ছুটিরঘণ্টা I ইতিহাসের অন্দরে
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের কাজ শেষে কয়েক দিন ঘুরেছেন স্মৃতির শহর ওয়াশিংটন আর ফিলাডেলফিয়ায়। অনন্য সেই অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন ড. গোলাম শফি
খুব সকালে সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটন বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়ে এক ঘণ্টা পর ওয়াশিংটন ডিসির ডালেস বিমানবন্দরে এসে পৌঁছাই। সেদিন ২০১৭ সালের ১২ জুন। লক হ্যাভেন থেকে কয়েক শ মাইল পথ অতিক্রম করে এখানে আমাকে রিসিভ করতে অপেক্ষমাণ বন্ধু-আত্মীয় ড. খালেকুজ্জামান মতিন। সেখান থেকে এক-দেড় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হয় ওদের রাজধানী শহরে। প্রচন্ড গরম, ঘোরাফেরার একপর্যায়ে আমরা শার্ট খুলে ফুটপাতের চায়নিজ দোকান থেকে দুটি পাতলা টি-শার্ট কিনে পরে ফেলি। এমনকি জুতাও খুলে ফেলে গাড়ি থেকে খালেকের বের করে দেওয়া স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলাই। ভাবতেই পারিনি, যুক্তরাষ্ট্রে এসে গরমে এতটা কষ্ট পাব। তাপমাত্রা তখন ৯২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আমাদের অবস্থা জানানোর জন্য ফোন করতেই খালেকপত্নী লাবণী বলল, চাচা, অবশ্যই বেশি করে পানি খাবেন।
ওয়াশিংটন ডিসি বা ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী, যা কোনো অঙ্গরাজ্যের অধীন নয়। কে না জানে, এই নামকরণ তাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের স্মরণে। শহরের খুঁটিনাটি বিষয় জানবার আগে অধ্যাপক খালেক জানতে চায়, আমার সম্মেলন কেমন হয়েছে। ড. খালেকুজ্জামান লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক, দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।
বলি, খুবই ভালো হয়েছে। এ এক অভাবিত ও বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আসলে আমি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ৫ দিনের সমুদ্র সম্মেলন শেষ করে বন্ধু ড. আবদুল্লাহ্ মাহবুবের আমন্ত্রণে চলে যাই সাউথ ক্যারোলিনা; তার আবাস অরেঞ্জবার্গ শহরে। এরা মজা করে অরেঞ্জবার্গকে বলে ‘কমলাপুর’। সেখান থেকেই আমার ওয়াশিংটনে আসা। তারপর যাব ফিলাডেলফিয়া হয়ে লক হ্যাভেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী শহরটিতে প্রবাহিত পোটোম্যাক নদী। আর শহরটি মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের সীমান্ত ছুঁয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে এ দুটো রাজ্যের অংশ নিয়েই তৈরি হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসি। শহরটি আসলে নব্য ধ্রুপদি মনুমেন্ট ও ভবনের এক অবারিত ভুবন। ফেডারেল সরকারের তিনটি আইকনিক ভবন হচ্ছে ক্যাপিটল, হোয়াইট হাউস ও সুপ্রিম কোর্ট। আর বহু জাদুঘরের এটা যেন এক আঁতুড়ঘর। কেনেডি সেন্টারটি বিখ্যাত হয়ে আছে পারফর্মিং আর্টসের জন্য।
সারা দিন ঘুরে আমরা মোট ১৫টি ভবন, জাদুঘর ও স্মৃতিস্তম্ভ ভেতর-বাইরে থেকে অবলোকনের সুযোগ পাই। তালিকাটা এখানে উল্লেখ করলে মন্দ হয় না। ১. ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, ২. লিংকন মেমোরিয়াল (এর সামনে লেখা আছে: আমেরিকানস কেম টু লিবারেট, নট টু কনকার, টু রেস্টোর ফ্রিডম, অ্যান্ড টগ অ্যান্ড টাইরানি), ৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেমোরিয়াল, ৪. ভিয়েতনাম ওয়ার মেমোরিয়াল, ৫. হোয়াইট হাউস (তবে হোয়াইট হাউসের সামনে যেতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই এর কাছাকাছি যাওয়া বন্ধ করে দেন। