বেল টাওয়ার, সেখান থেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট লাগে বিখ্যাত মুসলিম কোয়ার্টারে যেতে। এত দিন চীন ভ্রমণ করে একজন মুসলমানের দেখা পাইনি। এখানে ড্রাম টাওয়ারের কাছাকাছি আসতে না-আসতেই চীনা মুসলমান দু-একজন দেখতে পেলাম। কীভাবে বুঝলাম তারা মুসলমান? তাদের মাথায় সাদা টুপি। মুসলিম কোয়ার্টারের কাছাকাছি যেতেই দেখি, সারি সারি খাবারের দোকান। সকালে কিছু না খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পথের ধারেও বিকোচ্ছে কত নাম না জানা খাবার। শিক কাবাব জাতীয়, কিন্তু দেখতে গোলাকার খাবার খেতে খেতে হাঁটতে লাগলাম। প্রথম কামড়েই মনে হলো—আহা, কী স্বাদ! দেড় মাসের পরিচিত খাবার না খাওয়া পাকস্থলী যেন আনন্দে নেচে উঠল। কাবাবের স্বাদ খানিকটা মোগল আর পারস্য ধাঁচের। এ খাবার পেয়ে যারপরনাই পুলকিত হলাম।
ভ্রমণ করতে এসেছি, গন্তব্য ‘গ্রেট মস্ক অব শিয়ান’, যা মুসলিম কোয়ার্টারে অবস্থিত। চীনের সর্ববৃহৎ এবং প্রাচীন মসজিদ। লম্বা একটা গলি পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় মসজিদে। গলির দুধারে হরেক পণ্যের পসরা। জামাকাপড়, গয়না, ব্যাগ, স্যুভেনির, চীনামাটির বাসনপত্র, তৈলচিত্র—আরও কত কী!
মূল মসজিদে ঢোকার আগে তিনটি প্রাঙ্গণ পেরোতে হয়। ১২০০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে এ মসজিদের মোট প্রাঙ্গণ চারটি। ইতিহাস বলে, ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে চীনের ত্যাং রাজবংশের শাসনামলে আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাণিজ্য করতে আসা মুসলমান ব্যবসায়ীরা এ মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ত্যাং রাজবংশের পর সং, ইউয়ান, মিং ও চিং রাজবংশের শাসনামলে উনিশ শতক অবধি মসজিদটির পরিবর্ধন, পরিমার্জনের কাজ চলে।
মূল প্রবেশদ্বার বা খিলানাকৃতি তোরণ, কাঠের কারুকাজের বিশালায়তন কীর্তিস্তম্ভ যেন। ৯ মিটার লম্বা লাল-নীল এ দ্বার আর তার সোনালি কারুকাজে স্পষ্ট চীনা স্থাপত্যরীতি ও শিল্পকলার প্রভাব। ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ডান দিকে ছোট একটি কাঠের ঘর, যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভেতরে মিং ও চিং (চৌদ্দ থেকে উনিশ শতাব্দী) রাজবংশের আসবাব সাজানো আছে। প্রতিটি প্রাঙ্গণের ফটক পার হলে দেখতে পাওয়া যায় একটি আঙিনা, যা বাগানে পরিবেষ্টিত এবং মাঝখানে কীর্তিস্তম্ভ।
চীনে যেকোনো রাজপ্রাসাদ ও মন্দিরের মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য হচ্ছে কোনোটাই সরাসরি জনসম্মুখে উন্মুক্ত নয়। একটি, দুটি বা কয়েকটি প্রাঙ্গণ পেরিয়ে প্রধান ভবনের দেখা মেলে। মসজিদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আদতে চীনা স্থাপত্যকলায় নির্মিত মসজিদটি এবং প্রতিটি প্রাঙ্গণের ভবন কাঠের তৈরি। দ্বিতীয় দ্বার পেরিয়ে প্রাঙ্গণের মাঝখানে দেখতে পেলাম