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, ওবামার আমল থেকেই এর শুরু। ট্রাম্প এসে আরও অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করেন। অনেক দূর থেকেই চারপাশে বেড়া দেওয়া হয়েছে। এ রকম বিধিনিষেধ অন্যান্য স্থাপনায়ও কিছু কিছু আরোপ করা হয়েছে), ৬. আফ্রো-আমেরিকান ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিষয়ক স্মিথসোনিয়ান জাতীয় জাদুঘর। ৭. ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। ৮. আমেরিকান ইতিহাস জাদুঘর, ৯. ইউএসএ আর্কাইভ, ১০. ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, ১১. জাতীয় গ্যালারি, ১২. ইউএস ক্যাপিটল হিল (লোকজন এ ভবনকে বলে দেবদূতের মন্দির), ১৩. লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ১৪. সুপ্রিম কোর্ট ও ১৫. আমেরিকান রিজার্ভ ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনার সঙ্গে এ নাম জড়িয়ে আছে)।
জুন মাসের দিন বেশ বড়ই মনে হলো। এত যে ঘুরলাম আমরা, তা-ও যেন বেলা শেষ হচ্ছিল না। আমরা মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর ও ভার্জিনিয়ার ভেতর দিয়ে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের দিকে এগোতে থাকি। ড. খালেক ডেলাওয়ার স্টেটের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালাল ফিলাডেলফিয়া অভিমুখে। পথে সে দেখাল তার বিশ্ববিদ্যালয়টি, যেখানে সে ভূতত্ত্বের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। দূর থেকে আঙুল উঁচিয়ে বিভিন্ন বিভাগ ও স্থাপনাগুলোও চিনিয়ে দিল। তা ছাড়া দেখাল সেই ডাকঘর, যেখান থেকে সে আমাকে অসংখ্য চিঠি পাঠিয়েছে এবং আমার পাঠানো চিঠিগুলো পেয়েছে। এটি তার জন্য ভীষণ নস্টালজিক বিষয়ই বটে; তবে আমিও কম স্মৃতিকাতর হইনি।
পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ফিলাডেলফিয়া। সেখানে খালেকের অনুজ লেখক-কবি-নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীরের বাস। যে নদীর পাড় দিয়ে আমরা যাচ্ছি, সেটির নাম ডেলাওয়ার নদী। গাড়িতে দীর্ঘ সময় কাটাতে গিয়ে কিছু তথ্য জানবার সুযোগ হয় আমার। খালেক পাকা গাইডের মতো জানাতে থাকে নানা তথ্য। আমেরিকা বহু আগে উত্তর-দক্ষিণে বিভাজিত ছিল। এখনকার ভার্জিনিয়ার রাজধানী রিচমন্ড ছিল আমেরিকার গোটা দক্ষিণাংশেরই রাজধানী। যে ক্যারোলিনা আমি সফর করে এসেছি, সেটি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ক্যারোলিন কাপড়ের নাম। এই ক্যারোলিন একসময় গোটা পাক-ভারত উপমহাদেশেই জনপ্রিয় ছিল। আমেরিকা-রাশিয়ার সম্পর্ক আলোচনায় জানা যায়, যে আলাস্কা জার একসময় আমেরিকার কাছে বিক্রি করেছিলেন, তার প্রতীকী মূল্য ছিল প্রায় ১ পয়সায় এক একর। তাতেও কোটি টাকার দাম পেয়েছিলেন। এতেই বোঝা যায়, জার মহোদয়ের ছেড়ে দেওয়া অঞ্চলটি কত বড় ছিল।
ফিলাডেলফিয়া শহরে ঢুকতে রাতই হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল ২০০১ সালে কোরিয়ায় আমার পরা আলমগীরের দেওয়া টি-শার্ট দেখে আমার শিক্ষক কি সিক লি বলেছিলেন, ফিলাডেলফিয়া পরিচিতি ‘সিটি অব ব্রাদারলি লাভ’ বা ‘সিস্টারলি অ্যাফেকশন’ হিসেবে। তার মানে, আমি এক ভালোবাসার ও স্নেহের নগরীতে প্রবেশ করেছি। এরই মধ্যে মতিন-তনয় লেনিন, আলমগীর-তনয় বাউবাব ও কন্যা মিথ চলে এলো। আমরা আনন্দ আড্ডায় মেতে উঠি। সম্পর্কে ওদের দাদা বলে আড্ডা জমে উঠতে একটুও দেরি হয় না। ওরা যে আমাকে পেয়ে কী খুশি হয়েছে, তা বর্ণনার ভাষা নেই। আলমগীর-পত্নী নার্গিসের সপ্তব্যঞ্জনের উদরপূর্তিতে আমি বাস্তবিকই ক্লান্ত। আশ্চর্য সব ফলের বৈচিত্র্য দেখে। সে সময় ছিল অ্যাপরিলট, স্বাদবিহীন অ্যাভোকাডো, দুধরনের বেরি—ব্ল্যাকবেরি ও ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি আর পিচ। ফল সর্বদাই আমার কাছে উপভোগ্য বলে মনটা ভরে গেল।
পরদিন সকালে উঠেই আমি আলমগীরের বেসমেন্টের পাঠাগারে গিয়ে বসি। বিশাল আকৃতির পাঠাগারটি আকরগ্রন্থ ও বিরল গ্রন্থসম্ভারে পরিপূর্ণ। একটু আগে শোনা পাখির কোনো ডাকই এখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। এই সেই ফিলাডেলফিয়া, যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি পড়েছে দুবার। তাঁর এখানে পরিভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বভারতীর জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। কবিগুরুর বক্তৃতার আগে নাকি স্থানীয় লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন গুরুদেবের মুখে ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, তন্ত্র-মন্ত্র ও সাধনমার্গ সম্পর্কে শোনার জন্য। কিন্তু তিনি বক্তৃতা করেছিলেন পশ্চিমা সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ এবং তা কীভাবে উগ্র রূপ ধারণ করে পৃথিবীর ক্ষতিসাধন করছে—এসব। এতে দর্শনীর বিনিময়ে নোবেল লরিয়েটের বক্তৃতা শুনতে আসা মানুষজন হতাশই হয়েছিলেন। টিকিটের অনেক উচ্চমূ্ল্য ছিল, সম্ভবত ২০ ডলার। তাই কেউ কেউ বলেছিলেন, আপনার এ বক্তৃতা শোনার জন্য আমরা এখানে আসিনি। আলমগীরকে বললাম, তিনি যে বাড়িতে ছিলেন, তা যেন খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
শহরটি রবি ঠাকুরের স্মৃতিধন্য, সেটি দেখতে কেমন, আর কীই-বা আছে এর অন্দরে! সেটি অবলোকন করার জন্য সকাল সকালই বের হয়ে যাই। তার আগে স্বাস্থ্য রক্ষার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এ শহরেই স্থাপিত আলমগীরের ক্যাফেতে প্রবেশ করি। এটির সব খাবারই জৈব, আটা-ময়দামুক্ত, ভেষজজাতীয়, পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। নাম ‘র ক্যান রোল’। বোঝাই যাচ্ছে, ক্লায়েন্টরা এখানে এসে সব কাঁচা খাবারই খোঁজে। যেমন আমরা খেলাম কচি গমপাতার জুস, অত্যন্ত পুষ্টিকর ও রোগ প্রতিরোধক। এখানে নাতনি মিথকে নামিয়ে দিয়ে আমরা চললাম স্বাধীনতার ঘণ্টা অভিমুখে। আলমগীরের অনুপস্থিতিতে কন্যা মিথই সারা দিন ক্যাফেটা চালাবে। তার জন্য সে পারিশ্রমিকও পাবে। কারণ, এটা আমেরিকা।
লিবার্টি বেল বা স্বাধীনতার ঘণ্টাটি দেখবার প্রাক্কালে আমাদের দেহ ও ব্যাগ তল্লাশি করা হলো। আমেরিকার প্রতিটি পর্যটন স্থাপনাই এখন প্রাক্-তল্লাশির আওতায়। এতটা কড়াকড়ি আমাদের কারোরই ভালো লাগেনি। যা হোক, জানতে পারলাম ১৭৭৬ সালে এ ঘণ্টা বাজিয়েই আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। যেখানে স্বাধীনতার জন্য সবাই এসে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে একটি চমৎকার নান্দনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এটির নাম দেওয়া হয় ইনডিপেন্ডেন্স হল। পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যটিকে বলা হয় ‘দ্য স্টেট অব দ্য ইনডিপেন্ডেন্স’। আর অঙ্গরাজ্যটির ডাকনাম ‘কি স্টোন স্টেট’।