ষড়ভুজাকৃতি দেয়ালবিহীন ছোট ঘর। ভেতরে কাচ দিয়ে আবৃত পাঁচ ফুট উঁচু দুটো প্রস্তরখন্ডে আরবি ক্যালিগ্রাফি খোদাই করা আছে। এটি এগারো শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। দুটো প্রস্তরখন্ডের ঠিক মাঝখানে বিশালাকার পাথরের কচ্ছপ বসে যেন পাহারা দিচ্ছে কীর্তিস্তম্ভগুলো। হঠাৎ মাথায় গোঁড়ামির উদয় হলো, জীবজন্তুর মূর্তি মসজিদ প্রাঙ্গণে কেন! সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে শুধরে নিলাম। থাকতেই পারে, চীনাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায়। চীনা পুরাণ অনুসারে কচ্ছপ হচ্ছে স্থৈর্য, জ্ঞান, ধৈর্যের প্রতীক।
তৃতীয় প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে তিনতলা অষ্টকোণ কাঠের ভবন, যা দেখতে একদম চায়নিজ প্যাগোডার মতো। ধারণা করা হয়, এটি মসজিদের মিনার হিসেবে ব্যবহৃত হতো আজান দেবার জন্য। দুপাশের দেয়ালে আরবি হরফে কিন্তু ম্যান্ডারিন নকশার ফিউশনে ক্যালিগ্রাফি করা আছে, যাকে বলা হয় ‘সিনি’। প্রাঙ্গণজুড়ে সবুজের সমারোহ।
চতুর্থ প্রাঙ্গণ হলো মসজিদের মূল ভবন, যেখানে নামাজ পড়া হয়। প্রবেশদ্বারটি বাহারি। পাশাপাশি পাঁচটি ষড়ভুজাকৃতি দেয়ালহীন কাঠের ঘর যেন স্বাগত জানাচ্ছে। দ্বার পেরোলেই আরেকটি দ্বার, যা পাথরে নির্মিত। দ্বারের সামনে মেঝে থেকে একটু উঁচুতে চৌকোণ পাথরে দুটো ড্রাগন খোদাই করা আছে। আবার দ্বিধা! মসজিদে ড্রাগন, আবার তাড়ালাম গোঁড়া ভূতটাকে। মনে পড়ে গেল চায়নিজ স্থাপত্যকলার মূলমন্ত্র। তাতে ড্রাগনকে মানা হয় শুভ, মঙ্গলকর হিসেবে। যার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার শক্তি ও ক্ষমতা আছে।
দ্বার পেরিয়ে দেখা পেলাম বহুল প্রতীক্ষিত মসজিদের। দেখতে একদম আমাদের দেশের চারচালা টিনের ঘরের মতো। তবে পার্থক্য হচ্ছে বিশালাকার এ মসজিদ সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। দরজায়, দেয়ালে অসাধারণ সূক্ষ্ম কারুকাজ। এ মসজিদে দর্শনার্থীদের প্রবেশে বাধা নেই। ঢোকার মুখে দেখলাম একজন প্রৌঢ় মসজিদের বারান্দায় বসে একদল শিশুকে গল্প শোনাচ্ছেন। সামনে রাখা আছে চায়ের পেয়ালা। বাচ্চারাও কম যায় না। কলকাকলিতে মুখর। বোধ হয় আরও গল্প শোনানোর আবদার করছে। এদের ভাষা বুঝি না, কিন্তু আনন্দের ভাষা কি খুঁজে বের করতে হয়।
জুতা খুলে বাইরে রেখে ঢুকে পড়লাম মসজিদে। তখনো জোহরের ওয়াক্ত হয়নি। তাই অভ্যন্তর একদম ফাঁকা। দু-তিনজনকে দেখলাম—মাথায় সাদা টুপি পরে হাতে ছোট বই নিয়ে মনোযোগসহকারে পড়ছেন। খুব কৌতূহল হচ্ছিল, কী পড়ছেন তারা! কাছে গিয়ে দেখি ম্যান্ডারিন ভাষায় লেখা সেই পুস্তক। মসজিদ পবিত্র স্থান, তাই শোরগোল না করে (কারণ চীনের খুব কম মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, এই ভাষায় বোঝানোর পাকে পড়ে পাছে প্রার্থনার ব্যাঘাত না ঘটে) পেছনে বসে থাকা একজনকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, কী পড়ছেন তারা। জানালেন, কোরআন শরিফের অংশবিশেষ পড়ছেন।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম কেবলা আর মিম্বারের কারুকাজ। কেবলার দিকে কাঠের ওপর কোরআন শরিফের আয়াত আরবিতে লেখা। পুরো দেয়ালজুড়ে। আরব আর চৈনিক শিল্পকলার সমন্বয়ে নির্মিত এ প্রাচীন সূক্ষ্ম কারুকাজ যেকোনো আধুনিক নকশাকে হার মানাবে। সিলিংয়েও দেখি রঙবেরঙের ক্যালিগ্রাফি আঁকা।
জোহরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে একজন, দুজন করে মুসল্লি এসে জমা হতে থাকলেন নামাজের জন্য। আশপাশেই থাকেন সবাই, কারণ এলাকাটা মুসলমান-অধ্যুষিত। এক কাতারে সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন নামাজের জন্য। এ মসজিদে মহিলাদের নামাজের জন্য আলাদা স্থান নেই, তাই শুধু পুরুষেরাই আসেন নামাজ পড়তে। চীনে অবশ্য অন্যান্য অনেক মসজিদে মহিলাদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। আমি পেছনের দিকে বসে দেখছিলাম। নামাজ পড়া হচ্ছিল আরবি সুরা, দোয়া ইত্যাদি পাঠ করে।
ভাবা যায় আমাদের দেশে মূল মসজিদে ঢুকে নামাজের সময় পেছন থেকে কোনো নারী মুসল্লিদের নামাজ পড়া দেখছে! সাম্য আর সহনশীলতা যেন একেই বলে। বেরিয়ে এলাম মসজিদ থেকে, যাতে আমার জন্য মুসল্লিদের অসুবিধা না হয়।
হাঁটতে লাগলাম অলিগলিতে। প্রাচ্যের মুসলমানরা বাণিজ্য বিস্তারের জন্য আসা শুরু করেছিলেন অষ্টম শতাব্দীতে, কেউ কেউ স্থানীয় নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছেন এ দেশে। বাড়িঘরগুলো অন্যান্য সাধারণ চায়নিজ বাড়িঘরের মতোই। পার্থক্য, এলাকাটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে হওয়া সত্ত্বেও এখনো শুধু মুসলিম কোয়ার্টারের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখানে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এখানকার মুসলমানরা ‘হুই’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এ শহরে মোট মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।
প্রধান সড়কটির নাম ‘বেইউয়ানমেন মুসলিম স্ট্রিট’। প্রথম আকর্ষণ এখানকার খাবার। পথটি ধূসর বর্ণের ব্লক দিয়ে নির্মিত। দুপাশে সারি সারি খাবারের দোকান আর সেসবের মনমাতানো সুগন্ধ। কয়েক পা হেঁটে গিয়ে খেয়াল করলাম। একটি খাবারের দোকান থেকে হিন্দি সিনেমার গান ভেসে আসছে। দোকানটির সামনে থরে থরে ইরানি বা আফগান ধাঁচের বড় বড় রুটি রাখা, পাশের চুলায় ফুটন্ত নেহারির ডেকচি। রাঁধুনি পথের দিকে মুখ করে শিক কাবাব কয়লার চুলায় বারবিকিউ করছেন। ভারতের পুরোনো দিল্লিতে এসে পড়লাম নাকি! কিন্তু মানুষগুলো তো চীনাদের মতো দেখতে, মাথায় সাদা টুপি। ঢুকে পড়লাম সেই রেস্টুরেন্টে, টেবিলে এল এখানকার বিখ্যাত ‘ইয়াংরৌ পাওমো’। খাবারটি আমাদের ভাষায় খাসির পায়ার নেহারি আর নান রুটি। স্বাদ ভিন্ন আমাদের খাবার থেকে, তবে খুবই ভালো খেতে। রেস্টুরেন্টের প্রধান বাবুর্চি পারস্য বংশোদ্ভূত। তারা তাদের বাড়ির ট্র্যাডিশন মেনে এখানে খাবার তৈরি করে। ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক কিছুই জানা হলো না। এরপর ঘুরেফিরে খেলাম হরেক রকমের মিষ্টিজাতীয় খাবার পুডিং, কেক ইত্যাদি। পথজুড়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বয়সের ভ্রমণার্থীদের ভিড়। এখানকার খাবার এতই বিখ্যাত যে, স্থানীয় লোকজনও কম নেই।
ফুড স্ট্রিটের দোকানদারেরা সবাই মুসলমান। মেয়েরাও ছেলেদের মতো টুপি পরে দোকানদারি করছেন। একজন মহিলা অটোরিকশাচালককে দেখলাম যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেছেন। হিজাব দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি মুসলমান। স্কুল শেষে ছেলেমেয়েরা কলকল করে বাড়ি ফিরছে একসঙ্গে, হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে।
ফুড স্ট্রিটের আশপাশের অলিগলিতে রয়েছে বিভিন্ন রকমের স্যুভেনিরের দোকান। হাঁটতে হাঁটতে, বিভিন্ন অ্যান্টিক দেখতে দেখতে কিনলাম চায়নিজ ক্যালিগ্রাফি ড্রইং। মুসলিম কোয়ার্টার হচ্ছে শিয়ান শহরের এমন স্থান, যেখানে প্রায় সব জিনিস অন্যান্য মার্কেটের চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায়।
হেঁটে হেঁটে পুরোনো কিছু চিত্রকর্ম দেখছিলাম। হঠাৎ শুনি হিন্দি সিনেমার কথোপকথন। লক্ষ করলাম, দোকানি নিজের মোবাইল ফোনে ইউটিউবে সাদাকালো যুগের হিন্দি সিনেমা দেখছেন। তিনি তেমন ইংরেজি জানেন না, আমি জানি না ম্যান্ডারিন। তবে আমার উচ্ছ্বাস দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগলো থরে থরে সাজানো লাল শুকনো মরিচের দোকান দেখে। কোথাও বড় বড় পাথরে তৈরি যন্ত্র দিয়ে মরিচ পেষা হচ্ছে। আর তা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ হাতে। তাতে নাকি মরিচ ঠিকমতো ভাঙা যায়।
মরিচগুলো সুতোয় গেঁথে গুচ্ছাকারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দোকানের সামনে। এখানকার খাবার খেয়ে তো অত ঝাল মনে হয়নি। অবশ্য অন্যান্য প্রদেশের কিছু কুজিন বেশ ঝাল। শিয়ানের শুকনো মরিচ বিখ্যাত। পৃথিবীর মোট ৪৬ শতাংশ লাল মরিচ উৎপাদিত হয় চীনে। ঝালে পূর্ণ এই দেশের মানুষ কিন্তু কাজেকর্মে শান্তি বজায় রাখে। চীনারা এটা বিশ্বাসই করতে চায় না যে, মরিচের আদি নিবাস তাদের দেশ নয়। এর উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকায়। কলম্বাস ঝোলা ভরে কত কী যে এনে ছড়িয়ে দিয়েছেন এশিয়ায়! আর তা এখন অতি মাত্রায় স্থানীয়। সে কারণেই বোধ করি মাও সে তুং বলেছিলেন, ‘নো চিলি, নো রেভল্যুশন’।
তিলের খাজার মতো একধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবার চোখে পড়ল, দোকানের ভেতরেই সেটি তৈরির প্রক্রিয়া দেখলাম। বলিষ্ঠ আর সুদর্শন কয়েকজন চীনা যুবক বিশাল আকারের হাতুড়ি দিয়ে বড় একটা টেবিলে রাখা মিষ্টির ডো পিটিয়ে যাচ্ছেন। আর দোকানের সামনে তিলের খাজাসদৃশ খাবার বিক্রির জন্য রাখা আছে। কেউ ইচ্ছে করলে চেখে তারপর কিনতে পারে। আমি এক টুকরো চাখলাম। স্বাদ ভালোই। অনেককেই দেখলাম বড় বড় প্যাকেট কিনছে। আমি কিছুই কিনলাম না। আমার পাড়ি দিতে হবে আরও পথ, আরও অনেক সময় থাকতে হবে ভ্রমণে।