স্বাধীনতার ঘণ্টাটি এখন আমেরিকার স্বাধীনতার এক মূর্ত প্রতীক, যেটিকে আগে ইনডিপেন্ডেন্স হলের ভেতর সংরক্ষণ করা হতো। আমরা ঘণ্টাটিতে একটা ফাটল লক্ষ করলাম। কারণ, ঘণ্টাটি বাজাতে বাজাতে এটির এমন ভগ্নদশা হয়েছে। এটি আর আগের অবয়বে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। তাই রেপ্লিকাগুলোও বানানো হয়েছে এর ভাঙা অবয়ব যুক্ত করেই, যেগুলো স্যুভেনির শপে দেদার বিক্রি হচ্ছে। এগুলোরই একটি মূল্যবান স্মৃতি আলমগীর আমাকে উপহার দিল।
বাইরে থেকে ঘণ্টাটি এখানে এনে স্থাপন করার পর, অর্থাৎ ফিলাডেলফিয়ায় স্বাধীনতার জাতীয় ঐতিহাসিক পার্ক স্থাপনের পর যখন ঘণ্টাটি এখানে আনা হয়, তখনই বাজানোর কারণে এটি ফেটে যায়। তারপর দুবার ঘণ্টাটি মেরামত করেন কারিগর জন পাস ও জন স্টো। এ জন্য ঘণ্টাটির ওপর এদের নামের শেষাংশ খোদাই করা। তবে প্রাথমিক অবস্থায় আইন পরিষদের অধিবেশনের আগে আইনপ্রণেতাদের জানান দেওয়ার জন্য এ ঘণ্টা ব্যবহৃত হতো। কখনো কখনো ব্যবহৃত হতো জনসভা ও কোনো সরকারি ঘোষণা সম্পর্কে নাগরিকদের অবহিত করার জন্য।
অতঃপর আমরা আসি পেন্স ল্যান্ডিংয়ে। উইলিয়াম পেন ইংল্যান্ড থেকে এখানে এসে নেমেছিলেন বলে নদীপাড়ের এ স্থানের নাম হয়েছে পেন্স ল্যান্ডিং। উইলিয়াম পেন নাকি রাষ্ট্রটি ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে জুয়া খেলে জিতেছিলেন। সে মুহূর্তে রাজার কাছে টাকাপয়সা না থাকায় পুরো অঙ্গরাজ্যটিই তিনি পেনের কাছে বাজি ধরেছিলেন। উইলিয়াম পেন ছিলেন স্যার উইলিয়াম পেনের পুত্র, যিনি এক সম্ভ্রান্ত ইংরেজ, লেখক, কোয়াকার এবং উত্তর আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় ইংরেজ উপনিবেশের স্থপতি। আর কোয়াকার অর্থ বন্ধু। এসব খ্রিস্টান একটি ধর্মীয় বন্ধুগোষ্ঠী স্থাপন করেছিলেন, যা ছিল গির্জাভিত্তিক। পেনসিলভানিয়া নামটি এ ঔপনিবেশিক প্রভুর নামই ধারণ করে আছে। আমরা ডেলাওয়ার নদীর যে ব্রিজটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তা দৃষ্টিনন্দন। ওপারেই নিউ জার্সির হাতছানি।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি আলমগীরের হারভিন রোডের বাসায় বিশ্রাম নিতে নিতে বাঙালিদের রাতের নিমন্ত্রণ রক্ষার সময় হয়ে আসে। উভয় বাংলার বাঙালিরা ফিলাডেলফিয়ায় একটি হৃদয়ানুগ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটির মধ্যমণি সুস্মিতা গুহ রায় এবং প্রধান চালক বদরুজ্জামান আলমগীর। সুস্মিতা দিদির বাসায় গিয়ে বাংলাদেশি ও ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে এক অপূর্ব সেতুবন্ধ ও প্রাণের স্পর্শ লক্ষ করলাম। সুস্মিতা বাংলাদেশি। বাংলাদেশিদের মধ্যে এ আড্ডায় আরও উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, খালেকুজ্জামান মতিন, বদরুজ্জামান আলমগীর, নার্গিস পারভীন, সাহিদা আফরোজ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা হলেন নীপা রায়, সুহিতা গায়েন, সৌরভ গায়েন, অতীশ চক্রবর্তী, রনিতা চক্রবর্তী ও শর্মিলা ব্যানার্জি। এ রাতে ওদের কাছ থেকে প্রিয় লেখক ও’হেনরির ঢাউস আকৃতির একটি নির্বাচিত গল্পের বই উপহার পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে যাই।
পরদিন সকালে শুরু হয় আরেক অভিযাত্রা। লক হ্যাভেনের উদ্দেশে বের হয়েই দুভাই চলে আসি গেটিসবার্গ শহরে। এখানে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের অনেক স্মৃতি ও গৃহযুদ্ধের বহু নিদর্শন রয়েছে। লিংকনের মূর্তি তো আছেই। এসব নিদর্শন ও স্মৃতিভান্ডারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্মৃতিবাহী স্থাপনাগুলোর খরচ নাকি সেসব রাষ্ট্রই বহন করেছে। গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস বিশ্ববিখ্যাত; যার মূল প্রতিপাদ্য: গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। বিশ্ব গণতন্ত্রের মানসপুত্র এই মহান নেতা জনগণের জন্য জীবন উৎসর্গ করলেও তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল আততায়ীর গুলিতে।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী ছিল রিচমন্ড। দক্ষিণাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো এক হয়ে উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তখন উত্তরের বাহিনী ইউনিয়ন আর্মি আর দক্ষিণের বাহিনী কনফেডারেশন নামে পরিচিত ছিল। উত্তরের বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইউলিসিস এস. গ্র্যান্ট এবং দক্ষিণ বাহিনীর প্রধান রবাট এডওয়ার্ড লি। ১৮৬১-৬৫ সালের গৃহযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলীয়রা হেরে যায়। তাতে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। দক্ষিণের জমিদার ও ভূস্বামীরা আর দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়নি। তাই এখনো নাকি দক্ষিণীরা মনে করে, আমরা বিচ্ছিন্নই আছি (কয়েক বছর আগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিকি হেলি দক্ষিণ ক্যারোলিনার গভর্নর হলে কংগ্রেসের সহায়তায় একটি আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে কনফেডারেশনের পতাকা ওড়ানো বন্ধ হয়েছিল)। শেষ দিকে তিন-চার দিনের যুদ্ধে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে, প্রায় ২০ হাজার। এর পরপরই উত্তরাঞ্চলের বিজয় ঘোষিত হয়। তখনই প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর জগদ্বিখ্যাত আবেগময় বক্তৃতাটি গেটিসবার্গে দিয়েছিলেন। এসব যুদ্ধবিগ্রহের বহু নিদর্শন দেখে দেখে আমরা অগ্রসর হই। কিন্তু হায়, পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যটির খোদ রাজধানী শহরই তো দেখা হলো না।
রাষ্ট্রটির রাজধানী শহরের নাম হেরিসবার্গ। আমরা জানতাম, ওইখানে কলকাতার পার্থ ব্যানার্জি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাই আলমগীরের ফোনের পরপরই আমরা তার অপেক্ষার স্থানে গিয়ে হাজির হই। তিনি আমাদের রাজধানী শহরটি ঘুরিয়ে দেখান। একটি পুরোনো ধাঁচের রেলস্টেশনে গিয়ে আমাদের ভালো লাগে। তাদের ক্যাপিটল ভবনটির স্থাপত্য ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল ভবন থেকে অনেক দৃষ্টিমনোহর। তবে ওইখানে লোকজনের আনাগোনা একেবারেই নেই। হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ওরা এটা কার জন্য বানাল তাহলে? অবশেষে পার্থ একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্টে আমাদের মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেন। আগের রাতে সুস্মিতা দির বাসায় আমাদের আড্ডায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী শর্মিলা, যিনি পরিসংখ্যান পড়েও একজন উচ্চমার্গীয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হতে পেরেছেন। এ রেস্টুরেন্টেও আমাদের একচোট আড্ডা চলে। অবশেষে পার্থর গাড়িতে আলমগীরকে তুলে দিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খালেকের গাড়িতে চড়ে বসি। তারপর দ্রুত এগিয়ে চলি লক হ্যাভেন অভিমুখে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার। সরকারের অতিরিক্ত সচিব
ছবি: লেখক