খানিকটা হাঁটার পর চোখে পড়লো মুসলমান অধিবাসীদের বাড়িঘর। সেসব দেখতে প্রাচীন আর কোনোটাই দোতলার বেশি নয়। বাড়িগুলো সাধারণ ইট আর কাঠের তৈরি পুরোনো চীনা বাসস্থানের মতোই।
অলিগলি ঘুরে আবার হাজির হলাম ফুড স্ট্রিটে আরও লোভনীয় কিছু খাবারের জন্য। এবারের ডিশ রৌজিয়ামো। বনরুটির ভেতরে মাংস পুরে বানানো হয় সুস্বাদু এই খাবার।
খাওয়া সেরে আবার মসজিদের আশপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। উদ্দেশ্য, মাগরিবের নামাজ দেখা। মসজিদের কাছেই একজনকে পেলাম, দেখে মনে হলো ইংরেজি জানে। তার নাম আলী, যদিও আসল চীনা নাম বলায় বুঝতেই পারছিলাম না কীভাবে উচ্চারণ করব। বয়স ২৩/২৪, পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে, এখন স্কুলে পড়ায়। এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পরিবারের সঙ্গে থাকে। মায়ের আদেশে মসজিদে এসেছে নামাজ পড়তে। ছেলেটি এতই লম্বা যে, তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল। আলীর সঙ্গে মসজিদের প্রাঙ্গণে ঢুকলাম। মূল প্রাঙ্গণে দেখা মিলল ইমামের সঙ্গে। দেখতে আর দশজন সাধারণ চীনা লোকের মতোই। শ্মশ্রুহীন, মাথায় সাদা টুপি, পরনে সাদা শার্ট আর ট্রাউজার। ভদ্রলোক জানালেন, কয়েক পুরুষ ধরে তারা মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে আসছেন আনন্দের সঙ্গে। আরবি অক্ষরজ্ঞান পেয়েছেন পিতার কাছ থেকে। নামাজের ইমামতি ছাড়াও ছোট একটা ব্যবসা আছে সংসার চালানোর জন্য।
ভাবছিলাম, রাত আটটা বেজে গেল, এখনো মাগরিবের আজান দিচ্ছে না কেন! বাইরের আকাশ তখন ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে সবে। আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব মুসল্লি এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেলেন। আলীও নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়াল। আলীকে বিদায় জানালাম আর আমি কিছুক্ষণ আশপাশে হাঁটাহাঁটি করলাম। মসজিদ প্রাঙ্গণের হরেক গাছের ফুল সব সুবাস ঢেলে চারপাশ মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেই ঘোর নিয়ে বের হয়ে এলাম মসজিদ থেকে, শিয়ানের মুসলিম কোয়ার্টারের কিছু সুখস্মৃতি রইল আমার সঙ্গে। আর পেছনে সুর করে ইমাম সাহেব পড়ে চলছেন সুরা এখলাস।
উল্লেখযোগ্য তথ্য: ঢাকা থেকে শিয়ান যাওয়ার সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। চীনের যেকোনো বড় শহর যেমন বেইজিং, সাংহাই, কুনমিং থেকে প্লেন অথবা ট্রেনে চেপে শিয়ান পৌঁছানো যায়। সেখানে সব মানের হোটেল রয়েছে। খাবারের জন্য তো মুসলিম কোয়ার্টার আছেই।
ছবি: লেখক